মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতা ছেড়ে বাঁচতে দাও
১৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৫২
করোনা ভাইরাস নামটা শুনলে এক সময় মানুষ ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠত কারণ দানবের মত অবিরাম ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব চালিয়েছে করোনা ভাইরাস। যা খালি চোখে দেখা যায় না। সময়ের পরিবর্তনে করোনা ভাইরাস তার চেহরা ও ধরন পাল্টিয়েছে। মানুষ এখন আর আগের মত এ ভাইরাসকে ভয় পায় না। তবে ধনী থেকে গরিব কিংবা গাছতলা থেকে পাঁচতলা নানা শ্রেণি পেশার মানুষ ভাইরাসের কাছে অসহায়াত্ব প্রকাশ করেছে। প্রাণঘাতি ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেছে আবার কেউ খুব কাছ থেকে মৃত্যুর স্বাদ দেখে এসেছে। তবে একবার ভেবে দেখা প্রয়োজন কেন পৃথিবীতে প্রাকৃতিক বিপর্য দেখা দিয়েছে তা একটু হলেও সবার কাছে স্পষ্ট হওয়ার কথা কারণ প্রকৃতিকে অত্যাচার করলে প্রকৃতি যে বিশ্রাম নেয় না বরং পাল্টা আঘাত করে তার প্রমাণ হিসেবে করোনা ভাইরাস।
মানবজাতি করোনা ভাইরাস থেকে কি শিক্ষা নিতে পেরেছে? করোনা আমাদের একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য যে কতটা প্রকট। আরও দেখিয়েছে শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে কত বৈষম্যের আয়োজন। ফলে এখান থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিশ্লেষণ করলে বুুুঝা যাবে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ এক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। কারণ এদেশের একশ্রেণির মানুষ কারো শ্রম চুরি করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়। অর্থাৎ রাতারাতি বিশ্বের ধনীর কাতারে অবস্থান করে। তাই রাষ্ট্রযন্ত্র যতই উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও জিডিপির কথা বলুক না কেন, করোনা দেখিয়ে দিল আমাদের বেশির ভাগ মানুষ তার মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বরাবর বঞ্চিত। আর স্বাস্থ্যখাতের অবস্থান তো বেহাল দশা।এখন করোনার দাপট কমেছে সত্য কথা কিন্তু আমাদের দেশের নিন্মআয়ের মানুষের অর্থনৈতিক সংকটের দাপট কমেনি বরং যত দিন যাচ্ছে সংকট ততো প্রকট হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে ভাবতে হচ্ছে দেশে যত উন্নয়ন হচ্ছে ততই যেন পরিবেশের নাস্তানাবুদ হচ্ছে। মানে প্রশ্ন হলো মানুষ কি সুস্থ বায়ু সেবন করতে পারছে? প্রশ্নের উত্তর বলতে গেলে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠার সাথে বলতে হয়। আমাদের দেশের পরিবেশ দূষিত হওয়ার কারণে মানুষ নানা বায়ুবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ু দূষণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী বাধা পালমোনারি রোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ও তীব্র শ্বাসকষ্ট সংক্রমণের ফলে আনুমানিক ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ কাজ, রাস্তার ধুলা ও অন্যান্য উৎস থেকে দূষিত কণার ব্যাপক নিঃসরণের কারণে শহরের বাতাসের গুণমান দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে বায়ুদূষণের শিকার দেশে মধ্যে শীর্ষ শহর রাজধানী ঢাকা। এর প্রধান কারণ হলো পুরনো যানবাহনের আধিক্য, অপরিকল্পিতভাবে শহরের যেখানে সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, শহরের আশপাশের ইটভাটা ও শিল্প-কলকারখানার দূষণ, শহরের ভেতরে যে ময়লা আবর্জনা জমে সেগুলো পোড়ানোর ধোঁয়া এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্যই বসবাসের অযোগ্য নগরী ঢাকা শহর। ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসাবে মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধুলা জমা হয়। এই জমে থাকা ধুলা দিনের বেলা বাতাসের সাথে মিশে যেমন দূষণ বাড়ায়, তেমনি রাতে গাড়ির অতিরিক্ত গতির সাথে বাতাসে উড়তে থাকে। আর তাই দিনের বেলা থেকে রাতের বেলা বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।
মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা দায়িত্ব কার? আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো চিকিৎসা। অর্থাৎ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব কিন্তু দুঃখের বিষয় রাষ্ট্র যখন পুঁজিবাদীদের স্বার্থের সাথে আঁতত করে সাধারণ জনগণের চিন্তা করে না তখনই রাষ্ট্রকে নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়, রাষ্ট্র তুমি কার? বড় বড় শিল্প কারাখানা কারা গড়ে তুলেন? বড় ইট ভাটা কারা তৈরী করেন? নিশ্চয় মোটাদাগে এদেশের পুঁজিবাদীরা। তাহলে প্রতিদিন পরিবেশ দূষিত হওয়ার জন্যই তো এদেশের কৃষক, শ্রমিক, কামার কুমার তাঁতি জেলে নয় যারা পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলেন তারাই দায়ি।
ইট প্রস্তুত ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন- ২০১৩ কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কৃষিজমির পাশে চলছে ইটভাটা। এমন তথ্য গুলো পত্রিকায় পাতায় পাতায়। আইনে পরিবেশের বাধ্যতামূলক ছাড়পত্র, পৌর এলাকায় ইটভাটা না করা, ইটভাটার জন্য মাটির সংস্থান নিশ্চিত করা, কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকায় ইটভাটা তৈরি না করার শর্ত থাকলেও আইন অমান্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরেরে ছাড়পত্র ছাড়াই নিজেদের কালো টাকা আর পেশি শক্তি দিয়ে ইটভাটা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভাটা চালু ও বন্ধের আগে গরম বাতাসে ও গ্যাসে কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদন হয় না। ফলের বিভিন্ন উদ্ভিদে ফল ধরে না। ইট ভাটার আশেপাশে বাসা বাড়িতে ধুলাবালু ও ছাই পড়ে রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয় এই এলাকার মানুষের।
জনগণের স্বাস্থ্যের সমস্যা কী প্রশাসনের নজরে আসে না? নজরে আসলেও কিছু করার থাকে না। কারণ মালিকদের ক্ষমতার দাপট দিয়ে তাদের কতৃত্ব বজায় রাখে। গত বছরে খবরে শুনেছি রাজধানী ঢাকার মানুষের আয়ু প্রায় সাড়ে সাত বছর কমেছে। এমন তথ্য নিশ্চিত করেছিলেন শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট। পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ হলো যানবাহনের কালো ধোঁয়া, মিলকারখান ও ইট ভাটার কালোধোঁয়া ইত্যাদি। তবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ না থাকলে সমাজে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকবে? উত্তর হচ্ছে এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারব না। যার কারণে তো মানবজাতি বুধ, শুক্র,, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন নামক গ্রহ গুলোতে এখন পর্যন্ত বসবাসের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। মানবজাতির কর্মকাণ্ডের চরম আবহাওয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন যে চরম তাপপ্রবাহ, প্রচণ্ড ভারী বৃষ্টিপাত, খরা বা সাইক্লোন হতে দেখা যাচ্ছে তাতে জলবায়ুর এই পরিবর্তন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। যার ফলে পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে যা মানবজাতির জন্য অশনিসংকেত।
বায়ুদূষণ রোধে রাষ্ট্রের ভূমিকা তেমনটা লক্ষ করার মত না। বায়ুদূষণ রোধের প্রধান কাজ তো পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু তারা যখন বায়ুদূষণ ঠেকাতে পারছে না তখন তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। ঢাকা শহরের শিক্ষিত মানুষ ও পরিবেশ উন্নত কিন্তু দিনের পর দিন খবর উঠে আসে ঢাকা শহর অস্বাস্থ্যকর তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আছে এই শহরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি, প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনসহ ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ঢাকা শহরেই আছে। কিন্তু এত শিক্ষিত ব্যক্তি থাকার পরেও আজ ঢাকা শহর কেন অযোগ্য নগরী হবে?
আমাদের দেশের ভিআইপি মানুষ তো খোলা রাস্তা বের হয় না তারা তো ভিআইপি গাড়িতেই চলাচল করেন। তাই তাদের পরিবেশ নিয়ে মাথার ব্যথা থাকে না। কিন্তু পরিবেশ দূষণের কবলে বেশি শ্রমজীবী মানুষ। যারা কি না দিনের পর পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য হন্ন হয়ে ঢাকা শহর ছুটেন তারাই বেশি এর ভুক্তভোগী। রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও কাজ নিশ্চত করা কিন্তু সেগুলোর তো নিশ্চিত করতে পারছে না। বলা রাখা ভালো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ চেয়েছিল স্বাধীন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাঁচতে। তাই বলতে আপত্তি নেই ‘মুক্ত বাতাসে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে দাও‘ মনে রাখতে হবে পরিবেশে বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। তাই মানুষ হিসেবে প্রধান দায়িত্ব শুধু উন্নয়নে নয় পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। ফলে দায়িত্ব জনগণের সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বায়ুদূষণের সূচক ৩০০ নয়, দূষণের পর্যায় সূচক ৫০ নিয়ে আসতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন ঢাকাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, অপরিকল্পিত যেসব কার্যকলাপ, তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকা শহরে এখনো প্রচুর ডিজেল চালিত পুরাতন বাস চলে এবং প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার যানজটে বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া নির্গত হয়। কালোধোঁয়া নির্গত যানবাহন জব্দ করতে হবে। সেই সাথে ডিজেল বাসের পরিবর্তে ইলেকট্রিক বাসের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সেক্টর থেকে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে হবে। সিটিকরপোরেশের উদ্যোগে নিয়মিত রাস্তায় পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। রাস্তা খুঁড়াখুঁড়ি কাজে টেন্ডারের শর্ত পালন করতে হবে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া, মিলকারখান ও ইট ভাটার কালোধোঁয়া বের না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা বায়ুদূষণের সাথে জড়িত তারা যত বড়ই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
যানজট কমানোর প্রতি মনোযোগী হওয়া ও ধীরে ধীরে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণকে টার্গেট করে আমাদেরকে নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। শহরের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পরিকল্পনা করা। বৃদ্ধির বিষয়টিও পরিকল্পিতভাবে হতে হবে। নাগরিকরা যেসব সমস্যা মোকাবেলা করছে, সেগুলো সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। পরিবেশ সুস্থ রাখতে বিভিন্ন গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ভূমিকা পালন করতে হবে। বাসযোগ্য দেশ ও নগরী হিসাবে গড়ে তোলার কাজটি মেয়র, কাউন্সিলর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। মানুষকে মুক্ত বায়ু সেবন করতে দিতে হবে। পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতানার ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হলে মানুষ মুক্ত বাতাসে স্বাধীন ভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। আর এ গুলো কাজ রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতা ছেড়ে বাঁচতে দাও মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ