জাতীয় পতাকা এবং আমাদের দায়-দায়িত্ব
১ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫১
যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশকে ভালোবাসেন? উত্তর আসবে ‘হ্যাঁ’। যদি প্রশ্ন করা হয়, জাতীয় পতাকাকে ভালোবাসেন? উত্তর আসবে ‘হ্যাঁ’। তেমনি যদি প্রশ্ন করা হয়, জাতীয় পতাকার আকার বা ব্যবহারের নিয়ম জানেন? উত্তরে…? একজন স্বাধীনচেতা মানুষ তথা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব রয়েছে, জাতীয় পতাকার সম্পর্কে জানা, সম্মান দেখানো এবং নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে পালন করা। দায়িত্ব রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য জানা এবং সে অনুযাযী সংরক্ষণ করা ও মানা।
আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ করিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধ আমাকে কাঁদায়-ভাবায়। সব সময় আমাকে ভাবিয়ে তোলে। যে জাতি জীবনের বিনিময় দেশ স্বাধীন করেছে, সে জাতি কখনোই হেরে যাওয়ার নয়; হারতে শেখেনি, হারতে পারেও না। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমি শুনিছি। যতবারই শুনি ততবারই একটা মুগ্ধতা বিবেক তাড়িত করে। প্রশ্ন করে, ‘তুমি মুক্তিযুদ্ধ দেখনি, মুক্তিযুদ্ধ করনি কিন্তু যা দিয়ে গেছি, তা কি তুমি সংক্ষণ করেছ? সম্মান দিচ্ছ? নাকি সব পেয়ে ভুলে গেছ!’ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির জীবনে সোনালি দিন হচ্ছে ১৯৭১ সালের মার্চের অগ্নিঝরা দিন। নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম আর আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে একাত্তরের গৌরবময় দিনগুলো আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কি সেই স্বাধীনতা নামক শব্দটি ভুলে যেতে বসেছি? আমরা কি সেই লাল-সবুজের পতাকাকে সংরক্ষণ করছি? ইতিহাস ও ঐতিহ্য কি বুকে আগলে রাখছি? আমি একজন নতুন প্রজন্মের নাগরিক হিসেবে মনে করি, না পারিনি, পারছিও না। প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্ব কার? কে সংরক্ষণ করবে? নতুন প্রজন্মকে জানান দেওয়ার দায়িত্বই বা কাদের? সেই দায়িত্ববোধ থেকে কতটুকুই দায়িত্ব পালন করছি, নতুন প্রজন্মের মধ্যে কতটুকু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছি!
৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার যে স্বাধীনতা সূর্য অস্ত গিয়েছিল, তা একাত্তরের মার্চে আবারও উদিত হয়। বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য স্বাধীনতার লড়াইয়ে শরিক হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেদিন সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। এ ধরনের ঐক্য আমাদের জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয় নতুন চেতনা এবং মূল্যবোধ। যে জাতি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করে, সে জাতি কোনোদিন পিছিয়ে থাকতে পারে না। নতুন প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন দিন, এক সুখী-সমৃদ্ধ-উন্নত বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে ‘আর আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, প্রতি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’ -এ আহ্বান জানিয়েছেন। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ডাক জাতির অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। জনগণের অন্তরাত্মার প্রস্তুতি অনুভব করেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করার নৈতিক শক্তি পেয়েছিল বাঙালি জাতি।
একটি জাতীয় পতাকা একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়, স্বাধীনতা সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। জাতীয় পতাকা হলো জাতির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা এবং শহীদদের সম্মানের প্রতীক। জাতীয় পতাকা মাথা উঁচু করে বিশ্বের কাছে দেশকে পরিচিত করে। আমরা কি দেখছি, সেই জাতীয় পতাকাকে আমরা মূল্যায়নের চেয়ে অবমূল্যায়নই বেশি করছি। তার কারণ হতে পারে দুই রকম। একটি হলো, পতাকার নিয়ম-কানুন না জানা এবং জেনেও না জানার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া। দেখা গেছে, অনেক জায়গায়ই অসচেতনতার কারণে অনেক ব্যতিক্রম ঘটে। তবে এটি সত্য যে, জাতীয় পতাকা ব্যবহার রয়েছে সর্বোচ্চ প্রশংসনীয় পর্যায়, কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনিটরিং, নিয়ম-বিধি মানা হচ্ছে না, মানতে দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, কোনো ধরনের নিয়ম-নীতি না মেনে একেকজন একেকভাবে পতাকা ওড়াচ্ছেন বা অর্ধনমিত রাখছেন। এক্ষেত্রে পতাকার রঙ, আকার-আকৃতি বা উত্তোলনের ধরনের মধ্যেও গরমিল দেখা যায়। আমার চোখে দেখা এখনো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা বিভিন্ন জায়গায় পতাকা সঠিকভাবে টানানো হচ্ছে না। এমনকি সরকারি দপ্তরে অনেক সময় নিয়ম মানা হচ্ছেনা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অনেক জায়গাই পতাকার মাপ এবং পতাকার সাথে বাঁশ ব্যবহারেও রয়েছে অবহেলা। স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে গেলেও স্বাধীনতার অর্জন এবং বিশ্বের কাছে যে পতাকা দিয়ে দেশ পরিচিতি হচ্ছে সেই জাতীয় পতাকার মুল্যায়ন বা পতাকা ব্যবহার আমরা জানিনা বা জানতেও চাইনা। অথচ স্বাধীনতার বড় অর্জন এই জাতীয় পতাকার নিয়ম-নীতি বা রক্ষা করা আমাদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দুঃখের আর লজ্জার বিষয় স্বাধীনতার এতো বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা আজও পতাকার সম্মান ধরে রাখতে পারিনি। কিন্তু কেন? পতাকার সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব যেমন নাগরিকদের তেমনি সরকারসহ সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব রয়েছে। শুধু আইন করেই শেষ নয়। আপনি দেশপ্রেমিক, এ কথা বোঝানোর জন্য বাড়িতে যখন তখন জাতীয় পতাকা ওড়াতেই হবে- এটা বলছি না। যখন তখন জাতীয় পতাকা ওড়ানোর নিয়মও নেই। তবে বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে বাড়িতে, গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ানো যায়। মহান বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়, ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর নিয়ম রয়েছে। আবারো বলি, বাড়ির ছাদে অথবা গাড়ির সামনে জাতীয় পাতাকা ওড়ালেই আপনি দেশপ্রেমিক হয়ে যাবেন, অথবা নিজেকে দেশপ্রেমিক প্রমাণ করার জন্য বাড়ির ছাদে জাতীয় পাতাকা ওড়াতেই হবে এমন ভাবনার সঙ্গে আমি একমত নই। জানতে হবে জাতীয় পতাকার রং, জাতীয় পতাকার মাপ, জাতীয় পতাকার সম্মান, আইন, বিধি।
আমি মনে করি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা টানানো এবং এর নিয়মনীতি বা আইন সম্পর্কে বাস্তবিক ধারণা দেয়া, প্রতিটি সভা-সেমিনারের মাধ্যমে জাতীয় পতাকার গুরুত্বের বিষয় ধারণা দেয়া, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে জানানো, জাতীয় দিবসগুলোতে মাঠ পর্যায় উপজেলা পর্যায় জাতীয় পতাকা কমিটির তদারকি করা। এছাড়াও গণমাধ্যমে জাতীয় পতাকার ব্যবহার বিধি নিয়ে বেশি বেশি প্রচারণা এবং তথ্য মন্ত্রনালয় থেকে বেশি বেশি পোষ্টার, লিফলেটের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো। প্রথম থেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের জাতীয় পতাকার বিষয় ধারণা দেয়া। ইউনিয়ন-ওয়ার্ড ভিত্তিক নির্ধারিত একটি দিনে শুধুমাত্র পতাকা নিয়ম-আইনসহ নানা বিষয়ে সচেতন করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সুধু সরকার বা প্রশাসন নয় জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। পতাকার একটি আইন আছে এবং সেখানে পতাকা অবমাননার শাস্তির বিধানও আছে। তাহলে কেন এতো অবমাননা? অবহেলা? এ থেকেই বুঝা যায়, শুধু আইন দিয়েই কাজ সম্পাদন করা সম্ভব নয়, মানসিকতার প্রয়োজন। পতাকার সম্মানের দিকে তাকিয়ে মেনে চলার বিষয়ে মানুষকে আগ্রহী করে তোলা জরুরি। তা নাহলে একদিন স্বাধীন-সার্বভৌমের ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে যেতে বাধ্য।
পতাকার ইতিহাস: ইতিহাস থেকে জানা যায়, ‘১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্যবহৃত পতাকার উপর ভিত্তি করে এই পতাকা নির্ধারণ করা হয়, তখন মধ্যের লাল বৃত্তে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল, পরবর্তীতে পতাকাকে সহজ করতেই মানচিত্রটি বাদ দেয়া হয়। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাপানের জাতীয় পতাকার সাথে মিল রয়েছে, কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে বাংলাদেশের সবুজের স্থলে, জাপানীরা সাদা ব্যবহার করে। লাল বৃত্তটি একপাশে একটু চাপানো হয়েছে, পতাকা যখন উড়বে তখন যেন এটি পতাকার মাঝখানে দেখা যায়।
১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেরুয়রি ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়। ছাত্র নেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এই লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১১৬ (বর্তমান ১১৭-১১৮) নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ন দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ। সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন; এরপর ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল)এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকেন পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ পরিশেষে তার নিপুন হাতে মানচিত্রটি লাল বৃত্তের মাঝে আঁকেন।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ছাত্র নেতা আ.স.ম. আব্দুর রব। তিনি সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের চিহ্ন চাঁদ তারা ব্যবহার না করার জন্য নতুন এই প্রতীক তৈরী করা হয়েছিল। সিআইএ ওযার্ল্ড ফ্যক্টবুক অনুযায়ী বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি বুঝাতে পতাকায় সবুজ রং ব্যবহার করা হহয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান মার্চ ২৩ তারিখে তার বাসভবনে, স্বাধীনতা ঘোষণার প্রাক্কালে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ণ দাশের ডিজাইনকৃত পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলে পটূয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।’ (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া)
স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্জিত সেই লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধি। আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ (সংশোধিত ২০১০)-এ বলা আছে, জাতীয় পতাকা গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং ১০:৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈঘ্যেরে এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে এবং লাল বৃত্তটি ঠিক কোন অংশে থাকবে, সেটিও উল্লেখ করা আছে। আইনে পতাকার রং, ছোট গাড়ি, মাঝারি বা বড় গাড়িতে এর আয়তন সবই লেখার পাশাপাশি পতাকা উত্তোলনের বিষয়েও বলা আছে। ইচ্ছে করলেই যে কেউ গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারবে না। জাতীয় পতাকা কোনো অবস্থাতেই সমতল বা সমান্তরালভাবে বহন করা যাবে না এবং উত্তোলনের সময় সুষ্ঠু ও দ্রুতলয়ে উত্তোলন করতে হবে এবং সসম্মানে অবনমিত করতে হবে। মোটরগাড়ি, নৌযান, উড়োজাহাজ ও বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য সময় পতাকা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উত্তোলিত থাকবে এবং সূর্যাস্তের পর কোনো মতেই পতাকা উড্ডীন অবস্থায় থাকবে না।
১৯৭২ সালে প্রণীত ‘জাতীয় পতাকা বিধিমালা’য় পতাকা যথাযথভাবে ব্যবহারের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। যা মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪(১) অনুযায়ী ‘প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা হচ্ছে সবুজ ক্ষেত্রের ওপর স্থাপিত রক্তবর্ণের একটি ভরাট বৃত্ত।’ অন্যদিকে পতাকা বিধিতে বলা হয়েছে, পতাকার রং হবে গাঢ় সবুজ এবং সবুজের ভেতরে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। বিধিমালার ৪-এর (১)-এ নিম্নবর্ণিত দিবস এবং উপলক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি ভবনসমূহে এবং বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনের অফিস ও কনস্যুলার পোস্টসমূহে নিম্নরূপ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করিতে হইবে : (ক) মহানবীর জন্ম দিবস (ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী); (খ) ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস; (গ) ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস ও (ঘ) সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যেকোনো দিবস। ১ (২)-এ নিম্নবর্ণিত দিবসসমূহে পতাকা’ অর্ধনমিত থাকিবে (ক) ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস; (খ) ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস; এবং (গ) সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যে কোনো দিবস। কিন্তু কতজনে জানে আইন বা নিয়ম?
আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা বা জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে এই আইন সংশোধিত হয়। এই সংশোধনীতে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত শাস্তি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। না জেনে, না বুঝে আর অতি উচ্ছ্বাসে যারা পতাকা ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন করেন, তাদের অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে এই শাস্তির বিধান যথাযথ হতে পারে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বাণিজ্যিক কোনো প্রচারণায়, বিজ্ঞাপনে জাতীয় পতাকার ব্যবহার বিধিবহির্ভূতভাবে করে থাকে, তার জন্য ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, যাকে অনেকেই অপ্রতুল মনে করছেন। আইনে এত বিধি-বিধান থাকলেও বাস্তবে এর রূপ দেখা যায় না। দেখা যায় না তেমন কোনো শাস্তি দিতে।
পরিশেষে— জাতীয় পতাকা ব্যবহারের নিয়মের বিষয় জনগণকে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য সভা-সেমিনার করা উচিত। আইনটি সবার জানা দরকার এবং পতাকা আইন অনুযায়ী ব্যবহার হচ্ছে কি না, সেটি মনিটরিংও গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে চাই তাহলে পতাকার ওপর নজর রাখা জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। দীর্ঘ ৪৮ বছরেও যা পারিনি বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে আসুন আমরা জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান দেখাই। ঐতিহ্য ধরে রাখি, আমরা নাগরিক, জাতি ও রাষ্ট্র তা পালন করবে এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
জাতীয় পতাকা এবং আমাদের দায়-দায়িত্ব মুক্তমত শফিকুল ইসলাম খোকন