Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুজিব নগর সরকার ও বাঙালির কূটনৈতিক অগ্রযাত্রা

অনন্য প্রতীক রাউত
১৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:০৮

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত শব্দাংশ ‘মুজিবনগর’। স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার হিসেবেই যার পরিচিতি বাংলাদেশের ইতিহাসে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে বাঙালিকে সঠিক নির্দেশনা, যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং অন্যান্য বিষয়ের এক ভরসার নাম ছিল মুজিবনগর সরকার। মূলত বহি:বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও তাঁদের মাধ্যমে মানবিক সাহায্য লাভে মুজিবনগর সরকার অসাধারণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়৷ দুরবস্থার মাঝে যা বাঙালিকে মুক্তির পথে অগ্রগামী করতে ভূমিকা রেখেছে প্রেরণারূপে, দিয়েছে লড়ার সঠিক নির্দেশনা।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর বাঙালি হাজার বছরের শোষণের বাস্তবতা ভুলে মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। এদিকে তখনকার শীর্ষ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কীভাবে লড়া যায় সে বিষয়ে চিন্তিত হয়ে ভারতযাত্রা করেন। সেখানেই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ৩ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠক হয়। অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ শঙ্কিত হলেও লেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের শরণাপন্ন হয়ে তিনি একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন। উভয়েই তাজউদ্দীন আহমদকে বোঝাতে সক্ষম হন এ সময় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় নেই কোনো। পরবর্তীকালে কলকাতা ফিরে তখনকার যুবনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তাজউদ্দীন আহমদ (তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা)।

যেখানে উপস্থিত ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। উপস্থিত সবাই ভারতের সাহায্য নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার পক্ষে একমত পোষণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং মূলধারা ’৭১ বইয়ের লেখক মঈদুল হাসান, তার বইয়ে লিখেছেন, বৈঠকে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চাওয়ার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। সে অনুষ্ঠানে অস্থায়ী সরকার গঠনের যৌক্তিকতা নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম। কারও কারও আপত্তি থাকলেও শেষপর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। এ সরকারের মূল ব্যক্তিরা ছিলেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, উপ-রাষ্ট্রপতি তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা, তথ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন। এছাড়া খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচএম কামরুজ্জামানকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যারা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ নেয় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল।

সাধারণ জনতা পুলিশ, ইপিআর এবং অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর ঠিক উল্টো পথে হেঁটে গেরিলা যুদ্ধে যখন এক এক করে বিধ্বস্ত করছে পাক বাহিনীর শক্তিশালী দুর্গ ঠিক তখনই মুজিবনগর সরকার নিজ দায়িত্বে থেকেছে অনড়। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড, লন্ডন, নিউইয়র্কসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে অস্থায়ী কার্যালয় খোলে মুজিবনগর সরকার। সেখান থেকেই (ভারত) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক, সামরিক এবং কূটনীতিক বিষয়গুলো পরিচালনা করতে থাকে তারা। যুদ্ধ চলাকালীন নয় মাস অস্থায়ী সরকার নানা ধরনের অস্থিরতা এবং টালমাটাল অবস্থা মোকাবিলা করেছে। ভারত সরকারের সঙ্গে সমন্বয়, নিজেদের মধ্যে বিভেদ সামাল দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক জনমত গঠন- এসব কিছু একসঙ্গে করতে হয়েছে অস্থায়ী সরকারকে।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কটনৈতিক তৎপরতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। কারণ বহির্বিশ্বে তৎপরতার মধ্যদিয়ে মুজিবনগর সরকার বাঙালির প্রতি পাক শাসকদের অন্যায় অবিচার, শোষণ নিপীড়ন, হত্যা, ধ্বংস এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের মিশন স্থাপন মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহোম সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপন এবং ঐসব স্থানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি নিয়োগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা। ভারতে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন:ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশননিউইয়র্ক ও জাতিসংঘে মিশন স্থাপন।

মুজিবনগর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে বিশেষ দূত নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বহির্বিশ্বে সমর্থন ও জনমত আদায়ের চেষ্টা করেন। এছাড়াও বাংলাদেশের নাগরিক এবং সহানুভতিশীল ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান ও অন্যান্য কতিপয় শক্তিশালী দেশের সমর্থন লাভে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালানো। এ ধরনের তৎপরতার ফলে ঐসব দেশে মুক্তিযুদ্ধের অনুকূল সংবাদ শিরোনাম প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভায় আসেন। এরপর হতে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরে আসেন নি। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তাঁর মূল দায়িত্বই ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বহির্বিশ্বে তৎপরতা চালানো।

মহান মুক্তিযুদ্ধ মহাকালের মহাকল্লোল, গণমানুষের বুক চিতিয়ে লড়াই করার এক সুনিপুণ নির্দশন। গণমানুষ যেমন লড়েছে মাঠে তেমনি টেবিলে টেবিলে কূটনীতি সামলেছে মুজিবনগর সরকার। ফলে, বিশ্বের অনেক পরাশক্তি রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের নির্যাতনের বিরোধিতা করেছিল। কোনোভাবেই গণমানুষের লড়াইকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই তেমনি মুজিবনগর সরকারের ভূমিকাকেও। হতে পারত মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে আমরা পেতাম না মুক্তির স্বাদ, মাত্র নয় মাসে হয়ত উড়তো না লাল-সবুজের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধকে একটি সিস্টেমেটিক পন্থায় পরিচলানা এবং বাংলার মানুষকে বিজয়ের স্বাদ দেওয়ার অসীম যে কর্মপন্থা তা বাস্তবায়নে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা অনন্য। এখন কথা হলো, মুজিবনগর সরকার এমনি এমনি এমতবস্থায় আসেনি। ইতিহাস বলে এমন অবস্থা বা বিজয়ের সম্ভাবনা গড়ে তোলার পিছনে যে মানুষটির সবচেয়ে বড় ভূমিকা তিনি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শোষিত বাঙালিকে তিনি নিয়েছেন বিজয়ের প্রান্তে আর তীরে তরী ডোবার হাত থেকে রক্ষা করেছে মুজিবনগর সরকারের দূরদর্শী কূটনীতি। এমন বাস্তবতাই চিরন্তন সত্যি ইতিহাস। ঠিক সেজন্যই মুজিবনগর সরকারের পাশে না থাকলেও বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতির মর্যাদা। এই শ্রদ্ধাবোধের জায়গা বাঙালিকে আরও বেশি উজ্জীবিত করেছে এমনটা বললে কি ভুল হবে? নিশ্চয়ই না। বরং, বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রতিট পদক্ষেপে প্রেরণার অসীম উৎস হয়ে, ভরসার প্রতীক হয়ে বাঙালির হৃদয় মণিকোঠায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

অনন্য প্রতীক রাউত মুক্তমত মুজিব নগর সরকার ও বাঙালির কূটনৈতিক অগ্রযাত্রা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর