Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বেটার লেট দেন নেভার

আনোয়ার হাকিম
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:৪১

বাস্তবিকই আমরা সব পারি। আমাদের এই পারদর্শিতা একান্তই আমাদের অর্জন। আমাদের পূর্বসূরি বাপ-দাদারা মুখ্য-সুখ্য মানুষ ছিলেন। তাহারা অতিশয় ভদ্র্র কিসিমের লোক ছিলেন। মোটা কাপড়, মোটা ভাত আর সাদাসিধা জীবন যাপনে তাহারা অভ্যস্ত ছিলেন। তাহাদের মধ্যে শিক্ষার সার্টিফিকেটে কমতি ছিলো। কিন্তু আহরিত অল্প শিক্ষাতে প্রবল দ্যুতি ছিলো। ইহার ফলে তাহারা নীতি-নৈতিকতায় অতি উঁচু মানের ছিলেন, চিন্তা-চেতনায় স্ফটিক স্বচ্ছ ছিলেন। মানবিক মূল্যবোধে অনুকরণীয় ছিলেন। পারিবারিক ও সামাজিক ফয়সালায় আর অভিভাবকত্ব প্রয়োগে নিরপেক্ষ, ইস্পাত-দৃঢ় ও আমলী ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

তাহারা গায়ে গতরেও সুঠাম ছিলেন। ষড় ঋতুর চক্রাবর্ত তাহাদেরকে পর্যুদস্ত করিতে পারিত না। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে তাহারা খালি গা হইয়া ক্ষেতে কাজ করিতেন আর গাছের তলায় মাচায় বসিয়া একান্ত পরিবেশে পারিবারিক ও সামাজিক সকলকে লইয়া চ্যাটিং করিতেন। মাঘের কনকনে শীতে একখানা চাদর গায়ে জড়াইয়া মাইলের পর মাইল হাঁটাচলা করিতেন, ক্ষেত-খোলার দেখভাল করিতেন। বাড়ী আসিয়া গরম ভাত সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যাঞ্জন সহকারে উদরস্থ করিতেন। গ্রামীন শিক্ষিত সমাজকে তখন শহরমুখীতা এত বেশি আকৃষ্ট করিত না। বিশেষ দরকার না হইলে নগরে বা গঞ্জে তাঁহাদের যাতায়াত ছিলো না। যাহারা চাকরি বা ব্যবসায় উপলক্ষে গঞ্জে বা শহরে আবাস গাড়িত তাহারাও নি:শ্বাস ফেলিবার জন্য সপ্তাহান্তে বা মাসান্তে একবার হইলেও গ্রামে আসিয়া নির্মল বায়ুসহ টাটকা শাক-সবজি খাইয়া রিচার্জ হইয়া যাইতেন। তাহাদের উত্তর প্রজন্মের আমরাও মাইলে পর মাইল হাঁটিয়া স্কুল করিয়াছি। খাল পার হইয়া, পায়ে হাঁটিয়া, নদী সাঁতরাইয়া, ফল পাড়িয়া, জাম্বুরাকে ফুটবল বানাইয়া গৌর বর্ণকে তামা তামা করিয়া ফেলিয়াছি। তবু এতটুকু ক্লেশ বোধ হয় নাই। ইতিউতি করিবার খায়েস জাগে নাই। হতাশা ভর করে নাই।

বিজ্ঞাপন

তখন এত চিকিৎসা ছিলো না। স্থানীয় ডিসপেনসারি হইতে কাঁচের শিশিতে করিয়া নানা রংয়ের তরল সেব্য যাহা দেওয়া হইত উহাই দাওয়াই হিসাবে যথেষ্ট জ্ঞান করিয়া নাক চাপিয়া ধরিয়া গলাধঃকরণ করিয়া ব্যামোকে টা টা জানাইতাম। গ্রামের মক্তব তখন প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ করিত। সেখানে আলিফ, বা, তা, সা ছাড়াও আদব-কায়দা, নীতি-নৈতিকতার ছবক দেওয়া হইত। সেখানেই ধর্মীয় অনুশাসন আর মূল্যবোধের হাতেখড়ি হইত। বিনোদনের মধ্যে কোমরে কাছা মারিয়া হাডুডু খেলা, বাৎসরিক বা পর্ব ভিত্তিক মেলা, যাত্রা গান আর সার্কাস ছিলো আরাধ্য। তখন অর্থনীতির সবলতা এত বেশি শক্ত ছিলো না। দুর্ভিক্ষ আর অতিমারি এই জনপদকে প্রায়ই নানা উছিলায় পর্যুদস্ত করিত। বিপদসংকুল জনপদের মানুষ ইহাকে মোকাবিলা করিবার জন্য আল্লাহর উপর ভরসাকে মূল ভিত্তি করিয়া ঝাড়ফুঁক, টোটকা, তাবিজ-কবজ করিত। মোটকথা সামাজিকভাবে ইহাকে মোকাবেলা করিতে সচেষ্ট থাকিত। একের বিপন্নতায় অন্যরা পাশে আসিয়া দাঁড়াইত। সামাজিক এই শক্তিই ছিলো তখনকার সবচাইতে বড় সুরক্ষা বেষ্টনী।

কালে কালে নগরায়নের ছোঁয়া লাগিয়াছে। শিক্ষার প্রসার হইয়াছে। বাণিজ্য অতিশয় স্ফীত হইয়াছে। আর্থিক খাত চাঙ্গা হইতে শুরু করিয়াছে। সরকারি সুরক্ষা বেষ্টনী বহুমুখী ও ব্যাপক হইয়াছে। পাশ্চাত্যের বাতাস গায়ে লাগিয়াছে। উন্নত জীবন মানেই শহুরে জীবন – এই মরীচিকা বিশ্বাসে আমাদের আধুনিক নগর সভ্যতা বেপোরোয়া হইয়া উঠিয়াছে। ঝলমলে বাতি আর সুদৃশ্য দালানে অধিক নিরাপত্তা আর আভিজাত্য ফুটিয়া উঠিয়াছে। ফুটানিতে আত্মতুষ্টি জাগ্রত হইয়াছে। উন্নত জীবন যাপনের লক্ষ্যে ব্যয় নির্বাহার্থে নানা প্রকার খোঁজ-খবর, তয়-তদবির, ধান্ধা-ফিকিরের আবশ্যকতা দেখা দিয়াছে। এইভাবেই আমাদের যাত্রা পথ সম্মুখবর্তী হইয়াছে। সেইসাথে এত্তা জঞ্জালেরও সূত্রাপাত হইয়াছে। এত এত পরিবর্তনের আয়োজন এক জেনারেশনের এই আমাদেরকে ঘিরিয়াই দ্রুত ব্যাপক হইয়াছে। সন্দেহ নাই ইহাতে জীবন মান উন্নত হইয়াছে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বিনোদন তুষ্টিদায়ক হইয়াছে। কিন্তু ইহার সর্বগ্রাসী রূপও ডালপালা বিস্তার করিয়া মূল কান্ডকে ঢাকিয়া দিবার উপক্রম করিয়াছে। সরকারের প্রয়াস সত্বেও নাগরিক সুবিধা এখনো সবার কাছে গিয়া পৌছে নাই।

বাপ-দাদাদেরকে যেরূপে দেখিয়াছি, নিজেরাও যে ধারায় বড় হইয়াছি হঠাৎ করিয়াই যেন উচ্চ আলোর ঝলকানিতে আমরা চমকিত ও মোহিত হইয়া পড়িয়াছি। দ্রুতগামী এসকেলেটরে উঠিলে যেরূপ টুপ করিয়া ইচ্ছামত উল্টো পথ ধরিবার জো থাকে না আমাদের দশা তেমনটি হইয়াছে । সেই যে আমরা সম্মুখবর্তী হইয়াছি আর ফিরিয়াও দেখিনাই। আমরা নিজেরা আমাদের স্বকীয়তাকে খুব সহজেই ঝারিয়া ফেলিয়া দিয়া উন্নত জীবনের পোষাক পড়িয়া ফেলিয়াছি। আর তারই সিলসিলায় আমাদের উত্তর প্রজন্মের সকল আবদার বিনা বাক্য ব্যয়ে মিটাইয়া চলিয়াছি। আমরা নিজেরা ছোটবেলায় মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরিয়া ফিরিয়াছি। আর আমাদের উত্তর প্রজন্মকে গোল্ডেন ফাইভ বানাইতে গিয়া ফার্মের মোটা তাজা ওজনদার মুরগী বানাইয়া ফেলিয়াছি। ইহার দায় একক ভাবে কাউকে দেওয়া যাইবে না। তবে সামষ্টিক ভাবে হইলেও ইহা একান্তভাবে আমাদের মত এক জেনারেশনের ভদ্র্রলোকদের উচ্চাকাঙ্খার ফসল।

আমরা নীতি-নৈতিকতার ছবক পাইলেও আমরাই ইহাকে সর্বাগ্রে ঝারিয়া ফেলিয়াছি। গ্রামীন আবহাওয়ায় বড় হইলেও আমরাই নগরমুখী হইয়া গ্রামীন জনপদকে উন্নত করিতে আর কোন উদ্যোগ লই নাই। গ্রামে থাকে অশিক্ষিত ও অনগ্রসর সমাজ – এই উন্নাসিকতা আমরাই হৃদয়ে পোষণ করিয়া গ্রাম বিমুখ হইয়াছি। আর মানবিক মূল্যবোধ ও সহমর্মিতার দুর্বল জায়গাটাকে করিয়াছি বিদায়। একের দু:খে অপরের সাহায্যের হাতকে গুটাইয়া ইহার স্থলে সিন্ডিকেটের হাতকে শক্তিশালী করিয়াছি। নানারূপ ফন্দি-ফিকির আঁটিতে শিখিয়াছি। দেশ ছাড়িয়া বিদেশ মুখী হইতে শিখিয়াছি। গ্রামকে যেরূপ অচ্ছ্যুত করিয়াছি তেমনি এখন দেশকেও হেভনটদের বাসস্থান জ্ঞান করিয়া পুত্র-কন্যা-জায়া সহযোগে বিদেশে আস্থানা গাড়িতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছি। যেন ব্রেক ফেল করা দ্রুতগামী যানে চড়িয়া বসিয়াছি; তাই ফিরিবার উপায় নাই। আমাদের উত্তর প্রজন্মকে আমরা হাতে কলমে এই শিক্ষাই দিতেছি যে, অতীতমুখী হইয়া লাভ নাই বরং সম্মুখেই অবারিত সুখের নহর। খাও দাও ফুর্তি করো। দুনিয়া কো লাথি মারো, দুনিয়া তোমারি হ্যায়।

আমরা বাহারি রূপে নগর সাজাইতে গিয়া পরিবেশকে বিপন্ন করিয়া ফেলিয়াছি। নদী মাতৃক তকমা মুছিয়া ফেলিয়া অট্টালিকা ভিত্তিক উন্নয়ন প্রয়াসী হইয়াছি। খাল-বিল-নদী-নালা ভরাট করিয়া সর্ব গ্রাসী চরিত্র পরিগ্রহ করিয়াছি। সকল সেবা-সুবিধা রাজধানী কেন্দ্রিক পুঞ্জীভূত করিয়া জেলা গুলাকে কিছু মিছু দিয়া গ্রাম সমূহকে মাঝে-মধ্যে দয়া-দাক্ষিণ্য করিয়া থাকি। এক শ্রেণীর লোক দান মারিয়া, ছল-চাতুরীর আশ্রয় লইয়া, ভং ধরিয়া, রঙ পাল্টাইয়া, চাপা পিটাইয়া, চক্ষু উল্টাইয়া রাতারাতি সুপার ক্লাস উচ্চ বিত্ত হইতেছে। দেশান্তরীও হইতেছে। এইসব দেখিয়া মেধাবীরাও যেনতেন প্রকারে বিদেশে স্বর্গ আর স্বর্ণ খুঁজিতে পাগলপারা হইয়াছে। একবার বিদেশে পাড়ি দিতে পারিলে ইহারা যে আর ইউটার্ণ লইবে না ইহা নিশ্চিত। তখন রেমিট্যান্স আর ইনফ্লো হইবে না। বিনিয়োগ যোগ্য পুঁজি আর পুন:বিনিয়োগের আবর্তন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হইবে না। ইহাতে লরেঞ্জ কার্ভের কী দশা হইয়া উহা জানিতে বা বুঝিতে অর্থনীতিবিদ, গবেষক বা বুদ্ধিজীবি হইতে হইবে না। গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবার মান মানবেতর। শিক্ষার অবস্থাও তদ্রুপ। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অকল্পনীয়। আধুনিক জীবন অভিলাষী ব্যাপক জনগোষ্ঠী তাই গ্রাম হইতে শহরে আর শহর হইতে নগরে ভীড় করিতেছে। গ্রামকে এই সব উন্নয়ন সুবিধার আওতায় আনিতে না পারিলে এই প্রক্রিয়ায় মানুষের স্থানান্তর রোধ করা যাইবে না। নাগরিক সমস্যা প্রকট হইতে প্রকটতর হইতে থাকিবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আরো অধিক আকারে ও প্রকারে গ্রামমুখী করিতে হইবে। অধিক হারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করিতে না পারিলে গ্রামের মানুষ ভিক্ষা করিতে হইলেও শহর ও রাজধানী মুখী হইবে। এখনো হইতেছে।

আমাদের এই এক জেনারেশনেই আমরা এত কিছু করিলাম। এত কিছু দেখিলাম। এত কিছু পাইলাম। হারাইলামও অনেক। রবীবাবু ত্যক্ত করিতেছে। তাহার কবিতার চরণ কন্ঠে গুন গুন করিয়া উঠিতেছে, “কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও, তারই রথ নিত্য উধাও, জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন, চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন, ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল- তুলে নিল দ্রুত রথে দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে তোমা হতে বহু দূরে। মনে হয় অজ¯্র্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম আজি নব প্রভাতের শিখর চূড়ায়, রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায় আমার পুরানো নাম, ফিরিবার পথ নাহি; দূর হতে যদি দেখ চাহি পারিবে না চিনিতে আমায়। হে বন্ধু, বিদায়”। কবিতাটা কতটা প্রাসঙ্গিক হইলো জানি না। তবে ইহার মর্মসূরটাই আসল। যে রথে আমরা চড়িয়া বসিয়াছি উহার জন্য যে সুগম্য পথ আবশ্যক উহা মেরামত-প্রস্তুত না করিয়া আমাদের এই সম্মুখ যাত্রা কতখানি উপকারি হইবে তাহাই প্রশ্ন। জানি ইহার উত্তর নাই, দিবার জন্য কাহারো আকুতিও নাই। তবে সংশয় জাগে এই ভাবিয়া যে, ইতিহাস বড় নির্মম। সাময়িক রাগ-অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হইয়া যে ইতিহাস রচনা করা হয় তাহা বর্তমানের কর্মকান্ড জায়েজ বা বাতিল করিবার জন্য। কিন্তু ইতিহাস লিখিবার দায়ভার যখন উত্তর প্রজন্মের হাতে পড়ে তখনই প্রকৃত সত্যটা বাহির হইয়া আসে। ইতিহাস কাহাকেও ক্ষমা করেনা এই প্রবচনের করাতকলের বলি একদিন যে আমাদেরকে হইতে হইবে ইহা আজ প্রবল সুখতাপে হয়ত গা করিতেছি না। যাহা কিছু করিতেছি তাহা আমাদের পুত্র-কন্যারা যাহাতে থাকে দুধে ভাতে, এই অজুহাতে। কিন্তু এই যুক্তি যতই জোরালোভাবে প্রক্ষিপ্ত করি না কেন এর দায়ভার যে একান্তভাবে আমাদের এই জেনারেশনের উপরই বর্তাইবে ইহা কোন রূপ ইন্ডেমনিটি দিয়া রোধ করিবার উপায় নাই। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমাদের জেনারেশনের যাহারাই নেতৃত্বের আসনে উপবিষ্ট থাকি না কেন এই সম্মুখ পথ গমনাগমন উপযোগী করিবার জন্য এখনো যথাযথ পরিকল্পনা ও একশন প্ল্যান প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং ইহার আশু মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি হইয়া পড়িয়াছে। বেটার লেট দেন নেভার।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম বেটার লেট দেন নেভার মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর