বিশ্বে প্রশ্নের মুখে খাদ্য নিরাপত্তা
১৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:৩০
একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো দেশের জন্যই প্রধান চ্যালেঞ্জিং বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশগুলো সমণ্বিতভাবে এ সমস্যা মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে কারণ পৃথিবীতে বহু নারী-পুরুষ ও শিশু অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাচ্ছে। এই সমস্যা আমাদের আগেও ছিল কিন্তু সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে। যুদ্ধ সবাই শেষ চাইলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো লক্ষণ নেই বিপরীতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের নতুন সৈন্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে বড় আকারের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এই অস্থির পরিস্থিতি তৈরির জন্য মানুষই দায়ী। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো যে মানুষগুলো এই সমস্যার তৈরি করেছে তারা কিন্তু খাদ্যের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে না। খাদ্যে যে মূল্যস্ফীতি ঘটছে তার জন্য স্বল্প, মধ্য ও ধনী দেশসহ সকলেই ঝুঁকিতে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয় প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে জুলাইয়ের শেষদিকে বাসমতি ছাড়া অন্য চালের রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত। এশিয়া ও সাব সাহারান আফ্রিকার দেশগুলো ভারতীয় চালের উপর নির্ভরশীল। এরই মধ্যে তাদের এ সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়েছে এবং ক্ষুধার আশঙ্কা বাড়ছে। খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থাপনার এ ভয়ানক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সব জিনিসপত্রের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষি উপকরণের দাম। বেড়েছে সার ও কীটনাশকের দাম। জ¦ালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে বৃদ্ধি পেয়েছে সরবরাহ খরচ। সবদিক থেকে ফসল উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশেই বেড়েছে খাদ্য পন্যের দাম। গত বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২১টি দেশ ৩০ ধরনের খাদ্য উপকরণ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু দেশ খাদ্য রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী খাদ্য শস্যের মূল্য ৮ শতাংশ বেড়েছে। একই সাথে রপ্তানি মূল্য সূচক কমেছে ২ শতাংশ। মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রথম হলো খাদ্য। বিশ্বজুড়েই খাদ্য সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। যদিও গত জুলাইয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন একটি সমঝোতায় পৌছালে খাদ্য সরবরাহ শুরু করে ইউক্রেন। এরপর বিশ্বে খাদ্যের বাজার একটু স্থিতিশীল হয়। এই দুই দেশ বিশ্বব্যাপী খাদ্যের ১০ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে। যুদ্ধের সাথে সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বের বৃহত্তম সয়াবিন রপ্তানিকারক ও শীর্ষ ভুট্রা উৎপাদনকারী দেশ আর্জেন্টিনা ৬০ বছরের মধ্যে চরম খরায় ভুগছে, ফলে এ দুটি শস্যের ফলনও তীব্রভাবে কমে গেছে। সয়াবিন উৎপাদনে শীর্ষ দেশ ব্রাজিলও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খরার কবলে পরেছে। এফএওর ২০২৩ সালের ষ্টেট অব ফুড ইনসিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ দশমিক ২ শতাংশ বা ৬৯ কোটি ১০ লাখ থেকে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। কানাডা ও ইউরোপে দাবানল, দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব আফ্রিকায় খরা, চীনে বন্যা ও ক্যালিফোর্নিয়ার শুষ্ক অংশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য সংকট আরো বেড়েছে।
আফ্রিকার দেশগুলোতে খাদ্যসংকট তীব্র হচ্ছে। এছাড়াও মূল্যস্ফীতি বাড়ায় উন্নত দেশগুলোতেও খাদ্যপণ্যের মূল্য রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানা যায়, জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি লিন্ডা টমাস গ্রিনফিল্ড এক তথ্যে জানিয়েছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধে বিশ^জুড়ে চরম খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে বিশ্বের ৪ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়েছে। তবে এ সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চল। ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনে তো মারাত্বক খাদ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ুর সাথে মানবসৃষ্ট পরিবেশ এর জন্য দায়ী। কম বৃষ্টিাতের ফলে নষ্ট হয়েছে সোমালিয়ার হাজার হাজার একর জমির ফসল। পানি ও খাদ্যশূন্য হয়ে মারা গেছে কৃষকদের গবাদিপশু। সম্প্রতি বিশ্বের দুই শতাধিক এনজিওর গবেষণা প্রতিবেদন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, বিশ্বে কেবল ক্ষুধার কারণেই প্রতি চার সেকেন্ডে একজন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিবৃতিতে এনজিওগুলো বলেছে, ৭৫টি দেশের বিভিন্ন সংগঠন আকাশচুম্বী ক্ষুধার মাত্রা এবং তা মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুপারিশ নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে। এতে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- বিশ্বের ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখন তীব্র ক্ষুধার্ত। আর ক্ষুধার্ত মানুষের এই সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একুশ শতকে বিশ্বে আর দুর্ভিক্ষ ঘটবে না বলে বিশ্ব নেতারা প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও সোমালিয়ায় আরও একবার দুর্ভিক্ষ আসন্ন। বিশ্বের ৪৫টি দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ অনাহারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। বিশ্বের দুই শতাধিক এনজিও’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন প্রায় ১৯ হাজার ৭০০ জন মানুষ ক্ষুধায় মারা যাচ্ছেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশ এবং এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও এই মন্দার পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। যুদ্ধের কারণে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে।
আমাদের হাতে যুদ্ধ বন্ধ করার বিকল্প নেই। অধিকাংশ মানুষের হাতে তা কেনার মতো অর্থও থাকছে না। এটা একটি মানবিক বিপর্যয়। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। যেখানে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর দারিদ্রতা একটি বড় সমস্যা। এই দারিদ্রতার কারণেই মূলত ক্রয়ক্ষমতা কমে এবং মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। করোনার ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কারণ দফায় দফায় লকডাউন থাকায় বন্ধ থেকেছে উৎপাদন কার্যক্রম। মানুষ কাজ হারিয়ে দরিদ্র হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে যখন ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা চলছিল সেই সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে এসেছে। একটি ধাক্কা সামাল দিতে না দিতেই আর একটি ধাক্কা মানুষের নাভিশ্বাস ফেলতে বাধ্য করছে। বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং প্রতিদিনের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের জীবনমান নিম্নমুখী হচ্ছে। আগামী কয়েকমাসে পৃথিবী একটি বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হওয়ার মতো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর কারণ হলো প্রথমত করোনার ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, করোনার শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং এর সাথে বহুদিন ধরে চলে আসা সমস্যাগুলো যেমন- বিভিন্ন দেশে দ্বন্দ্ব সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা এবং শরণার্থী সংকট। এখন এসব সমস্যা আরও বেশি তীব্র হওয়ার মুখে। কারণ বিভিন্ন দেশ খাদ্য সংকটের মুখে দাড়িয়ে। এর মধ্যে পৃথিবীজুড়েই তীব্র শরণার্থী সংকট চ্যালেঞ্জের মুখে দাড় করিয়েছে। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা দাড় করা কষ্টসাধ্য।
যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈষম্যের কারণে পৃথিবীতে দারিদ্রতা এবং খাদ্য সংকট তীব্র হচ্ছে। ভয়াবহভাবে দারিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসাথে পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। সেটা সামাল দেয়া বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জের। দারিদ্রতা, ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, রিজার্ভ কমে যাওয়া, খাদ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি, বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতি বিশ্ব অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন ভোগাবে। যদিও এর সাথে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন খরা, বন্যা ইত্যাদিও কম দায়ী নয়। টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি ঐক্যবদ্ধ পৃথিবী এই সময় অত্যন্ত জরুরি। আর তা সম্ভব না হলে সত্যি সত্যি এই পৃথিবীকে খাদ্য সংকটে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই