Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কোথাও কোনো সিন্ডিকেট নেই

আনোয়ার হাকিম
১৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:৫১

ইদানিং সিন্ডিকেট নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। আগেও হয়েছে। তবে কোন সময়েই এর ভেতরটা প্রস্ফুটিত হয়নি। সবাই কেবল উপর থেকে দেখেই হা হুতাশ করছে। ভাবটা এমন যে মামদো ভূত দেখেছে। সেই ভূতের আকার-আকৃতি কী রূপ তা কিন্তু আর কেউ বলে না। এমন একটা ভাব করে যে এই ভূত নিয়ে চিন্তা করলেও ঘাড় মটকে খাবে। অথচ সিন্ডিকেট একটি ভদ্র শব্দ। আমরাই একে ফষ্টিনষ্টি করে আজকের এই রূপ দিয়েছি।

সমাজ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী যে যাই বলুক সিন্ডিকেট এমন এক মোর্চা যেখানে কতিপয় মানুষ এক বা একাধিক সাধারণ বা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত মিলিত হয়। যেমন: বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। বাণিজ্যেও সিন্ডিকেট আছে। অন্য ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট হতে পারে। বস্তুত সিন্ডিকেট নিয়ে কোন সমস্যাই হত না যদি না এদের উৎপাতে জনজীবন অতীষ্ঠ হত। মানুষ প্রতিনিয়ত সিন্ডিকেট দেখছে। মানে এর আছর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। পাকিস্তান আমল থেকেই আমাদের এ ভূ-ভাগে একটা কথা হাস্যরসে চালু আছে। তা হলো বাঙ্গালীরে হাইকোর্ট দেখিও না। সেই হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্ট এখন আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। কিন্তু গেলো কয়েক বছর সিন্ডিকেটের উৎপাত এত সহ্য করছি যে এখন হাইকোর্ট দেখার মত প্রতিনিয়ত সিন্ডিকেটও দেখছি।

বিজ্ঞাপন

ইদানীং আরেকটা টার্ম বেশ চাউর হয়েছে। তা হলো অলিগার্কি। বিশেষজ্ঞরা বলতে চাইছেন সিন্ডিকেট এখন আরো শক্তিশালী হয়ে অলিগার্কিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই অলিগার্কিটা কী? এটি ক্ষমতার এমন একটি কাঠামো যেখানে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। বংশমর্যাদা, সম্পদ, পারিবারিক ঐতিহ্য, শিক্ষা, ব্যবসা অথবা গায়েবী ক্ষমতাপুষ্ট হয়ে সীমিত কিছু পরিবার জবাবদিহিতার উর্ধে উঠে অর্থনীতির উপর নিজেদের ক্ষমতা নিরংকুশ করে থাকে। আমরা আম পাবলিক সনাতনী সেই সিন্ডিকেটকেই বুঝে থাকি। অলিগার্কি বা সিন্ডিকেট যা-ই হোক এদের অস্তিত্ব নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। পরিকল্পনা মন্ত্রী কিছুদিন আগেই বলেছেন সিন্ডিকেটকে নাকি সনাক্ত করা যাচ্ছে না। সনাক্ত করা গেলে আইনের আওতায় আনা যেত। বাণিজ্য মন্ত্রী মাঝে মধ্যে হলুদ কার্ড, লাল কার্ড দেখান। এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। সিন্ডিকেটের আছর আগের চেয়ে এখন আরো প্রবল ও বেপোরোয়া হয়েছে। নিন্দুকেরা এর মধ্যে অলিগার্কির আছর খুঁজে পাচ্ছেন। মিডিয়া মাঝেমধ্যে বাজার পরিস্থিতি গরম হলে কিছু নিউজ ছাপে। সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব তালাশ করে। পাবলিকও বুঝে কারা তলে তলে এর মধ্যে ব্যাট হাতে চার-ছয় হাঁকাচ্ছে। কিন্তু তাতে বাজার না হচ্ছে নরম না হচ্ছে সহনীয়। বাজারে পণ্য আছে প্রচুর কিন্তু পণ্যমূল্যের লাফালাফি কমছে না। পাবলিকের খরচের ফর্দ্দ কেবলই বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় আয়ের খাত স্থির। নিম্নবিত্ত কী ভাবে টিকে আছে তা গবেষণার বিষয়। তবে মধ্যবিত্ত যে পুষ্টির ক্রাইসিসে কাতর তা বিলক্ষণ টের পাওয়া যাচ্ছে। ইংরেজিতে জাগলারিং বলে একটা শব্দ চালু আছে। বাংলায় একেই কি শুভংকরের ফাঁকি বলে? বাজার নিয়ে কথা বললে বিশ্ব বাজারের পরিসংখ্যান শোনানো হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা শোনানো হয়। পাবলিক সব শুনে, সব বুঝে, সব দেখে কিন্তু বলার কিছু নেই। গত কয়েক বছর নিত্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের মূল্য এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যা বাজার ব্যবস্থার স্বাভাবিক উঠানামার চেয়েও অস্বাভাবিক। মনে হয় কিছু লোক বছরের শুরুতেই পঞ্জিকা নিয়ে বসে। কখন কোন পণ্যের মূল্য কী উছিলায় বাড়াবে? কখনো এই কোপ গিয়ে পড়ে সয়াবিনে, কখনো পিঁয়াজে, কখনো চিনিতে, কখনো আদাতে। এরকম আরো আরো পণ্যে। যেমন এখন ডিম নিয়ে। এ নিয়ে হাসাহাসিও কম হচ্ছে না। ডিম আমদানি করার মত ব্যবস্থাও করতে হয়েছে সরকারকে। এর পরেও বাজারের অবস্থা পূর্ববৎ। আমদানী চালান আসার পর এর অবস্থা কি হয় তা দেখা যাবে। সরকার খুব শীঘই নির্ধারিত মূল্যে ডিম বিক্রি শুরু করবে। প্রায় সব নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সিন্ডিকেট দাম বাড়ালেও বেচারা লবন সিন্ডিকেট দাম বাড়াবার প্রয়াস নিয়েছিলো। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক তাদের সে প্রয়াস ব্যর্থ হয়। সম্ভবত লবন সিন্ডিকেট এখনো অলিগার্কিতে রূপান্তরিত হতে পারেনি।

বিজ্ঞাপন

পণ্যমূল্যের পেষণে পাবলিকের হাপিত্যেশ অবস্থা দেখে মিডিয়া সরব হলে সরকার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে আমদানীর ব্যবস্থা করে বাজারে যোগান পরিস্থিতি বৃদ্ধি করে থাকে। কখনো মূল্য-ভর্তুকি প্রদান করে শান্তকরণে উদ্যোগ নিয়ে থাকে। কিন্তু এর অন্তর্গত কারুকাজে হাত পড়ে না। প্রতিটি আমদানী নির্ভর নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের খাতে চার-পাঁচজনের এক একটি সিন্ডিকেটের নাম শোনা যায়। তারাই এর নিয়ন্ত্রক। মিডিয়ায় এদের নাম এলেও এদের যেমন কোন বিকার নেই, তেমনি এদের নিয়েও প্রশাসনিক ভাবে কোন চর্চ্চা হয় না। উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে পণ্য আমদানীর ক্ষেত্রে এই ধরণের গুটিকয়েকের সংঘকে কেন আরো বিস্তৃত করা যায় না, এ ক্ষেত্রে আইনের সীমাবদ্ধতা আছে কি না, সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট আন্তরিক উদ্যোগ আছে কি না তা জানা যায় না। তবে এই সব সিন্ডিকেটের আছর যে ক্রমাগত বাড়ছে তা শুধু অনুভবই করা যাচ্ছে না, দৃশ্যমানও হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে বাইশ পরিবার কতৃক সর্বস্ব ভোগের কাহিনী বহুল প্রচারিত ছিলো। আজ এর সংখ্যা লক্ষাধিক কী না তা কেউই বলতে পারে না। বলাবাহুল্য এদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে ব্যাংক, বীমা, আমদানী-রপ্তানী, উৎপাদন- বিপণন, মিডিয়া, এলিট ক্লাব, পুরষ্কার-সম্মাননা ইত্যাদি। এর সাথে রাজনীতর সংশ্লিষ্টতা থাকলে তা যেন সোনার বাতাবরণ। এরূপ চেহারাকেই কি অলিগার্কি বলে?

বিশ্ব পরিস্থিতি আজ রণোম্মুখ। তাই পণ্যের আমদানী-রপ্তানী ফাঁক অনস্বীকার্য। আমাদের মত আমদানি নির্ভর অর্থনীতির দেশ সমূহের শেষ ভরসা স্থল সরকার এবং তার আর্থিক ও বাজার ব্যবস্থাপনা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে বাজারের এই দশা এত মর্মান্তিক হতে পারে না। নাকি প্রশাসন যন্ত্রও অলিগার্কির এক্সটেন্ডেড ফিল্ড? সিন্ডিকেট আছে কি নেই, এর মধ্যে অলিগার্কির দৈত্যের দল লেপ্টে আছে কি না পাবলিক এতশত বুঝে না। পাবলিক চায় স্বস্তি, শান্তি। মোটা কাপড়, মোটা ভাত। এর দায়িত্ব সরকারের।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এজেডএস

আনোয়ার হাকিম কোথাও কোন সিন্ডিকেট নেই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর