বিশিষ্টদের ভীড়ে উচ্ছিষ্টদের দশা
৩০ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৩৭
আজকাল বিশিষ্টদের উৎপাতে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কেউ আর সাধারণ থাকতে চাচ্ছে না। হয় বিশিষ্ট না হয় উচ্ছিষ্ট এই দুই শ্রেণীতে রাস্ট্রের জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মানে আমরাই এভাবে বিভাজন করে নিয়েছি। যারা অসাধারণ তারা বিশিষ্ট। আর যারা অনুল্লেখযোগ্য তারাই উচ্ছিষ্ট। সমাজ এভাবে তার জনগণকে দেখতে চায় না। কিন্তু চোখে আংগুল দিয়ে আজ তাই-ই দেখানো হচ্ছে। বিশিষ্টদের ভীড়ে অন্যরা আজ বড় বেশি ম্লান। তাদের দাপটে ও ঠমকে অন্যরা হতকচিত।
বিশিষ্ট হওয়ার বাসনা মানুষের সহজাত। সাধারণের মাঝে যিনি তার স্বীয় প্রতিভা ও কর্মগুণে অনন্য হয়ে উঠেন তিনিই ‘বিশিষ্ট’ আখ্যা পেয়ে থাকেন। এতকাল এরূপই জেনে এসেছি। দেখেও এসেছি। দ্রুত পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই ভিন্নরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। সেটা উন্নয়ন আর প্রগতির পক্ষে সহায়ক। কিন্তু আমাদের দেশে ইদানীং বিশিষ্ট পদবাচ্যে যা কিছু হচ্ছে তা রীতিমত হাস্যকর, লজ্জাজনক ও অন্যায্য।
এবার প্রসঙ্গে আসি। এ দেশে আজ জলস্ফীতির মত ধাই ধাই করে বাড়ছে বিশিষ্টদের সংখ্যা। রাজনীতি দিয়েই শুরু করা যাক। এখানে কর্মীর চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি। শিক্ষানবিশ কাল কাটতে না কাটতেই উর্ধতন নেতা আর লবিংয়ের জোরে কর্মীদের মধ্য থেকে অনেকেই নেতা হয়ে যাচ্ছে রাতারাতি। এখানে যোগ্যতার মাপকাঠি অন্ধ আনুগত্য, স্বজন তোষণ আর দুর্জন পোষণ। এদের মধ্য থেকে হঠাৎ করেই কেউ কেউ বিশিষ্ট হয়ে উঠছেন। এদের এই উর্ধগমন পথ মোটেই মসৃণ না। এখানেও উপরের কারো কালো হাত ক্রেণের মত কাজ করে থাকে। এভাবেই রাজনীতির ময়দান আজ মাসল, মানি আর বেপোরোয়া বিশিষ্টজনদের দখলে। যারা সত্যিকার অর্থেই শিষ্ট তাদের জায়গা নেই, সুবিধা নেই, উন্নতি নেই। ফলত: রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম, হাস্যরস বেশি। আজকাল টিকটকের ছড়াছড়ি। মানুষকে এখন আর কষ্ট করে খুঁজে খুঁজে টিকটক রীল দেখতে হয় না। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের বচন আর অঙ্গভঙ্গি দেখলেই অফুরান আনন্দ মেলে।
ব্যাবসা-বাণিজ্য একটা দেশের মূল চালিকা শক্তি। সেখানেও বিশিষ্টদের উৎপাত দৃশ্যমান। বনেদী, খানদানি ব্যাবসায়ীরা আগে রাজনীতির ধারেকাছেও ঘেঁষতেন না। কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া ভালো ও বনেদী ব্যাবসায়ীরা এখনো সেপথে পা মাড়ান না। ভয়ে বা চাপে বা চক্ষুলজ্জায় বা সামাজিক-আত্মিক সম্পর্ক রক্ষার খাতিরে রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন গুলোকে বা তদসংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গকে অর্থযোগে সহায়তা করে থাকেন। এখনো তাই করে থাকেন। কিন্তু এখন এদের সংগঠনের শীর্ষ পদে বা কমিটিতে ঠাঁই পেতে রীতিমত প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপ, অর্থব্যয় আর তয়-তদবির অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কমিটিতে থাকলে কী লাভ তা তারাই ভালো জানে। পরজীবি লতার কোন মেহনত নেই। মূল শক্তপোক্ত কান্ডকে ঘিরে জড়িয়ে থেকে সে সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে। এভাবেই ব্যাবসায়ে ‘বিশিষ্ট’ জনদের দাপট ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। এতে করে বাজারে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিদ্যমান, পণের চাহিদা ও যোগানের সাধারণ অর্থনীতি তারা অসাধারণ করে তুলতে সমর্থ হয়েছে। ঐশ্বরিক আশীর্বাদে এরা এতই ধন্য যে কেউ তাদের পাশা খেলা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কিছুই করতে পারে না।
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও হাজার হাজার ‘বিশিষ্ট’ জনের দেখা মেলে। প্রকৃৃত বুদ্ধিজীবী হলে আশার কথা ছিলো। সাধারণ মানুষের কাছে এরা বিবৃতিজীবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। কেউ কেউ এদের কৃতকর্ম দেখে তাদেরকে শিক্ষিত কানা পারিষদ বলে অভিহিত করে থাকে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে এদের এককালীন অবদানের পর আর কোন সৃজনশীলতা চাক্ষুষমান হয় না। মাঝেমধ্যে এদের দেওয়া বিবৃতি তথা সাফাই সাক্ষ্য দেখে পাবলিক হাসাহাসি করে আর মনে মনে ভর্ৎসনা করে। এরা নিজেদেরকে জাতির বিবেক হিসেবে তুলে ধরলেও বাণিজ্যের দাপটে ও পদ-পদবীর ঔজ্জ্বল্যে পো ধরে ধরে উন্নতির উচ্চ উচ্চ সোপানে আরোহনের মতলবে সময়ান্তরে বিষয় ভিত্তিক জায়েজ সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। অথচ শিক্ষিত সমাজের সত্যিকার বাতিঘর যারা তারা আজ বাতি নিভিয়ে নিভৃতচারী জীবনযাপন করছেন। তাদের কন্ঠ লঘু হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বাক্যব্যয় করতেও কুন্ঠিত। আর এভাবেই জাতি ‘বিশিষ্ট’ বুদ্ধিজীবীদের প্রদানকৃত জায়েজ সার্টিফিকেট দেখে দেখে বৃষ্টি অনুযায়ী ছাতা ধরার কলাকৌশল রপ্ত করছে।
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গণে এখন বিশিষ্টদের ছড়াছড়ি। এদের সংগঠন, এদের নড়াচড়া, পদ-পদবী প্রাপ্তি, পুরষ্কারের তোফা সবই মৌচাক কেন্দ্রিক। সাংস্কৃতিক অঙ্গণেও অযোগ্য বা তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম সারির বিশিষ্টদের সমাসীন হতে দেখে সৃজনশীলতা বিদায় নিয়েছে। কে কার আত্মীয়, কে কার বশংবদ, কার সাথে কার কোথায় গাঁটছড়া বাধা তা বুঝতে কষ্ট হয় না। জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্তদের চেহারা তো দূরের কথা তাদের নাম নিশানা পর্যন্তও কেউ আগে শুনে নি। বহু হাতের সুপারিশ ধন্য হয়ে তাদের গলায় বিশিষ্ট তকমা শোভা পাচ্ছে। শিল্পকলার কোন শাখাতেই উল্লেখযোগ্য কোন সৃষ্টি নেই। দুর্জনের পৃষ্ঠপোষকতায় নব্য সাংস্কৃতিক বিশিষ্টদের উত্থান-জ্বরে কাঁপছে আমাদের সাংস্কৃতিক জগৎ। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বুঝা যাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই।
পেশাজীবীদের সংগঠনেও চলেছে ‘বিশিষ্ট’ জন উৎপাদনের মিছিল। সংগঠনের অন্ত: ও আন্ত: হাতের ছোঁয়ায় রাতারাতি বিশিষ্ট হয়ে উঠছেন কেউ কেউ। এদের নেই কোন নেতৃত্বের যোগ্যতা, নেই কোন নীতি-নৈতিকতা বোধ। আছে অদৃশ্য কারিগরের সূতোর বাঁধন। যেমনি নাচায় তেমনি নাচে পুতুলের কি দোষ!
সরকারি দপ্তরে অঘোষিত বিশিষ্ট আধিকারিকদের ক্ষমতা লেজার বীম সম। তাদের বাইরে কারো কোন পদ পাওয়ার জো নেই, পদোন্নতি দূরস্ত তাদের মানভঞ্জন ছাড়া। পদায়নের জন্য দরকার তাদের ছাড়পত্র। এই বিশিষ্টদের বিষয়ে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। যুক্তি দেখানো যাবে না। দ্বিমত পোষণকে ধৃষ্টতার শামিল বলে গন্য করা হবে।
এই ভাবে ক্ষেত্রওয়ারি নব্য বিশিষ্টজনেরা হয়ে উঠছে মনুষ্য সৃষ্ট উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কপুঞ্জ। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া সাধারণের করার বা বলার কিছু নেই। এদের বাইরে যারা আছে তারা সবাই উচ্ছিষ্ট। কবে যে এই সব মনুষ্য সৃষ্ট উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কপুঞ্জ হাওয়া হয়ে যাবে। তার জায়গায় কবে যে প্রকৃৃত জ্যোতিষ্কপুঞ্জের উদয় হবে কে জানে! ভাবিয়ে তোলা এইসব ‘বিশিষ্ট’ জনদের নিয়ে কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা দরকার। শুভস্য শীঘ্রম।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা