Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অর্থনীতি এবং বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভুটানের নতুন সরকার

অলোক আচার্য
১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:৫৯

ভুটানের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে জয় পেল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি)। পার্লামেন্টের দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয় পেয়েছে দলটি। পিডিপি’র শীর্ষ নেতা ৫৮ বছর বয়সী শেরিং তোবগে একাধারে রাজনীতিবিদ, পরিবেশ আন্দোলন নেতা এবং আইনজীবী হিমালয় কোলের দেশটির প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। এর আগে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। দেশটির ইলেকশন কমিশন জানিয়েছে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৪৭টি আসনের ৩০টিতে জয় পেয়েছে পিডিপি। বাকি ১৭টি আসনে জিতেছে ভুটান তেন্দ্রেল পার্টি। কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এবং তার দল দ্রুক নিয়ামরুপ শোগপা কোনো আসন পায়নি। ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্র থেকে ২০০৮ সালে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রবেশের পর বুধবার চতুর্থ পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল দেশটিতে। ভারত এবং ভুটান দুই দেশই দক্ষিণ এশিয়ার এবং সার্কের সদস্য রাষ্ট্র। হিমালয় ঘেরা পর্যটনের চমৎকার একটি দেশ হলো ভুটান। চীন ও ভারতের মাঝামাঝি অবস্থিত ঐতিহ্যগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট রাজতান্ত্রিক দেশ ভুটান। যদিও এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করেছে দেশটি। ভুটান নাম হলেও স্থানীয়দের কাছে ‘ড্রাক ইয়ুল’ নামে পরিচিত দেশটি। ‘ড্রাক ইয়ুল’ অর্থ, ‘বজ্র ড্রাগনের দেশ’। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ৪৬ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটারের দেশ ভুটান ১৯০৭ সাল থেকে দেশটির রাজতন্ত্রে ওয়াংচুক বংশ ক্ষমতায় রয়েছে। ভুটানের মূল আকর্ষণ দেশটির পর্যটন। আমাদের স্বাধীনতার সাথেও দেশটির সম্পর্ক রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে দেশটি। সেই কারণে দেশটি বাংলাদেশের বন্ধু প্রতীম দেশ। ভুটান হলো সেই দেশ যা বরাবরই স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। বিশ্বে যা হাতে গোণা। ভুটানকে জয় করা, দখল করা বা বাইরের কারও দ্বারা শাসন করা কখনো সম্ভব হয়নি (তবে সাময়িক উপজাতীয় শাসন ব্যতীত)। ৭ম থেকে ৯ম শতাব্দীতে কামরুপ রাজত্ব বা তিব্বতীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল এমন ধারণা থাকলেও তা পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে কখনো প্রমাণ করা যায়নি। ঐতিহাসিক বিবরণে এটা স্পষ্ট যে, ভুটান ক্রমাগতভাবে এবং সফলভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে চলেছে। ভুটানের একত্রীকরণ ঘটে ১৬১৬ সালে যখন পশ্চিমা তিব্বতের গায়াঙ নামগিয়াল নামক একজন লামা যিনি কিনা ঝাবধ্রুং রিনপোচে নামেও পরিচিত, প্রতিদ্বন্দী ধর্মীয় বিদ্যালয়গুলোকে পরাস্ত করে, ধমীয় আইন ব্যবস্থার প্রয়োগ করে সাংস্কৃতিক ও নাগরিক প্রশাসক পদ্ধতি সমর্থিত একজন শাসক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার মৃত্যুর পর, পরবর্তী ২০০ বছরের জন্য ঝাবধ্রুনের সাম্রাজ্য গৃহযুদ্ধের পাকে পড়ে বিধ্বস্ত হয়। ১৮৮৫ সালে উজিয়েন ওয়াংচুক ক্ষমতা দখলে সক্ষম হন এবং উপমহাদেশে ব্রিটিশদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

এই ছোট রাষ্ট্রটির সাথে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট। সুতরাং বলা যায় এই দুই দেশের সম্পর্কে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেও কোনো নেতাই ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারে না। ভারতের সাথে ভুটানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ভুটানের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভারতের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমান প্রার্থীরাও ক্ষমতায় এসে ভারতের সাথে এই সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে বলা যায় এতদিনে ভারতের সাথেই ভুটানের সম্পর্ক যথেষ্ট জোরালো। কিন্তু এই সম্পর্ক মালদ্বীপের সাথে ভারতের ছিল। সেখানে এখন মালদ্বীপের নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে ভারতের চেয়ে চীনকেই গুরুত্ব দিয়েছে। চীন বিভিন্ন দেশে যে বিপুল অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে বা করেছে তা অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। ভুটান নিয়ে এত আলোচনার কারণ হলো এই ছোট রাষ্ট্রটিতে সম্প্রতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এই নির্বাচন ঘিরে দুই পরাশক্তি এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীন এক ধরনের ঠান্ডা লড়াই চলেছে যা গত কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চীন গত কয়েক বছরে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং তার ক্ষমতার বলয় সম্প্রসারণ করছে। অভিযোগ আছে, এক মাসেরও কম সময় আগের স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, উত্তর-পূর্ব ভুটানে অবৈধভাবে জমি দখল ও স্থাপনা নির্মাণে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে চীন। এই এলাকায় ভুটানের রাজপরিবারে ভিটেও রয়েছে। ভুটানের বেউল খেনপাজংয়ে নদী তীবরর্তী এলাকায় শহরায়ন করা হচ্ছে। উপগ্রহচিত্রে দেখা গেছে, ভুটানের যে অংশে চীন জমি দখল করছে, সেখান থেকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। ১৯৯৮ সালে জাকারলুংসহ একাধিক বিতর্কিত এলাকার মর্যাদা প্রসঙ্গে চীন ও ভুটানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে। সেখানে ভুটানে হস্তক্ষেপ না করতে রাজি হয় চীন। কিন্তু ওই চুক্তিকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে ভারতের উদ্বেগ থাকার কথা। চীনের ক্রমাগত সম্প্রসারণ নীতি নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন এবং এ কারণেই। এর আগেও ভুটানে চীনা গ্রাম তৈরির অভিযোগ উঠেছিল। চীন ও ভারতের মধ্যে ২০১৭ সালে তিন দেশের সীমান্ত ডোকলাম মালভূমির দিকে চীনা সৈন্যরা অগ্রসর হলে দুই দেশের মধ্যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। দুই দেশের মাঝখানে ভুটানের সীমান্ত সেকারণেই গুরুত্বপূর্ণ।

সে কারণেই এই দেশটির নির্বাচন নিয়ে অন্তত এই অঞ্চলে আগ্রহ রয়েছে। এই নির্বাচন ঘিরে ভুটানের ওপর নজর রাখছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীন। হিমালয়ের অঞ্চলের দেশটি নিয়ে চীন-ভারতের এই দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ার মতো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সীমান্তে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান ও প্রভাব বাড়াতে ভারত ও চীন ভুটানকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। এরপর আবার গত অক্টোবরে ভুটান ও চীনের মধ্যে একটি ‘সহযোগিতা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাদের এ চুক্তি ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে ভুটানকে ‘বাফার স্টেট হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। যদিও ভুটানের সাথে কৌশলগত বা ঐতিহ্যগত কারণেই ভারতের সম্পর্ক এবং প্রভাব রয়েছে। কিন্তু চীনা সম্পসারণ নিয়ে ভারত বরাবরই উদ্বিগ্ন। দেশটিতে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে ভারত ও বিপরীতে চীন দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারত বিশ্বের উঠতি পরাশক্তি এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে যাওয়া দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তিগুলোর এবং বিশ্বে ভারতের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ায় উঠতি দুই পরাশক্তি হিসেবে ভারত ও চীনকে বিবেচনা করা হয়। এই কারণেই দেশ দুটির মধ্যে রয়েছে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগীতা। যে প্রতিযোগীতা অন্যান্য দেশেও প্রভাব বিস্তার করে। নির্বাচনের আগে থেকেই আলোচনা হচ্ছিল এই নির্বাচনে ভারত ও চীনের পরোক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীতা রয়েছে। যা এক ধরনের ঠান্ডা লড়াই। বিভিন্ন দেশ এখন ভৌগলিক কারণেই পরাশক্তিগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভূরাজনীতিতে এখন সম্ভবত কোনো দেশই পিছিয়ে নেই এবং সময়ের পালাক্রমে কোনো দেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে কারনে ভুটানের মতো আয়তনে ছোট একটি দেশও পরাশক্তির প্রতিযোগীতার কারণ হয়ে ওঠে। সেখানে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে পরাশক্তিগুলো। রাজতন্ত্র থেকে মাত্র কিছুদিন আগে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হওয়া ভুটানের নির্বাচনে দেশটির জনগণেরও আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটার প্রত্যাশা রয়েছে।

২০০৭ সাল থেকে ভুটানে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হয়। ২০০৮ ও ২০১৩ সালে দুটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভুটানে বর্তমান জনসংখ্যা ৮ লক্ষ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে মধ্য বামপন্থি পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) ও ভুটান টেনড্রেল পার্টি। দেশটিতে বর্তমানে বেকারত্ব ও দারিদ্রতা ঘিরে ধরেছে। তরুণরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। গত কয়েক বছরে উচ্চশিক্ষা ও আর্থিক সুবিধার সন্ধানে ভুটানের রেকর্ডসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠী বিদেশে চলে গেছে। বিশেষ করে, অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন দেশটির বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণী। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, ভুটানে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়ে ২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে প্রতি ৮ জনের ১ জন খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। আর তার মধ্যেই গণহারে দেশত্যাগ ভুটানের জন্য আরও ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি করতে পারে। ভুটানে যে দলই ক্ষমতায় আসুক তাকে ভারতকে প্রাধান্য দিতেই হবে। ভারতই তাদের অগ্রাধিকার। তবে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রসর হলে বা কোনো চুক্তিতে উপনীত হলে তা গুরত্ব বহন করবে। তবে নিজ দেশের সমস্যা যেমন দারিদ্রতা ও বেকারত্বের মতো সমস্যাগুলিকে মোকাবেলা করা সবার আগে দরকার।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অর্থনীতি এবং বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভুটানের নতুন সরকার অলোক আচার্য মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর