পরিযায়ী পাখিকে নিরাপদ রাখুন
১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:১৪
গত ৬ জানুয়ারী, এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরের নাগুয়া ও চাতলা বিলে বিষটোপে ২৭টি পরিযায়ী পাখি হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয় জেলেরা জানান, এক শ্রেণির অসাধু লোক এভাবে গোপনে বিষটোপের মাধ্যমে হাঁস মেরে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে। যদিও জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখি শিকারে সরকারের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি জলাভূমিগুলোকে পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, তবু সেসব এলাকায় পাখি হত্যা চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
অতিথি পাখির জীবনযাপন ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ ও সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে। বন-জঙ্গল কেটে উজাড় করে ফেলায় পাখিরা হারাচ্ছে তাদের বিচরণ ভূমি ও নিরাপদ আশ্রয়। ফসলি জমিতে কৃত্রিম সার ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বিষে আক্রান্ত কীটপতঙ্গ খেয়ে তারা মারা যাচ্ছে। অনেকেই গুলি করে, বিষটোপ ব্যবহার করে, জাল পেতে পাখি শিকার করছে। যে পাখিগুলো শুধু শীত থেকে রক্ষা পেতে ও খাদ্যের সন্ধানে আমাদের দেশে আসে, তাদের রসনা তৃপ্তির জন্য শিকার করছি আমরা। অথচ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর ধারা ৩৮(১) অনুযায়ী, (অতিথি পাখি) পাখি হত্যার দায়ে একজন অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু এ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে এই মৌসুমে পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। পেশাদার ছাড়াও অনেক শৌখিন শিকারি পরিযায়ী পাখি শিকারের মহড়া দেন। এতে প্রতিদিনই শত শত পরিযায়ী পাখি মারা পড়ছে। ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। নিরাপত্তার জন্য এ দেশে এসে অতিথি পাখির নির্বিচার শিকারে পরিণত হওয়ার ঘটনা নিতান্ত পীড়াদায়ক।
পাখি প্রকৃতি ও পরিবেশের বন্ধু। মানুষের মনের আনন্দ ও প্রফুল্লতার খোরাক জোগানো ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অতিথি পাখির অবদান রয়েছে। প্রতিবছর উত্তর গোলার্ধের শীত প্রধান দেশ সাইব্রেরিয়া, মঙ্গোলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিযায়ী পাখি আসে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাসে সব থেকে বেশি পাখি আসে এ দেশে। অতিথি পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখরিত থাকে বাংলার প্রকৃতি। এক মোহনীয় রূপ ধারণ করে বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চলগুলো। এ পাখিগুলো শুধু জলাশয়ের সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে কৃষকের ফসল রক্ষা করে। পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। পাখির মল জমির উর্বরতা বাড়িয়ে গাছপালা দ্রুত বর্ধনে সহায়তা করে। ফুল থেকে ফলে রূপান্তরে পাখির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পাখির মলের সঙ্গে বের হওয়া বীচি জনমানবহীন দুর্গম অঞ্চলে বনায়নে ভূমিকা রাখে।
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা সহ মানুষের মনে আনন্দ ও প্রফুল্লতার খোরাক জোগাতে তাই অতিথি পাখি শিকার রোধে স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, আইনের সুষ্ঠু প্রায়োগিক দিক নিশ্চিত করতে হবে । সেই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনকেও তৎপর থাকতে হবে। কারণ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিযায়ী পাখি ধরা হয়। জায়গাগুলো দুর্গম। খবর পেয়ে পুলিশ যেতে যেতে শিকারীরা পালিয়ে যায়। এ জন্য যেসব জায়গায় পরিযায়ী পাখি ধরা হয়; সেসব জায়গার সচেতন নাগরিকদেরই ব্যবস্থা নিতে হবে। তারাই গড়ে তুলতে পারেন পাখির শিকার বন্ধে কঠোর আন্দোলন। স্থানীয় পরিবেশবাদী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে। কমিটি গঠন করে কাজ করতে পারে। নিতে পারে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা। শুধু পুলিশের পক্ষে শিকার ঠেকানো সম্ভব নয়। পরিযায়ী পাখির নিরাপত্তায় সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলে সফলতা আসবে কমই। পাখি শিকার বন্ধের জন্য পরিবেশবাদী স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে, যে এলাকায় অতিথি পাখির পদচারণা ঘটে সে এলাকায় আরও বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। পাখি শিকারিদের তাদের নামের তালিকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করতে হবে। শুধুমাত্র প্রশাসনের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। সাধারণ জনগণের সচেতনতাই এ উদ্যোগ সফলতার আলো দেখতে পারে। তাই, এ উদ্যোগকে কার্যকর ও সফল করতে সরকার, পরিবেশবাদী সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী-জনগণ এই ত্রিমুখী আন্তরিকতা দরকার।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই