Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খানা আয়ব্যয় জরিপ ২০২২: দারিদ্র্য বৈষম্য প্রসঙ্গ

ড. মিহির কুমার রায়
২২ জানুয়ারি ২০২৪ ১৬:২০

গত ১৫ বছরে বদলে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক সব সূচক যেখানে দারিদ্র্য বৈষম্য বিশেষ আলোচনার স্থান করে নিয়েছে। দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, অতি দারিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নেমে এসেছে সত্যি কিন্তু ধনী গরীবের বৈষম্য এমন মাত্রায় বেড়ে গেছে (গিনি সহগ ০.৪৯) যা বিশ্বের প্রথম স্থান করে নিয়েছে। এরই মধ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে যাদের স্লোগান হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’- উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ যথা ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’ গড়ার কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট ১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে যেমন মূল্যস্ফীতি, কর্মসংন্থান, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভরতা, কৃষি ব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণ সর্বজনীন পেনশন, দারিদ্র্যের বিমোচন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ইত্যাদি। কিন্তু আয়-বৈষম্য যে বেড়ে গেল,গ্রামের মানুষ কষ্ঠে আছে তার সুরাহা কিভাবে হবে তার আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক বলে প্রতিয়মান হয় ।কারন আমাদের মাথাপিছু আয় ৫৪৩ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৭৯৩ ডলার, বাজেটের আকার ৬১ হাজার কোটি থেকে ৭ লক্ষ ৬১ হাজার কোটি,জিডিপির আকার বেড়েছে ১২ গুণ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বেড়েছে ১৩ গুণ, রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫ গুণ। তার পরও কেন সমাজে কেন এত অসঙ্গতি তা নিয়ে ভাবনার শেষ নেই।

বিজ্ঞাপন

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) খানা আয়ব্যয় জরিপ-২০২২এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য, সেই সঙ্গে গ্রামে বেড়েছে মানুষের খরচ, পাশাপাশি বেড়ে গেছে পরিবারভিত্তিক ঋণ গ্রহণও। এছাড়া ঋণ করে সংসার চালায় দেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ। একটি পরিবারের ঋণ ৭৩ হাজার ৯৮০ এবং মাথাপিছু ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলোর ঋণ ২১০ শতাংশ বেশি। এছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাও বেশি। পাশাপাশি ভাত খাওয়া কমেছে, বেড়েছে অন্যান্য খাদ্য গ্রহণ। প্রতিবেদনে আারও বলা হয়েছে, দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। এর মধ্যে পল্লি অঞ্চলে ২০ দশমিক ৫ এবং শহরে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। তবে ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ এবং ২০১০ সালের হিসাবে ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে দেশে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। এছাড়া অতিদারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। এক্ষেত্রে পল্লি এলাকায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এদিকে ২০২২ সালের হিসাবে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। যেটি গিনি সহগের মান (বিশ্বব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি) শূন্য দশমিক ৪৯৯, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২। ২০১০ সালে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৮। অন্যদিকে বেড়েছে ভোগবৈষম্যও। ২০২২ সালের হিসাবে ভোগব্যয়ের জন্য গিনি সহগের মান শূন্য ৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৩২৪। তবে ২০১০ সালে এটি ছিল শূন্য দশমিক ৩২১। এছাড়া দেশের সর্বোচ্চ ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ। অপরদিকে সর্বনিুে¤œ থাকা ৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় মোট আয়ের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। এখানে স্পষ্ট হয়েছে যে, ধনীদের আয় বাড়ছে উচ্চহারে আর গরিবদের বাড়ছে ধীরে। এ দুই অংশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিরাজ করছে। (বিবিএস)’ প্রতিবেদনের তথ্য থেকে আরও দেখা যাচ্ছে, দেশের সর্বাধিক দারিদ্র্যপীড়িত বিভাগ এখন বরিশাল, যেখানে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ; অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে সেখানে এই হার দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। ছয় বছরে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে সিলেট বিভাগেও। আগে কুড়িগ্রামে সর্বোচ্চ দরিদ্র মানুষের বাস থাকলেও এবার উঠে এসেছে বরিশালে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। রংপুর থেকে এখন দারিদ্র্য বরিশালে গেছে। একসময় রংপুর বিভাগের মানুষ বেশি গরিব ছিল। দারিদ্র্যের হারও ওই অঞ্চলে বেশি ছিল। এখন দেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার বরিশাল বিভাগে। বরিশাল অঞ্চলটি শস্যভান্ডার হিসাবে পরিচিত। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালে জাতীয়ভাবে প্রতিটি পরিবারের গড় ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। গড়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ দশমিক ২৬ ধরে মাথাপিছু ঋণ দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০২৬ সালে জরিপে ছিল পরিবারপ্রতি ঋণের পরিমাণ ৩৭ হাজার ২৪৩ টাকা। মাথাপিছু ঋণ ছিল ৯ হাজার ১৭৩ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে প্রতিটি পরিবারের ঋণ বেড়েছে ১১১ দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারের ঋণ বেড়েছে। ২০২২ সালের হিসাবে গ্রামে পরিবারপ্রতি ঋণ ৪৪ হাজার ৪১১ টাকা, সেখানে শহরে পরিবারপ্রতি গড় ঋণ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৫৬ টাকা। এটি গ্রামের তুলনায় তিনগুণ বেশি। আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালে আনুমানিক ১৪ দশমিক এক শতাংশ খানার একজন সদস্য ছিলেন যারা ১২ মাসে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। এটি ২০১৬ ও ২০১০ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, যার হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

উল্লিখিত তথ্য প্রমাণ করে, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমলেও কোনো কোনো অঞ্চলে বা গ্রামের একটি বড় অংশে ছয় বছরে তা আরও বেড়ে গেছে। ছয় বছরে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কোনো কোনো অংশে দারিদ্র্য না কমে কেন বেড়ে গেল, এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। একটি বড় কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতা— দ্বন্ধ ও পারস্পরিক বৈরিতায় দেশের অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো বৃহত্তর গ্রামীণ মানুষের স্বার্থের প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি ও মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আর সেই ব্যর্থতার জেরে দারিদ্র্যের হাত ধরে সেখানে বেড়েছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এবং আয়বৈষম্যও। গত ৩১ ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩’-এর তথ্য জানাচ্ছে, গড়ে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ বর্তমানে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন খাদ্যোৎপাদনকারী কৃষক। আর তাঁদের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশ, যা এ-সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালে চালের দৈনিক মাথাপিছু গড় ভোগের পরিমাণ ছিল ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। ২০২৬ সালে এটি ছিল ৩৬৭ দশমিক ২ গ্রাম। ২০১০ সালে ছিল ৪১৬ গ্রাম এবং ২০০৫ সালে ৪৩৯ দশমিক ৬ গ্রাম। এর বিপরীতে ফল, সবজি ও মাংসের ভোগ বাড়ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে মানুষ খাদ্যপণ্য কিনতে বেশি টাকা ব্যয় করলেও এখন খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ক্রয়ে বেশি টাকা ব্যয় করছে। ২০২২ সালের হিসাবে খাদ্যব্যয়ের শতকরা হার হচ্ছে ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হয়েছে ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে ২০১৬ সালে খাদ্যের জন্য ব্যয় হতো ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় ছিল ৫২ দশমিক ৩ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বেশি খুলনা জেলায়। সেখানে দারিদ্র্যের হার বেশি হারে বাড়ার কথা। কিন্তু পাশের বিভাগে দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি। দারিদ্র্য কমানোর প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা বেশি জরুরি। কারণ, হঠাৎ যে কোনো ধরনের আঘাতে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারেন। তাদের সুরক্ষা দিতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচন টেকসই হবে।

বস্তুত রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোয় গ্রামের প্রতি যে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করছে, সেটি থেকেই কৃষকের মধ্যে বর্ধিত হারের এ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।অন্যদিকে, বৈষম্যের মাত্রা কতটা বেড়েছে, এর তথ্যও রয়েছে আয় ও খানা জরিপ প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ এখন দখল করে আছে সমগ্র জাতীয় আয়ের প্রায় ৪১ শতাংশ; তো রাষ্ট্রীয় নীতি, পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনে সৃষ্ট এই যে বৈষম্য, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেটিকে ক্রমান্বয়ে আরও বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলেছে এবং এরই প্রতিফলন ঘটেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিবিএসের জরিপে। বৈষম্য বৃদ্ধির সুবাদে সর্বাধিক মাত্রায় ও হারে এবং সবচেয়ে আগে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গ্রামের মানুষ, যারা এখন পর্যন্ত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ মানুষ যদি এরূপ ক্রমবর্ধমান হারে দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার শিকার হতে থাকে, তাহলে প্রকারান্তরে তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেই চরম ভোগান্তিতে ফেলে দেয় নাকি? আর যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশে বিরাজমান রয়েছে তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এই ভোগান্তির মাত্রা নিকট ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যাবে নাকি? ২০০৮-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা ২০২০-এর ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ কিন্তু মোটামুটি বেশ ভালোভাবেই টিকে গিয়েছিল, যার পেছনে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা ছিল কৃষির। তাই আগামী দিনের দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি ও কৃষককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এই হউক নতুন বছরে নতুন সরকারের কাছে জাতীর প্রত্যাশা ।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ

সারাবাংলা/এসবিডিই

খানা আয়ব্যয় জরিপ ২০২২: দারিদ্র্য বৈষম্য প্রসঙ্গ ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর