Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সম্ভাবনাময় মৎস্য খাত ও দারিদ্র্য বিমোচন

ড. মিহির কুমার রায়
২৫ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:০২

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান অসস্বিকার্য় বিশেষত মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, রফতানি বাণিজ্যের প্রসার সর্বোপরি আর্থসামাজিক উন্নয়নে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ ব্যাপারে সরকারের সময়োপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক নীতি গ্রহণ, মৎস্য গবেষণার উন্নয়ন ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তি সম্প্রসারণসহ নানাবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং চাষী ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক ও লাগসই কারিগরি পরিষেবা প্রদানের কারণে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগ জোগান দিচ্ছে মাছ। মাথাপিছু প্রতিদিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে মানুষ এখন ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এখন মৎস্য খাতের অবদান। বিগত ১২ বছরে মৎস্য খাতে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৬.২ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট মাছের উৎপাদন ছিল ২৭. ১ লাখ টন যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৬.১ লাখ টন। এর মধ্যে সামুদ্রিক মাছের অবদান ৬.৮১ লাখ টন যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৪.৭৪ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। মাছ ও মাছজাতীয় পণ্যের রফতানির পরিমাণ মোট রফতানি আয়ের ১ .৩৯ শতাংশ। বার্ষিক মৎস্য দরদামের স্থিতিশীলতাই বলে দেয় মৎস্য চাষে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ যদিও কোন কোন মাছ দেশে উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৭ সালে ‘বাংলাদেশের ইলিশ’ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই সনদ লাভ করেছে। বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য। বর্তমানে বিশ্বের ৫২টি দেশে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ৬০ গ্রামের বিপরীতে ভোগ ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। মাছ ও মাছজাতীয় পণ্য বাংলাদেশের অন্যতম রফতানি পণ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএসএ, জাপান, রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের মাছ ও মাছজাতীয় পণ্য রফতানি হচ্ছে। বর্তমানে ১০৫টি মত্স্য প্রক্রিয়াজাত প¬ান্টকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৭৩টি ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানির জন্য অনুমোদিত। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ হিমায়িত ও তাজা মাছ রফতানি করে ৪৭৭ . ৩৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। গত কয়েক দশকে চাষ করা মাছ এবং এক দশকে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনুকরণীয়। কিন্তু নদীর নাব্যতা হ্রাস, দূষণ, হাওর-বাঁওড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর সংকোচন, দখল, অপ-উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ার মতো ঘটনা বাড়ছে। একই সঙ্গে মাছ ধরা এবং চাষের সঙ্গে জড়িত বিপুল পেশাজীবীর আর্থিক ও পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত, যা এই অগ্রগতিকে হুমকিতে ফেলতে পারে। দেশে এখন প্রায় চার কোটি লোক মৎস্য খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে জড়িত। লাভজনক হওয়ায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত মানুষ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান মৎস্য চাষে এগিয়ে এসেছে। মৎস্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বের অনুপ্রেরণা এখন। ভালো ব্যবস্থাপনা এবং মৎস্যবিজ্ঞানী, মৎস্য অধিদপ্তর ও জেলেদের নিরলস পরিশ্রম, ত্যাগে এটা সম্ভব হয়েছে। হাওর-বাঁওড়, অন্যান্য জলাশয় ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, দূষণ রোধ এবং জাতীয় আয়ে মৎস্য খাতের বিপুল অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। তবেই এ অগ্রগতি ধরে রাখা সম্ভব। পৃথিবীর প্রায় ৫২টি দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-বিএফআরআই সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট যে পরিমাণ মাছ উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে কার্প, অর্থাৎ রংই জাতীয় মাছ ২১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রুই মাছ, ১১ শতাংশ। এরপরে রয়েছে পাঙাশ (১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ), তেলাপিয়া (৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ), কাতলা (পৌনে ৭ শতাংশ) ও সিলভার কার্প (৭ দশমিক ৩ শতাংশ)। গত এক যুগে দেশি ৩৬ প্রজাতির ছোট মাছের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর ফলে এ সময়ে চাষের মাছ উৎপাদন ৬৭ হাজার মেট্রিক টন থেকে বেড়ে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেশে স্বাদু পানির ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৩০টি প্রজাতির চাষ বেশি হচ্ছে। বাকিগুলোর চাষ বাড়লে বাংলাদেশের মাছ উৎপাদন ৫০ লাখ টনে পৌঁছাবে।

এসব দেশে বিভিন্নভাবে মাছ রফতানি হচ্ছে। এটি আরো বাড়িয়ে তুলতে নিরাপদ মাছের সরবরাহের কোনো বিকল্প নেই। ভুলে গেলে চলবে না, চিংড়ি মাছে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া যাওয়ায় ইউরোপে এর রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। এর পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক প্রটোকল মেনে মৎস্য চাষ এবং বাজারজাত করতে হবে। নিরাপদ মাছের সরবরাহ নিশ্চিতকরণে আন্তর্জাতিক কিছু প্রটোকল রয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশও অনুসরণ করতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক যৌথভাবে প্রণীত ‘কোড অব প্র্যাকটিস ফর ফিশ অ্যান্ড ফিশারি প্রডাক্টস’ শীর্ষক একটি বিস্তারিত প্রটোকল রয়েছে। বিভিন্ন সংস্কার ও সংশোধনের মধ্য দিয়ে ২০২০ সালে এটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। এতে মাছের পোনা উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাত, বাজারজাত ও ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্তকীভাবে মৎস্য অনিরাপদ হতে পারে এবং এখান থেকে পরিত্রাণে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রাকৃতিক মাছের দূষণ রোধ, নিরাপদ প্রক্রিয়াকরণ, রফতানি, স্থানীয় বাজারজাত, পরিবহন ব্যবস্থা, সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত গাইডলাইন রয়েছে।

দেশের মৎস্য সম্পদের আহরণ ও উন্নয়নে আয়োজিত এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে মাছ চাষ, চিংড়ি চাষিদের এক অংকের সুদে ঋণ, চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ বন্ধে দরিদ্র জেলেদের খাদ্য সহায়তা ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, হস্তান্তরিত জলমহালগুলো মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ন্যন্ত করা, হালদা নদী রক্ষায় রবার ড্যাম তুলে ফেলা, মৎস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল ও ভূমি উন্নয়ন করে ছাড় দেয়া, মাছের খাবারের উপাদান আমদানিতেও শুল্কছাড়সহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এ বৈঠকে সংশ্লিষ্টদের দ্রততম সময়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জটিলতা দূর করার নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে মাছের উৎপাদন বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেছেন। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধির পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। সমুদ্র বিজয়ে দেশে ব¬ু-ইকোনমির ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দেশের উন্নয়নের জন্য অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য এই সম্পদের দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৎস্য খাতে সার্বিক উন্নয়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য বাংলাদেশ এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে মীমাংসিত সমুদ্রসীমায় মাছের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দস্যুতা ও বিদেশি ট্রলারের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এর পাশাপাশি দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ইলিশ ট্রাস্ট ফান্ড গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির অন্যান্য খাত-উপখাতের তুলনায় মাছের উৎপাদন বাড়ার হার বেশি। বিগত ১৫- ১৬ বছরে এ খাতে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী সাগর এলাকায় প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ দেশের জেলেরা ধরে থাকে। বিশাল সমুদ্রসীমায় মৎস্য সম্পদের ১ শতাংশও ধরতে পারছে না বাংলাদেশের জেলেরা উন্নত জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে, সে ব্যাপারেও কোন তথ্য সরকারের কাছে নেই। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অনায়সেই বিলিয়ন ডলার আয় করা যায়। এ ছাড়া মাছের তেল থেকে ওষুধ, সস প্রভৃতি তৈরি করা সম্ভব। এতে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব। সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে সেখানে মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরির ওপরও গুরত্ব দিতে হবে। মাছের বাজার নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। বলা যায়, গোটা বিশ্বেই মাছের অপরিমেয় চাহিদা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাতে হবে, দেশীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্ধ রাখতে হবে । সামুদ্রিক জেলেদের জন্য ‘সামুদ্রিক মৎষ্য পরামর্শ কেন্দ্র’ চালু করা যায়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে জেলেরা প্রতিদিন ‘মাছের বসতি’ সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে জেলেদের অর্থ ও সময় বাঁচবে। এ কাজে মৎস্য বিজ্ঞানীদের লাগানো যায়। আধুনিক ট্রলার বা ফ্রিজার ঘণ্টায় এক টনেরও বেশি মাছ ধরতে ও প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। ভারত, থাইল্যান্ড, মায়ানমারসহ অনেক দেশই এ প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে প্রক্রিয়াজাত করে। উন্নত ট্রলারে থাকা-খাওয়ার সুবিধাও ভালো। এর চেয়ে বড় কথা, এগুলো অনেক নিরাপদ। ফলে এসব দেশের জেলেরা দীর্ঘদিন সমুদ্রে অবস্থান করে মাছ ধরতে পারে। মায়ানমার ও ভারতের সমুদ্র সীমায় স্রোত ও ঢেউ বেশি থাকায় আমাদের জলসীমা থেকে তারা অনেক সময় মাছ ধরে নিয়ে যায়। সামুদ্রিক ঢেউ ও স্রোতের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিউটিএ) ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) আধুনিক জাহাজ আমদানি করে পিপিপির মাধ্যমে বা কিস্তিতে জেলেদের দিতে পারে। ডাটাবেইস করে সামুদ্রিক মাছ ধরার প্রতিটি নৌকা ও মালিককে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে।

এ ছাড়া মৎস্য আহরণ বাড়াতে সামুদ্রিক নৌযান, ট্রলারগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে সমুদ্রের সর্বশেষ অবস্থা সব সময় জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গভীর সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ আহরণে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। হংকং, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কেবলমাত্র সমুদ্রকে ব্যবহার করেই বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে অনেক দিন নানা ধরনের বিরোধ ছিল, এখন সে অবস্থা নেই। তারপরেও আমরা কেন আমাদের সমুদ্রসীমায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না, সেটাও বিবেচনার বিষয়। সমুদ্র সম্পদ আহরণ এবং এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির চেহারাও বদলে দেওয়া সম্ভব। বিশেষ করে আমাদের সমুদ্র সীমায় মৎস্য সম্পদ আহরণে বিরাজমান সমস্যাগুলো অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে হ্যাচারিতে মাছের পোনা উৎপাদনের কৌশল ষাটের দশকে প্রথম চীন থেকে আসে। হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি ছাড়াও পর্যায়ক্রমে চীন থেকে দ্রুত বর্ধনশীল মাছের প্রজাতি যেমন—সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মিরর কার্প ইত্যাদি মাছ আমদানি করা হয়েছে। এসব মাছ আমাদের দেশের জলবায়ুতেও দ্রুত বর্ধনশীল। পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষাবাদের ক্ষেত্রেও চীনের সাফল্য আশাব্যঞ্জক। মাছের রোগবালাই দমনের ক্ষেত্রে প্রচলিত রাসায়নিক দ্রব্যের পাশাপাশি ভেষজ ওষুধ চীনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে তারা সুফলও পাচ্ছে। বাংলাদেশও ভেষজ ঔষধি গাছে সমৃদ্ধ। মাছের রোগবালাই দমনে এসব ঔষধি গাছ ব্যবহার করা যায় কিনা তা নিয়ে কার্যকর গবেষণা প্রয়োজন।

মাছের উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া মাছের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করতে, পাশাপাশি বর্তমান সরকারের আমার গ্রাম, আমার শহরের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার ‘দক্ষিণ বিশিউড়া’ ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ‘হালইসার’ গ্রামকে ‘ফিশার ভিলেজ’ বা ‘মৎস্য গ্রাম’ ঘোষণা করেছে। এছাড়া সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প এলাকায় ১০০টি মডেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠা ও ৪৫০টি মৎস্যজীবী গ্রাম উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানির বাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে মান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। মাছের মান নিয়ন্ত্রণে দেশে তিনটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হবে। জনবহুল বাংলাদেশের খাদ্যচাহিদা মেটাতে কল-কারখানার বর্জ্য, ফসলি জমিতে কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে নদীদূষণ এবং অতিরিক্ত মাছ আহরণসহ নানা কারণে দেশী মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক প্রজাতি হুমকির মুখে রয়েছে। এ থেকে উত্তরণে কার্যকর দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে ।

মৎস্যচাষীরা প্রায়ই বলেন, তারা মাছের ভালো দাম পাচ্ছেন না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে মাছ থেকে মূল্যসংযোজিত পণ্য তৈরিতে জোর দিতে হবে। এতে চাষীরা আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হবেন। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যেমন প্রশংসা পাওয়ার সুযোগ আছে, ঠিক তেমনি সামনে বড় কয়েকটি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তন ও মাছের আবাসস্থলের অবক্ষয়। তাছাড়া দেশে মাছের চাষাবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চাষাবাদে মানসম্পন্ন উন্নত জাতের মাছের পোনা এবং স্বল্পমূল্যের মানসম্পন্ন মৎস্য খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা। রোগবালাই দমনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বা ওষুধের প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। বাজারে বিষমুক্ত মাছের সরবরাহ নিশ্চিত করতে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় তদারকি বাড়াতে পারে। পাশাপাশি বাজারে মাছে ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ না হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মৎস্য আমদানি করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কিছু সাদা মাছ ও চিংড়ি ছাড়া তেমন কিছুই রফতানি করতে পারে না ‘উত্তম চাষ’ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মৎস্য খাতকে উন্নয়নের পরের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন অনুসারে এর সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ মাছের সরবরাহ। অভ্যন্তরীণ বাজারে মৎস্য ও মৎস্য পণ্য বাজারজাত করতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে মৎস্য ও মৎস্য পণ্য (পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৮ (সংশোধিত) অবশ্যই সবাইকে মেনে চলতে হবে।তার সাথে সাথে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে সবকারের বাজেেেটর মাধ্যমে, দাতা সংন্থার মাধ্যমে, পিপিপির মাধ্যমে যা মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত সম্ভাবনাময় মৎস্য খাত ও দারিদ্র্য বিমোচন

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর