আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় প্রধানমন্ত্রীর আশাবাদ
২৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:০১
২১ জানুয়ারি রাজধানীর পূর্বাচলে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের কাঞ্চন সেতু থেকে উত্তরে কিছু দূর গেলেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মাসব্যাপী ২৮তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো দেশে পণ্য প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় আয়োজন ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা (ডিআইটিএফ)। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) যৌথভাবে এ মেলার আয়োজন করেছে। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।এতে স্বাগত বক্তব্য দেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান । অনুষ্ঠানে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে গত ১৫ বছরে গৃহীত সরকারি পদক্ষেপের উপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। মেলায় স্থানীয় টেক্সটাইল, মেশিনারিজ, কার্পেট, প্রসাধনী, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, গৃহস্থালীর পণ্য, চামড়া ও জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য, খেলাধুলার সামগ্রী, স্যানিটারি সামগ্রী, খেলনা, স্টেশনারি, ক্রোকারিজ, প্লাস্টিক, মেলামাইন পলিমার, ভেষজ সামগ্রী, টয়লেট্রিস, ইমিটেশন জুয়েলারি, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড, হস্তশিল্প, গৃহসজ্জা, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য পণ্য প্রদর্শিত এবং বিক্রি হচ্ছে। তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তন, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং ইরানের কম্পানিগুলো এ বছর তাদের পণ্য প্রদর্শন করছে । এবারের বাণিজ্য মেলার লেআউট প্ল্যান অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাটাগরির মোট প্যাভিলিয়ন, রে¯েস্তরাঁ ও স্টলের সংখ্যা ৩৫১টি এবং দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত প্যাভিলিয়ন, রেস্তোরাঁ ও স্টলের সংখ্যা ৩০০টি।
মেলা উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা একান্ত ভাবে দরকার। আপনারা রফতানি করেন, রফতানি করার সময় যে অর্থ ব্যবহার হয়, তার যে রিটার্ন আসবে ঠিক চাহিদামতো ভাবে তা আসে না। এদিকে সবাইকে আরও একটু যত্নবান হওয়ার জন্য আহ্বান জানাই। তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে ক্ষমতা কোনো ভোগের বস্তু না, আমার কাছে ক্ষমতা হলো দেশে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের একটা সুযোগ। মানুষের কল্যাণে কাজ করার সুযোগ, মানুষকে সেবা দেওয়ার একটা সুযোগ আবার পেয়েছি। ৭ই জানুয়ারি নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হতে পেরেছি। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটের মাধ্যমে আমাদের আবার ক্ষমতায় এনে সেবা করার সুযোগ দিযেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের যদি প্রসার না ঘটে, কোনো দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা দিয়ে ছিলাম, আজকে ডিজিটাল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আমরা উৎক্ষেপণ করেছি। সবছেয়ে বড চ্যালেঞ্জ হলো নিজস্ব অর্থাযনে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা। আমরা প্রমাণ করেছি, বাংলাদেশের জনগণকে কেউ চ্যালেঞ্জ দিয়ে দাবায়ে রাখতে পারবে না।ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা একান্তভাবে দরকার।’ এসময় তার সরকারের মেয়াদে উৎপাদন বৃদ্ধিতে বহুমুখী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও তুলে ধরেন তিনি। তিনি আরও বলেন‘আমরা চাই আমাদের দেশটা আরও এগিয়ে যাক, আরও উন্নত হোক, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হোক। আমরা খুব ভালো ভালোই যাচ্ছিলাম, আমাদের প্রবৃদ্ধিও ৮-এর কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলাম।’ এসময় তিনি রাশিযা-ইউক্রেন যুদ্ধ, স্যাংশন, কাউন্টার স্যাংশন ও কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে নানামুখী সংকটের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের মতো যারা কেবল উঠতি অবস্থায় আছি, সেই সময় এটা একটা বিরাট ধাক্কা আমাদের অর্থনীতির উপর এসে পড়েছে। তারপরও ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে সচল থাকে সে লক্ষে তার সরকার ব্যবসায়ীদের বিশেষ প্রণোদনা, স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা, ভতুর্কিসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখার চেষ্টা করেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা রফতানিতে সুনির্দিষ্ট কয়েকটা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু একটা-দুটো পণ্যের উপর নির্ভরশীল থাকলে আমাদের চলবে না। আমাদের রফতানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে আরও সুযোগ বাড়াতে হবে। যে পণ্যকে আমরা বেশি সুযোগ দিচ্ছি, তারাই ভালো করছে। তাহলে আমার অন্য পণ্যগুলি কেন বাদ যাবে? তাদেরও আমাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। যাতে তারাও সেইভাবে সুযোগ পায়।’এছাড়া পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া শিল্পজাত পণ্য, আইসিটি, খাদ্য পণ্যসহ বিভিন্ন রকম পণ্যগুলোর দিকেও ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের রফতানি জোরদার করণে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
অর্থনীতির উন্নয়নে এ মেলার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশীয় পণ্য রফতানিতে বহুমুখীকরণ করাই বাণিজ্য মেলার মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ যদি তার পণ্য বহুমুখীকরণ করতে পারে, তাহলে রপ্তানি ১০০ বিলিয়নের বেশি হতে পারে। বাংলাদেশ মেলা স্থিতিস্থাপকতার সাথে দ্রুত প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে পারে, যা উচ্চমানের উন্মুক্তকরণ প্রচেষ্টার একটি হাইলাইট হিসাবে আবির্ভূত হয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে এবারের বাণিজ্য মেলায় দেশীয় পণ্য ছাড়াও ভারত, পাকি¯স্তন, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, মালয়েশিয়াা, ইন্দোনেশিযয়াা, হংকং, সিঙ্গাপুর, নেপালসহ বিভিন্ন দেশ অংশ নিচ্ছে। পণ্য প্রদর্শনের পাশাপাশি দেশীয় পণ্য রফতানির জন্য বড বাজার খুঁজে বের করার লক্ষ্য। বাণিজ্য মন্ত্রণালয ও ইপিবির যৌথ উদ্যোগে দেশীয় পণ্যের প্রচার, বিস্তার, বাজারজাতকরণ ও সহায়তার লক্ষ্যে ১৯৯৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যšন্ত শেরেবাংলা নগরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কোভিড মহামারির কারণে ২০২১ সালে মেলা আয়োজন করা সম্ভব হযনি। মহামারী বিধিনিষেধের মধ্যে ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো পূর্বাচলে বিবিসিএফইসি-তে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্থায়ী ভেন্যু বাংলাদেশ-চীন এক্সিবিশন সেন্টারে তৃতীয় বারের মতো বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চীনের অর্থায়নে পূর্বাচলে একটি স্থায়ী বাণিজ্য মেলা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এখন থেকে প্রতি বছর এখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হবে। কম্পিউটার মেলা, বিজ্ঞান মেলা, কৃষি মেলা ও বইমেলার মতো মেলা আমাদের সংস্কৃতির সবছেয়ে আধুনিক সংস্করণ ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা।
মেলার আন্তর্জাতিকীকরণের কারণে অনেক বিদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নিচ্ছে, বিদেশি ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা ভিড় জমাচ্ছে, দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, মেলায় বিদেশি দর্শনার্থীদের কাছে এসব পণ্য বিক্রি করলে বিশ্বে দেশীয় শিল্পের বিক্রি ও সুনাম বাডাচ্ছে, ফলে দেশের ক্ষুদ্র শিল্পগুলো লাভবান হতে পারছে, আর বড় দেশীয় কোম্পানির মুনাফা অর্জনের পথও সুগম হচ্ছে এই মেলার মাধ্যমে। এছাড়াও অংশগ্রহণকারী দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো থেকে বাংলাদেশ সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে় এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে, মেলার টিকিট বিক্রি থেকেও প্রচুর টাকা আয় হচেছ। মেলায় খন্ডকালীন চাকরির মাধ্যমে বেকারদের সাময়িক বেকারত্ব দূর করা হয। অনেকে মেলায খন্ডকালীন চাকরিতে ভালো দক্ষতা দেখিয়ে স্থাযী চাকরিও পাচ্ছে অনেকে।
বাণিজ্য মেলা একটি দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। বাণিজ্যের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সবছেয়ে প্রভাবশালী মেলায় পরিণত হওয়ায়া বাণিজ্য মেলার কার্যকারিতা উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করবে বলে বিশ্বাস। বাণিজ্য মেলা ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ারা, ব্যবসা খাতের জন্য নিজস্ব শক্তি ও উচ্চাকাঙ্কা প্রদর্শন এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি ঘোষণার একটি মূল্যবান সুযোগ । দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগের জন্য, মেলায় অংশগ্রহণ ব্র্যান্ড সচেতনতা তৈরি, তাদের গ্রাহক বেস প্রসারিত এবং নতুন ব্যবসায়িক নেতৃত্ব তৈরি করার একটি দুর্দান্ত সুযোগ হতে পারে। তারা সম্ভাব্য অংশীদার এবং গ্রাহকদের সাথে দেখা করতে পারে, নতুন বাজারগুলি অন্বেষণ করতে পারে এবং সর্বশেষ শিল্প প্রবণতা এবং উন্নয়ন সম্পর্কে শিখতে পারে।
বাণিজ্য মেলা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সহায়কক ভূমিকা পালন করছে। তাই দেশের প্রধান জ্বালানি অর্থনীতির সমৃদ্ধ অবকাঠামো গডতে বাণিজ্য মেলার আয়োাজন করা প্েরযাাজন। এই মেলা বাংলাদেশের সবছেয়ে বড় ব্যবসায়িক আযোজন। উৎপাদক-রপ্তানিকারক, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের এক প্ল্যাাটফর্মে নিয়ে আসা এবং পণ্যের প্রচার ও বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে এ মেলার অপরিহার্যতার বিকল্প নেই।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা
সারাবাংলা/এসবিডিই