Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভারত-পাকিস্তান কিভাবে ডিজিটাল ওপেন ব্যাংকিং ইকোসিস্টেম তৈরি করছে

মো. সাইফুল আলম তালুকদার
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৩৪

ঢাকা: অনেকটা ভারতকে অনুসরণ করে পাকিস্তান ব্যাংকস অ্যাসোসিয়েশন (পিবিএ) একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে যা তাদের গ্রাহকদের তথ্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে আদান-প্রদান করতে পারবে। ফলে নতুন গ্রাহকদের দ্রুত এবং কম খরচে অনবোর্ডিং করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

গত ১৮ ডিসেম্বর জারি করা একটি সার্কুলারে, স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান (এসবিপি) এই প্ল্যাটফর্ম চালু করার ঘোষণা দিয়েছে, যাকে ‘শেয়ারড ইলেকট্রনিক নো ইওর কাস্টমার (ই-কেওয়াইসি) প্ল্যাটফর্ম’ বলা হচ্ছে। এই প্ল্যাটফর্ম পিবিএ দ্বারা সূচিত এবং এসবিপি দ্বারা পরিচালিত। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, কেওয়াইসি প্রক্রিয়ার দক্ষতা বাড়ানো। আর ভারতে এই ই-কেওয়াইসি শুরু হয়েছে ২০১৩ সাল থেকে।

বিজ্ঞাপন

আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাধারণত তাদের গ্রাহকদের পরিচয় যাচাই করতে কেওয়াইসি ব্যবহার করে থাকে। এটি মূলত দুটি পর্যায়ে পরিচালিত হয়: এক, নতুন গ্রাহক অনবোর্ডিংয়ের সময় এবং পরবর্তী পর্যায়ে বিদ্যমান গ্রাহকদের জন্যও প্রযোজ্য। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে তাদের অবশ্যই শনাক্তকরণ কাগজপত্র, যেমন: জাতীয় পরিচয়পত্র, যোগাযোগের ঠিকানা এবং আয়ের প্রমাণস্বরুপ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস জমা দিতে হয়।

শেয়ার্ড ই-কেওয়াইসি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার টেকনোলজির উপর ভিত্তি করে, যেখানে ব্যাংকগুলো স্ব-স্ব গ্রাহকদের কেওয়াইসি এবং কাস্টমার ডিউ ডিলিজেন্স (সিডিডি) সম্পর্কিত তথ্য নিজ নিজ ব্যাংকের কাছে সংরক্ষণ করা ছাড়াও প্রয়োজনমাফিক গ্রাহকদের সম্মতিক্রমে অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে তথ্য আদান-প্রদানের অনুমতি দেবে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির সুবিধা হলো এটি ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের সম্মতিতে একটি বিকেন্দ্রীভূত এবং স্ব-নিয়ন্ত্রিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদানে মানসম্মত বা নির্ভুল এবং দ্রুত বিনিময় যোগ্য পরিষেবা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

বিজ্ঞাপন

ইলেকট্রনিক নো ইউর কাস্টমার বা ই-কেওয়াইসির আরেক নাম হচ্ছে সেন্ট্রাল কেওয়াইসি বা সি-কেওয়াইসি। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছায়ায় থেকেও ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় তথ্যের আদান-প্রদান বা সংযোগ স্থাপন করা। ভারত এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং পরবর্তীতে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা এবং বাহামার মতো দেশগুলোও এই ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে। ভারতে এই সুবিধা শুধুমাত্র ব্যাংকগুলোই ভোগ করছে না, তাদের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই সুবিধার আওতায় এসেছে। তবে পাকিস্তানে প্রথম পর্যায়ে শুধুমাত্র ব্যাংকগুলো এই সুবিধা ভোগ করবে।

এই নতুন প্ল্যাটফর্মটি ব্যাংকগুলোকে অনেক সুবিধা প্রদান করবে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সুবিধা হচ্ছে: একটি নিরাপদ ডিজিটাল চ্যানেলের মাধ্যমে ব্যাংকিং জগতের গ্রাহকদের কেওয়াইসি ও সিডিডি তথ্যের সময়মত বিনিময় এবং আপডেট করা, কেওয়াইসি ও সিডিডি তথ্যের প্রমিতকরণ (অর্থাৎ তথ্যের ব্যত্যয় ঘটবে না বা ভুল-ভ্রান্তি কমিয়ে এনে তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা বাড়াবে), গ্রাহক দ্রুত অনবোর্ডিং, ব্যাংকগুলোর খরচ সাশ্রয়, অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং (এএমএল) এবং সন্ত্রাসবাদের অর্থায়ন (সিএফটি) শাসনকে শক্তিশালী করা যাবে এই মাধ্যমে।

RAAST-এর পরে এটি পাকিস্তানে নতুন আর্থিক পরিষেবা মান বৃদ্ধিতে একটি গতিশীল ভূমিকা পালন করবে। শেয়ার্ড কেওয়াইসি মানেই শুধু দ্রুত অ্যাকাউন্ট খোলায় সহযোগিতা করবে না বরং এটি আর্থিক প্রতিপালন সম্পাদনে জোরদার ভূমিকা পালন করবে, যা দেশব্যাপী প্রকৃত অর্থের গতিশীলতা বৃদ্ধি করবে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ‘রাস্ত’ হলো পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক অর্থপ্রদান ব্যবস্থা যা খুচরা পর্যায়ে ব্যক্তি, ব্যবসা এবং সরকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে আরটিজিএসের মত দ্রুত ডিজিটাল পেমেন্ট করতে সক্ষম।

আমরা সবাই জানি যে ভারত সি-কেওয়াইসি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি অগ্রগণ্য দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এই ক্ষেত্রে তাদের দেশে ভূমিকা রেখেছে ‘সেন্ট্রাল রেজিস্ট্রি অফ সিকিউরিটাইজেশন অ্যান্ড অ্যাসেট রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড সিকিউরিটি ইন্টারেস্ট অফ ইন্ডিয়া (CERSAI)’। এটির পরীক্ষণমূলক প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আর পুরোপুরিভাবে চালু করা হয়েছিল ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে। পরবর্তীতে ৩১শে মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত সি-কেওয়াইসি ৭০ কোটি কেওয়াইসি সম্পন্ন করেছে যা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগ।

সি-কেওয়াইসির লক্ষ্য গ্রাহক শনাক্তকরণে বিশদ কেন্দ্রীভূত ডাটাবেস তৈরি করে কেওয়াইসি প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করা। অর্থাৎ, পরিশেষে এটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ফান্ড, বিমা কোম্পানি এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্য আদান-প্রদানের নির্ভরযোগ্য সেবা প্রদান করে। সহজ কথায় এই ব্যবস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সেবা নেবার সময়ে গ্রাহকদের একাধিকবার কেওয়াইসি সংক্রান্ত নথি জমা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দূর করে।

ভারতের আরেকটি উদাহরণ আমাদের ধারনা দিবে, খুচরা ব্যাংকিং দিন দিন কিভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অধুনা রিজার্ভ ব্যাক অফ ইন্ডিয়া গত বছরের ১৬ আগস্ট ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আওতায় আরেকটি পাইলট কর্মসূচির সূচনা ঘোষণা করেছে, যা পাবলিক টেক প্ল্যাটফর্ম ফর ফ্রিকশনলেস ক্রেডিট (পিটিপিএসসি) নামে পরিচিত। এই কর্মযজ্ঞের লক্ষ্য হলো ভারতের যে বিপুল জনসংখ্যা বর্তমানে ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে বা ব্যাংক ঋণের বাইরে রয়েছেন তাদের ক্রেডিট কার্ড, ডেইরি ঋণ, জামানত ছাড়া ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ঋণ, ব্যক্তিগত এবং গৃহঋণসহ বিভিন্ন ধরনের ঋণ দ্রুত সময়ে প্রদান করা। এটি সি-কেওয়াইসি থেকে তথ্য একত্রিত বা সংগৃহীত করে ঋণ মূল্যায়নকে অধিকতর সহজ করবে, অর্থাৎ গ্রাহক ঋণ আবেদন করার আগেই জানতে পারবেন তিনি কি পরিমাণ ঋণ পেতে পারেন এবং পরবর্তীতে দ্রুততম সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্রাহক সেই ঋণ ছাড় করাতে সক্ষম হবেন।

ঋণগ্রহীতা এবং ঋণদাতাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে লাখো ক্ষুদ্র ঋণ সন্ধানকারী গ্রাহকদের কাছে ঋণ সেবা পৌঁছে দেয়ার প্রয়াসে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর ইন্দোরে আরবিআই বোর্ড সভায় এই বিষয়ে উপস্থাপনা গ্রহণ করা হয়।

ভারতের ব্যাংকস অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শক্রমে আরবিআই ২০১৬ সালে ইউপিআই-এর মাধ্যমে স্মার্টফোন বা ফিচার ফোনের সাহায্য তাৎক্ষণিকভাবে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফার এবং ব্যক্তি থেকে মার্চেন্টকে টাকা প্রদান করার পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম চালু করেছিল। শেষ পর্যন্ত ইউপিআই-এর আশীর্বাদে পিটিপিএফসি প্ল্যাটফর্ম চালু হতে যাচ্ছে।

এই প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে যদি কোন ব্যক্তির সঞ্চয়ী হিসাবে ব্যালেন্স শেষ হয়ে যায় তবে ‘প্রাক-অনুমোদিত ঋণ সীমার’ আওতায় ইউপিআর চ্যানেলে নিজ ব্যাংক বা অন্য কোন ব্যাংক থেকে কাঙ্ক্ষিত ব্যালেন্স রিচার্জ করা সম্ভব। এই সুবিধা অনেকটা ক্রেডিট কার্ডের ঋণ সীমার অনুরূপ।‌ বর্তমানে ভারতের ৬টি ব্যাংক ও ৪টি ফিনটেক কোম্পানি এই সুবিধা কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে যা পরবর্তীতে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।

অ্যাপ বা যেকোনো মাধ্যমে এই সুবিধা গ্রহণ করা যাবে। স্বল্পমেয়াদী ইউপিআই ক্রেডিট লাইনের মেয়াদ কয়েক মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত হতে পারে। ব্যবহারের উপযোগিতা অনুযায়ী ভবিষ্যতে এই ধরনের ঋণের মেয়াদ দীর্ঘ মেয়াদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।‌ ঋণগ্রহীতার ঋণযোগ্যতা এবং বাজারের বিদ্যমান অবস্থার উপর ভিত্তি করে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভেদে সুদের হার পরিবর্তিত হবে। তবে এই ধরনের ঋণের সুদের হার সাধারণ ক্রেডিট কার্ডের সুদের হারের চেয়ে কম হবে কারণ এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ঋণ সুবিধার আওতায় আনার জন্য কাজ করবে।‌

যাদের বিভিন্ন সময় তাৎক্ষণিক ঋণের প্রয়োজন পড়ে, তারা ইউপিআই অ্যাপের সঙ্গে প্রয়োজনীয় ক্রেডিট লাইন যুক্ত করে একাধিক ক্রেডিট কার্ড বহন করার বাধ্যবাধকতার থেকে রেহাই পাবেন।‌ গ্রাহক চাইলে এই ঋণে সমান মাসিক কিস্তিতে (ইএমআই) পরিশোধ করার সুবিধাও পাবেন। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেডিট কার্ডের মতো ‘রিওয়ার্ড পয়েন্ট’ দেবার ব্যবস্থাও রাখতে পারে। তবে ব্যাংকগুলো যেহেতু এই ক্ষেত্রে মার্চেন্টের কাছ থেকে মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেট (এমডিআর) পাবে না, তাই ক্রেডিট লাইন ব্যবহারকারীদের খুব বেশি রিওয়ার্ড পয়েন্ট নাও দিতে পারে। এমডিআর হলো সেই ফি যা মার্চেন্ট একটি ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট প্রসেসিং কোম্পানি ও ব্যাংককে প্রদান করে থাকে।

এই ধরনের উদ্যোগগুলোই বৃহত্তর ডিজিটাল ওপেন (উন্মুক্ত) ব্যাংকিং ইকোসিস্টেমের অংশ হিসেবে কাজ করবে। তাই শেয়ার্ড কেওয়াইসি একটি দেশের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে তা সহজেই অনুমেয়। আর এই সুবিধার আওতায় ডিজিটাল ব্যাংকগুলো ধারাবাহিকভাবে এমবেডেড ফিন্যান্স পার্টনারশিপের মাধ্যমে তাদের বিদ্যমান বা নতুন গ্রাহকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। ডিজিটাল ব্যাংক এবং অন্যান্য ফিনটেকগুলোর মধ্যে উন্মুক্ত ব্যাংকিং বিকাশে মধ্যস্থতা, সহযোগিতা, জ্ঞান আদান-প্রদান এবং তথ্য শেয়ারিং উন্নত করার মাধ্যমে সঠিক ভোক্তা খুঁজে বের করা এবং পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে ট্রায়াল-এন্ড-এরর পর্যায় কমিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকগুলোর বাজারে প্রবেশের সক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে সাহায্য করবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ভারতে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রযুক্তিকে মানুষের ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় অনুন্নত এলাকার সাধারণ মানুষ দারুণভাবে উপকৃত হচ্ছে। ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে ভারতে ১০০টি জেলায় বিভিন্ন অনুন্নত এলাকায় সরকারি সাহায্যের কারণে জেলাগুলো দেশের প্রবৃদ্ধির অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে। আর এই মডেলটিকে অধ্যয়ন করার জন্য তিনি এ বছরের জুন মাসে জি-টুয়েন্টি দেশের প্রতিনিধিদেরকে আহ্বান করেছিলেন। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য এটা একটি দারুণ বার্তা যে, ভবিষ্যতের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাদের সঙ্গী করেই তা অর্জিত হবে।

লেখক: ব্যাংকার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর