হেসে খেলে জীবনটা যায় যদি যাক না
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:৫৫
ঊনিশ শ ঊনসত্তর সালে এদেশে ‘নীল আকাশের নীচে’ নামে একটা বিখ্যাত সিনেমা হয়েছিলো। সেই সিনেমায় নায়করাজ রাজ্জাকের মুখে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর গলায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের গীতে সুরকার সত্য সাহার সুরে একটা গানও বিখ্যাত হয়েছিলো। গানটি ছিলো: হেসে খেলে জীবনটা যায় যদি যাক না। দর্শক প্রিয় এই গান তখনকার সঙ্গীত ভক্তদের মুখে মুখে স্ফুট বা অস্ফুট স্বরে গুনগুনিয়ে উঠত। গানটি মূলত: প্রাণ চাঞ্চল্যের। উৎক্ষিপ্ত আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। মনে সন্তুষ্টি থাকলে, পরিবেশ সুস্থ থাকলে সব কিছুই ভালো লাগে, লাগার কথা। আসলে তখন মানুষের জীবনাচার অন্যরকম ছিলো, মাত্রা জ্ঞান টনটনে ছিলো। খুব বেশি প্রত্যাশা না থাকলেও যা কিছু প্রাপ্তির মধ্যে থাকত তাতেই সন্তোষ বোধ হত। নীতি-নৈতিকতার বালাই ছিলো। সভ্যতা-ভব্যতার লভ্যতা ছিলো। সামাজিক অনুশাসন শক্ত ছিলো। পারিবারিক আবহ যুগপৎ শিক্ষামূলক ও সংশোধনমূলক ছিলো। তখন সামাজিক, ধর্মীয় রীতিনীতি, বিশ্বাস আর অনুশাসনের কঠিন সমীকরণ বজায় রেখে সবাই চলত। আর যে যার অভীষ্ট অর্জনে অধ্যবসায়ী ছিলো।
এখনও আমরা হেসে খেলে জীবনটা যায় যদি যাকনা ছন্দে নৃত্যানন্দে পার করছি। তবে তার সুর, লয়, গীত, গায়কী ও অর্কেস্ট্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গণে এখন চলছে ‘নাচ আমার ময়না তুই পয়সা পাবি রে’ টাইপের বিনোদন। সিনেমা নেই, নাটক নেই। এর কুশীলবরা তাই নেচে-কুঁদে পয়সা কামাতে ব্যস্ত। সাহিত্যের অনুশীলন প্রায় উঠেই গেছে। জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতার পরিসর, কলেবর আজ অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। যাও আছে তাও দায়সারা গোছের। বইমেলা এখন কটকটি জাতীয় খাবার, সাজপন্য আর ছেলেমেয়ের দেখাদেখি ও ভাব বিনিময়ের নিরাপদ ওপেন স্কোয়ার। সেখানে সেলিব্রেটি, টিকটকার আর দন্ড প্রাপ্তদের সদম্ভ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এদের এক নজর দেখার জন্য, একটা সেল্ফি তোলার জন্য রীতিমত হুড়োহুড়ি পরিলক্ষিত হয়। অধ:পাতে যাওয়া মিডিয়া এদেরকে টপ প্রায়োরিটি দিয়ে নানা ঢংয়ে উপস্থাপন করে। যে যার ইচ্ছেমত যেমন খুশি তেমন রূপে সাজতে যেন উঠেপড়ে লেগেছে।
আজকাল একটা শব্দ অতি ব্যবহারে বিবমিষার উদ্রেক করছে। তাহলো ‘ভাইরাল’। যার চোখের লজ্জার পাতা যত বেশি পাতলা, যার বোধের ঘরে সীলগালা দেওয়া, আজ তার গলা তত চড়া, আকর্ষী লতার মত তত সুললিত। বইমেলা আর গ্রামীন মেলার মধ্যে এখন আর কোন ভেদ নেই। সবাই আসছে, খাচ্ছে, ঘুরছে, নেড়ে ঘেটে দেখছে। বই জাতীয় কিছু কি কিনছে? যারা আগে থেকেই নিজ গুণে জঘন্য, ধিকৃত, বিকৃত তারাও লেখক তকমা গলায় লটকিয়ে বুক-স্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চ্যানেল আর ভøগারদের ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক ঝলকানিতে বাণী দিয়ে বেড়াচ্ছে। কৌতুক-সুড়সুড়িও দিচ্ছে। পাবলিক ্এদের বই উল্টে পাল্টেও দেখছে।
চ্যানেল আর কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা সেদিকেই বেশি সোচ্চার। টিকটকাররাও পেরেশান। মেলায় আগত দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। ভাইরাল হওয়ার নেশায় অনেকেই ক্যামেরায় মুখ খুলছে। অনেকে নেগেটিভ ভাইবের আশংকায় কেটে পড়ছে। এদের মধ্যে নবীনদের সংখ্যাই বেশি। তাদের সিংভাগের জানা নেই স্বাধীনতা দিবস আর ভাষা দিবস বা শহীদ দিবস, বিজয় দিবস কবে, কেন হয়েছিলো? ভাষা আন্দোলন কত সালে হয়েছিলো? অতি সাধারণ অথচ অবশ্য পাঠ্য কতিপয় বিষয়েও এদের কোন ধারণা নেই। থাকলেও গুবলেট করার মত। অথচ এদের বেশিরভাগই জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন পাওয়া মেধাবীর সনদপ্রাপ্ত।
আরেকদল আছে ভীষণ মাত্রার পজিটিভ ম্যুডের। এসবে তারা পাত্তা দেন না। উন্নয়নের পরিসংখ্যান তাদের মুখস্থ। শিক্ষিতের হার বেড়েছে, নারী শিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ হয়েছে, এমপিও ভুক্ত স্কুল-কলেজের সংখ্যা প্রতিবছর রেকর্ড ভঙ্গ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফি বছর শুরুতেই নতুন পাঠ্যপুস্তক বিতরণ হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে জোরেশোরে। স্কুল-কলেজে শক্তিশালী কমিটি হচ্ছে। সেখানে পদ পেতে লাখ টাকা খরচ করে পদপ্রার্থীরা নির্বাচনে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। ভার্সিটির সংখ্যা সেঞ্চুরি পার হয়ে গেছে। শক্তিশালী লাল-নীল-সাদা ইউনিফর্মধারী শিক্ষক সমিতি গঠিত হচ্ছে। রেগিং আর দাদাগিরির অধীনে নবীনরা হাতে কলমে প্যারা বিষয়ক কোর্সের দীক্ষা নিচ্ছে। পজিটিভ লোকদের আরো অনেক যুক্তি আছে। পাসের হার বেড়েছে। সেকেলে ধাঁচের পাঠ্যপুস্তকের আধুনিকায়নের কাজ চলছে। পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কর্ম হচ্ছে। শিক্ষা নিয়ে সর্বত্র খুশির জোয়ার বইছে। ছাত্ররা খুশি, কারন তাদের মাথা ব্যাথা অনেকটাই কমে গেছে। শিক্ষকরাও খুশি। তাদের দায়িত্ববোধের জায়গাটা হাল্কা হয়ে গেছে। অভিভাবকরাই শুধু টেনশনে। তাই তাদের সন্তুষ্টির জন্য সহজলভ্য করা হয়েছে জিপিএ ফাইভ। এখন থেকে সেটাও নাকি থাকবে না। সব মিলিয়ে কোথাও কোন কিছুর অভাব নেই। কু লোকেরাই শুধু অভ্যাসগত অযথা হাউকাউ করছে, আগামীতেও করবে। এরাই উন্নয়ন বিরোধী, প্রগতি বিরোধী।
দেশে বছর বছর পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পাল্লা দিয়ে চাকরির বাজারে মন্দার প্রভাবও রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছে। দেশান্তরি হওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এখনকার মন্ত্র, সবার আগে সব কিছুতে আত্মপ্রেম। তারপর আমরা আর মামুদের অটুট বন্ধন আর ভাগ বন্টন। দেশপ্রেম আবার কি? গুটি কয়েক জাতীয় দিবসে মানানসই কাপড়চোপড় পরিধান আর আনুষ্ঠানিকতা কাম বিনোদন তো হয়ই। বয়স্কদের কোন ভূমিকা নেই। তারা নিজেরাও বিত্ত বাসনা চরিতার্থ করণে লিপ্ত। নবীনদের সামনে কোন রোল মডেল নেই। আছে বড় ভাই আর নেতা। সব দিক তারাই সামলাবেন। তাই হেসে খেলে জীবনটা এভাবেই কেটে গেলে মন্দ কি? এদেশে এখন ক্রিকেটার আর মডেলদের পোয়া বারো। তরুণেরা সেখানেও ঢু মারছে। মীর মোশাররফ হোসেন তাঁর বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থে অর্থকে পাতকী অর্থ বলেছিলেন। সেই পাতকী অর্থের জন্য আমরা সবাই এখন চাতকীর ভূমিকায়। কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই। অফিসের নিম্নপদস্থ ব্যাক্তিরও দু-চার-পাঁচ শ কোটি টাকা আছে। ছাত্র নেতাদের দেশে বিদেশে যা আছে, যা প্রকাশিত হয় মাঝেমধ্যে, তাতে চক্ষু কপালে উঠার মত অবস্থা। পাড়ার মাস্তান, নারীর ঠিকাদারদেরও দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদ। ব্যাংকের ভল্ট ফাঁকা করে বিদেশে পাচার এখন আর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে না। যার যেখানে থাকার কথা সে সেখানে নেই। এটাই এখন ‘স্বাভাবিক মান’ হয়ে গেছে। অযোগ্যদের আস্ফালন মাত্রা রীতিমত রক্ত গরম করার মত। অর্ধ শিক্ষিতরা আজ মঞ্চে প্রধান প্রধান চেয়ার দখল করে বাণী বিতরণ করে বেড়াচ্ছে। তাদের সেই মধুর বচন না শুনে উপায় নেই। পিঠে পিটুনি পড়বে, ভাগ্যে থাকলে ভবলীলাও সাঙ্গ হতে পারে। এখন কোন পেশা নিয়ে কোন কথা বলা যায় না। এর পরিণতিতে রণ-ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারেন। জবাবদিহিতা, দায়িত্ববোধ শব্দগুলো এখন দুর্বলদের বিরুদ্ধে সুবিধামত প্রয়োগযোগ্য। কারো সামনে কোন লক্ষ্য স্থির নেই। সবাই ইতিউতি দৌড়াদৌড়ি করছে। ভাবটা এমন যে, বলা তো যায় না। কোথায় ভাগ্য লাইগ্যা যায়?
নেশা এখন শুধু মাদকে সীমাবদ্ধ না। পরস্ত্রী আর পরশ্রীতেও। নেশা এখন খেলা আর মেলাতেও। নেশা এখন জুয়া আর পরধন লুন্ঠনে। তাই কোন কিছুতেই এখন আর কুচ পরোয়া নেই। অষ্টপ্রহর কানে মিউজিক সিস্টেম চালু রেখে ড্রাইভ করতে ভালো লাগে। রেললাইনের উপর দিয়ে আনমনে হাঁটতে হাটঁতে, বাইক নিয়ে শ কিলো স্পীড তুলে রোমাঞ্চ করতে করতে আত্মহনণেও পরোয়া নেই। এত কিছুর পরেও কেউ কোন কিছুর দায়ভার নিচ্ছে না। যার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের অডিও-ভিডিও নেট দুনিয়ায় ভাইরাল সে-ও লাইম লাইটে এসে বা মিডিয়া ভাড়া করে এনে বেমালুম অস্বীকার করে পাল্টা হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে। ডিভোর্সের সংখ্যা দিন দিন উল্লফন স্টাইলে বাড়ছে। এতে যেন কারো কোন উদ্বেগ নেই। ভাবটা এমন যেন ব্যাট করতে ক্রিজে নামলে উইকেটের পতন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। বরং আজকাল হার্ড হিটার ব্যাটারদের কদর বেশি।
তরুণদের কাছে আজ সেলিব্রেটি আর মডেলরা উৎকৃষ্ট মডেল। তারা আবার বিভিন্ন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড এম্বাসেডরও। মনে মনে অনেকেই এদের ছায়া অনুসরণ করছে। মোটকথা আমাদের কারো সুনির্দিষ্ট গন্তব্য জানা নেই। লক্ষ্য স্থির নেই। কম্পিটিটিভ মার্কেটে যেমন ভেরিয়েবলসের উঠানামার উপর মূল্য ও যোগান নির্ধারিত হয়; সেরূপ। তাই পাবলিক হন্যে হয়ে শ্বাস নেওয়ার জন্য কসরত করছে। বোধের ঘরে এখন একটাই উজ্জীবনী মন্ত্র ‘হেসে খেলে জীবনটা যায় যদি যাক না’। এর বিপরীতে কাউকে যে কিছু বলবেন বা জিজ্ঞেস করবেন, “পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছো”- তারও উপায় নেই? আরেকটু আগ বাড়িয়ে কাউকে যে পরামর্শ দিবেন, তিষ্ঠ ক্ষণকাল- তারও জো নেই। তাহলেই আপনার কর্ম সাবাড়। আপনি প্রগতি বিরোধী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, মৌলবাদী, প্রাচীনপন্থী, গায়ে মানে না আপনি মোড়ল। দেখবেন আপনার আশেপাশে কেউ নেই। স্বজনরা সটকে পড়েছে। কেউ কেউ মজা নিচ্ছে। কেউ কেউ গায়ে পড়ে জ্ঞান দিতে আসছে। আর কেউ কেউ নির্দয়ভাবে পেছনে ফেউ লাগিয়ে দিচ্ছে। দেখবেন আপনার পরিবার ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছে, আপনার সামাজিক অবস্থান রাতারাতি বর্জন তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। পদস্থরা শাসাচ্ছে। প্রতিপক্ষরা খোঁচাচ্ছে। অধীনস্থরা সরে যাচ্ছে। দেখবেন চটজলদি আপনি বিরাট এ পৃথিবীতে বড় একা হয়ে গেছেন। এ অবস্থা অবশ্যই সাময়িক। তবে এর ব্যাপ্তিকাল কতটুকু তা কারো জানা নেই। আমরা সবাই যেন এখন ‘এক্ট অব গডে’র দিকে চেয়ে আছি। আমাদের এ তমসা কাল সহসাই কেটে যাক। আবার আমরা গুছিয়ে নেই সবকিছু পরিকল্পনা করে। আমাদের সবার সুবোধ জেগে উঠুক। স্বপ্ন দেখার কোন বিকল্প আছে কি?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই