ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ: কারণ ও পরিণতি
১৪ মে ২০২৪ ১৪:৪৫
আধুনিক সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণা ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব অর্জন করছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হলো ব্যক্তির স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন এবং আত্ম-প্রকাশের উপর জোর দেওয়ার একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা। এটি ব্যক্তিকে সমাজের নিয়ম ও রীতিনীতির চেয়ে নিজস্ব মূল্যবোধ ও বিশ্বাস অনুসরণ করার অধিকার প্রদান করে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বৃদ্ধির অনেকগুলি কারণ রয়েছে। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া ব্যক্তিদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যক্তিদের আরও স্বাধীন ও আত্মনির্ভর হতে সাহায্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইন্টারনেটের প্রসার ব্যক্তিদের তথ্য ও জ্ঞানের অভূতপূর্ব অ্যাক্সেস প্রদান করেছে, যা তাদের নিজস্ব মতামত গঠনে এবং তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুসরণ করতে সাহায্য করেছে।
বৈশ্বিকায়ন বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধারণার সংস্পর্শে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিরা নিজস্ব পরিচয় ও মূল্যবোধ সম্পর্কে আরও সচেতন হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে, ব্যক্তিরা ঐতিহ্যবাহী নিয়মকানুন ও রীতিনীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে এবং তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ অনুসারে জীবনযাপন করার জন্য আরও বেশি স্বাধীনতা চাইতে শুরু করেছে।
আধুনিক সমাজে ব্যক্তিগত সম্পদ ও সাফল্যের উপর জোর দেওয়া হয়। এর ফলে ব্যক্তিরা নিজস্ব লক্ষ্য ও স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে শিখেছে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা ও কর্মজীবনের উপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে, ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাদের নিজস্ব স্বপ্ন পূরণ করতে আরও বেশি সক্ষম বোধ করে।
নারীবাদ, হিজড়া অধিকার আন্দোলন ইত্যাদির মতো সামাজিক আন্দোলনগুলি ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমতা ধারণার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই আন্দোলনগুলি ব্যক্তিদের তাদের নিজস্ব পরিচয় গ্রহণ করতে এবং তাদের নিজস্ব অধিকারের জন্য দাঁড়াতে উৎসাহিত করেছে।
ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ, যেমন পারিবারিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস, এবং সামাজিক রীতিনীতি, অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও আত্ম-প্রকাশের সাথে বিরোধপূর্ণ হতে পারে। এর ফলে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের প্রতি হতাশ বোধ করতে পারেন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন।
প্রযুক্তির অগ্রগতি ব্যক্তিদের তথ্য ও জ্ঞানের অভূতপূর্ব অ্যাক্সেস প্রদান করেছে। এর ফলে ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়েছে, যা তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ ও বিশ্বাস গঠনে সাহায্য করেছে।
মানুষ স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা পছন্দ করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ব্যক্তিদের তাদের নিজস্ব জীবনযাপন করার এবং তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুসরণ করার স্বাধীনতা প্রদান করে। এর ফলে অনেকেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
তবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকও রয়েছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ব্যক্তিদের তাদের নিজস্ব পছন্দ ও বিশ্বাস অনুসরণ করার স্বাধীনতা প্রদান করে। এটি সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং ব্যক্তিগত বিকাশকে উৎসাহিত করে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ বিভিন্ন ধারণা ও জীবনধারার প্রতি সহনশীলতাকে উৎসাহিত করে। এটি একটি আরও বৈচিত্র্যময় এবং গ্রহণযোগ্য সমাজ তৈরিতে সাহায্য করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ব্যক্তিদের তাদের নিজস্ব পছন্দ ও কর্মের জন্য দায়িত্বশীল করে তোলে। এটি ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং সামাজিক উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ব্যক্তিদের উপর জোর দেওয়ার ফলে সমাজের মধ্যে সংযোগ ও বন্ধন দুর্বল হতে পারে।
ব্যক্তিগত স্বার্থের উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার ফলে সামাজিক অস্থিরতা ও সংঘাত বৃদ্ধি পেতে পারে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ব্যক্তিদের একাকী ও বিচ্ছিন্ন বোধ করতে পারে।
নারীবাদ আন্দোলন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল এবং এর ফলে নারীদের জন্য ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ পারিবারিক মূল্যবোধের দুর্বলতা এবং পারিবারিক বিচ্ছেদের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ আধুনিক সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাব রয়েছে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা এবং বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি এটি সামাজিক বন্ধন দুর্বল করতে পারে এবং ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি করতে পারে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের সুবিধাগুলি কাজে লাগানো এবং এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবগুলি প্রশমিত করার জন্য ব্যক্তি, সমাজ , বেসরকারি সংস্থা এবং সরকারের পক্ষ থেকে সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সারাবাংলা/এসবিডিই
ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ: কারণ ও পরিণতি মুক্তমত মো. বজলুর রশিদ