Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা

অমিত বণিক
৩১ মে ২০২৪ ২০:৩৭

তামাক ব্যবহার বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর একক সবচেয়ে প্রতিরোধযোগ্য কারণ এবং বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১০ জনের মধ্যে ১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর জন্য তামাক দায়ী। বিশ্বের প্রায় ৯০% তামাক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উৎপাদিত হয় এবং বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বের মোট তামাকের মধ্যে ১.৩% তামাক উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ। তামাকের কারণে প্রতি বছর আমাদের দেশে মোট জিডিপির প্রায় ৩% ক্ষতি হচ্ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশের পদক্ষেপ ও অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক সূচক প্রকাশ করে গবেষণা ও উদ্ভাবনভিত্তিক আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ‘উই আর ইনোভেশন’। ‘অ্যাফেক্টিভ অ্যান্টি-স্মোকিং পলিসি গ্লোবাল ইনডেক্স’ শীর্ষক ওই সূচকে চলতি বছর বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে আইনগত দিক, নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, বিপণন ও কর ব্যবস্থাসহ ১১টি বিষয় সামনে রেখে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে তথ্যে বলা হয়েছে, ক্ষতিহ্রাস কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করা সম্ভব । তামাক চাষের জন্য বিপুল পরিমাণ কীটনাশক ও সারের প্রয়োজন হয়, যা ধীরে ধীরে জমির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। ফলে তামাক চাষে ব্যবহৃত জমিতে খাদ্য উৎপাদন চরম ভাবে ব্যাহত হয়। এছাড়া চুল্লির তাপে সবুজ তামাক পাতা শুকিয়ে বিড়ি-সিগারেট তৈরি করায় বনজ সম্পদের ক্ষতি হয় এবং চুল্লির চারপাশের বায়ু মারাত্মকভাবে দূষিত হয়।

বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার (ধূমপান এবং ধোঁয়াবিহীন উভয় প্রকারই) স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করে এবং আমাদের দেশের অর্থনীতি এবং উৎপাদনশীলতার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তামাকজনিত রোগের কারণে বার্ষিক ১,৬১,০০০ এর বেশি লোক মারা যায় (টোব্যাকো অ্যাটলাস ২০১৮), এবং প্রায় ৪০০,০০০ মানুষ অক্ষম হয়ে পড়ে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৪)। বাংলাদেশে প্রায় ৩.৭৮ কোটি মানুষ সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলের মতো বিভিন্ন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। এছাড়া প্রায় ৮ কোটি মানুষ গণপরিবহন, জমায়েত এবং আবাসস্থলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার (গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস ২০১৭)। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির তথ্যমতে, বাৎসরিক আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ৩০,৫৭০ কোটি টাকা, যা তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হয়। ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) মে, ২০০৩ সালে জেনেভায় ৫৬তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণ এবং তামাকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে অনুমোদন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ এই চুক্তিতে প্রথম স্বাক্ষরকারী এবং ২০০৪ সালে এটি অনুমোদন করে। চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশ সরকার এফসিটিসির আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) প্রণয়ন করে এবং ২০১৫ সালে রেগুলেশনস প্রণয়ন করে। আইনটি ২০১৩ সালে কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন করা হয় এবং ২০১৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধি অবশেষে প্রণীত ও কার্যকর করা হয়েছে। আইনটি পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান নিষিদ্ধ করে এবং পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান না করার সাইনবোর্ড প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের সব প্রকার বিজ্ঞাপন প্রচার বা পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করা হয়। তামাকবিরোধী অধিকারকর্মীরা যুবকদের তামাক সেবন থেকে বিরত রাখার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপের পরামর্শ দিচ্ছেন। সিগারেটের খোলা ও খুচরা বিক্রি তরুণদের সিগারেট কেনার সুযোগ দিচ্ছে। এ ধরনের সুযোগ তরুণদের কাছে সিগারেটের সহজলভ্যতা তৈরি করেছে। এটা বন্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বর্তমানে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে সরকার তামাকের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে অনলাইন প্রচারণা চালানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা পারে। এটি তরুণদের মধ্যে সচেতনতার পরিবেশ তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের উচিত তাদের সন্তানদের ওপর তাদের নজরদারি জোরদার করা যাতে তারা ধূমপান না করে। স্কুলের পাঠ্যসূচিতে তামাকের কুফলের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারেন। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তামাকবিরোধী সচেতনতামূলক প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রেণীকক্ষে বক্তৃতা দেয়ার সময় শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের তামাক ব্যবহার না করার পরামর্শ দেয়া, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। কোনো দোকানদার যেন ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীদের কাছে সিগারেট বিক্রি করতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যেতে পারে।

দেশে যুবকদের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের প্রবণতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ একটি জাতীয় সমীক্ষা চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন; যাতে করে দেশে তরুণ তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য যুবকদের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের বিষয়টি জানা যায়। এটি তরুণ তামাক ব্যবহারকারীদের সংখ্যা খুঁজে বের করতে এবং এটা বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহায্য করবে বলে তিনি মনে করেন।

যুবকরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তাই তাদের মধ্যে ধূমপানের অভ্যাস দেশের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা তামাকবিরোধী আন্দোলনে অনেকাংশে সহায়ক হতে পারে। তামাকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন খুবই কার্যকর। রাজনৈতিক দলগুলোও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হলে তামাকমুক্ত দেশ করার অঙ্গীকার করতে পারে।

তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তামাক দ্বারা সৃষ্ট একাধিক ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে যদি আমরা তামাক চাষ কমাতে পারি, তাহলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করা আমাদের জন্য সহজ হবে। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক নির্মূল করার জাতীয় লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এর উৎপাদন ও ব্যবহার কমাতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনটি শক্তিশালী হলে মধ্যবয়সী ও যুবকদের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার অনেকাংশে কমে যাবে। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক নির্মূলের ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, বেসরকারি সংস্থা ও গণমাধ্যমকে সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন।’ ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে এক বাণীতে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি তামাকমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। রাষ্ট্রপতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’ পালনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। ধূমপান ও তামাক মানুষকে নীরবে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্য সেবন জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহারে ফুসফুস ও মুখগহ্বরসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ক্যান্সার, এজমা, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসসহ নানাবিধ জটিল ও প্রাণঘাতী অসংক্রামক রোগ দেখা দেয়। ধূমপান মাদক সেবনের প্রবেশ পথ হিসেবেও কাজ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক সেবনের ফলে পৃথিবীতে বছরে ৮৭ লক্ষাধিক মানুষ অকালে মারা যায় যা প্রতিরোধযোগ্য। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপান এবং তামাক সেবনে সর্বোচ্চ ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে শিশু-কিশোররা। শিশু-কিশোরদের ই-সিগারেট, হিটেড টোব্যাকোসহ সকল ধরণের তামাকজাত পণ্য থেকে দূরে রাখতে প্রচলিত গণমাধ্যমসহ অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে। এ প্রেক্ষিতে এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’ -যথার্থ হয়েছে বলে মনে করি। রাষ্ট্র শিশু-কিশোরদের তামাকের নেশা থেকে বিরত রাখতে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫’ এর সংশোধন এবং ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০১৫’ প্রণয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আঠারো বছরের কম বয়সীদের নিকট তামাক বিক্রয় এবং তামাকজাত দ্রব্যের সব ধরণের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নাটকে ধূমপানের দৃশ্য প্রদর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সিনেমায় দৃশ্যায়নও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। একটি সুস্থ সুন্দর তামাকমুক্ত সমাজ ও প্রজন্ম গঠনে বিদ্যমান আইনের কঠোর বাস্তবায়নে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। তামাকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পাশাপাশি সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, বেসরকারি সংস্থা ও গণমাধ্যমের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। আসুন জাতীয় স্বার্থে আমরা সবাই তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধে একসাথে কাজ করি।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সারাবাংলা/এজেডএস

অমিত বণিক তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর