Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পরিবেশ রক্ষা করি, বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ি

অলোক আচার্য
৫ জুন ২০২৪ ১৪:৫৩

বিশ্বজুড়েই পরিবেশ দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেই মাত্রা এমন যে এখনই পদক্ষেপ না নিলে মানব সভ্যতাই হুমকিতে পড়বে। উন্নয়নের নামে সারাবিশ্বেই পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞ চলে বছরব্যাপী। উন্নয়নের প্রথম বলি হয় গাছ। অথচ এসব গাছেরও জীবন আছে। তাদেরও কষ্ট হয়। মরে যাওয়ার অনুভূতি আছে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু এ কথা বহু আগেই প্রমাণ করেছেন। গাছ কেটে আমরা অথবা এই শিল্প নির্ভর বিশ্ব যে মহাভুল করছে সেকথা স্বীকার করলেও সেখান থেকে বাঁচার পথ না খুঁজে ফের গাছ কাটাতেই ব্যস্ত আছে। যার ফল পাচ্ছি হাতেনাতে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ অতীতের রেকর্ড তাপমাত্রায় পুড়েছে। পাকিস্তান পুড়ছে। ভারতও পুড়ছে। আবার অন্য প্রান্তে ভয়াবহ বন্যায় ও ভূমিধ্বসে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রকৃতির এই উল্টাপাল্টা আচরণের পেছনে রয়েছে পরিবেশ দূষণের ভূমিকা। বিবিসি নিউজ বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, অতি উত্তপ্ত এই বিশ্ব আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশ উদ্বেগজনক মাত্রার দূষণ ও পরিবেশগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। এটা তুলনামূলক বেশি ক্ষতি করছে দরিদ্র, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক ও নারীদের। এই তথ্য জানিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ৭২ হাজারের বেশি মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে। এ ছাড়া দূষণের কারণে ওই বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস (সিইএ)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে পরিবেশ দূষণের ক্ষয়ক্ষতির এসব চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণ, অনিরাপদ পানি, নিম্নমানের পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যবিধি এবং সিসা দূষণ বছরে ২ লাখ ৭২ হাজারের বেশি মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ। এরফলে বছরে ৫২২ কোটি দিন অসুস্থতায় অতিবাহিত হয়। ঘরের ও বাইরের বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই ক্ষতির পরিমাণ ২০১৯ সালের জিডিপি’র ৮ দশমিক ৩ শতাংশের সমান।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন বহুমুখী। অর্থাৎ জলবায়ুর কারণে আমাদের ক্ষতির বোঝা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জিওগ্রাফির একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রবল গরম ও খরার মুখোমুখি হতে চলেছে বিশে^র ৯০ শতাংশ মানুষ। নেচার সাসটেনেবিলিটি পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,প্রবল উষ্ণায়ন ও স্থলভাগে পানির সংকট- এ দুই কারণে পৃথিবীজুড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দশগুণ বাড়বে। কার্বন নিঃসরণও সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকবে। এসব কারণে অর্থনীতিও প্রবাভিত হবে। ধনীরা আরও ধনী হবে এবং গরীব আরও গরীব হবে। খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে এ পরিস্থিতি। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, খরাবিধ্বস্ত হর্ন অব আফ্রিকায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ২২ মিলিয়ন পৌছেছে। কেনিয়অ,সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খরার মুখেপড়েছে। বিশে^ জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন বিষয়ক দপ্তর (ইউএনডিআরআর) বলছে, চলতি দশক অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে বছরে ৫৬০টি। যা দৈনিক গড়ে দুইটির কাছাকাছি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ দুই দশকে প্রতি বছর ৩৫০ থেকে ৫০০ টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ দুর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ্ববাসী। এটি আগের তিন দশকের গড় দুর্যোগের তুলনায় পাঁচ গুণের বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জেরে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশ বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ এর ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্থ দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। শিল্প যুগ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর আবহমন্ডলের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। পৃথিবী নামক এই গ্রহটির ধ্বংস হওয়ার সম্ভাব্য দুটি কারণ রয়েছে। এর দুইটি কারণই মানবসৃষ্ট। একটি হলো যুদ্ধ এবং অপরটি হলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশ দূষণ শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সিসা বিষক্রিয়া শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করছে। এর ফলে বছরে প্রাক্কলিত আইকিউ ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২০ মিলিয়ন পয়েন্ট। গৃহস্থালিতে কঠিন জ্বালানির মাধ্যমে রান্না বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস এবং তা নারী ও শিশুদের বেশি ক্ষতি করছে। শিল্পের বর্জ্য এবং অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্য এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসা অপরিশোধিত ময়লাযুক্ত পানির কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানির গুণগতমানের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সময়মতো এবং জরুরি হস্তক্ষেপ, উন্নত পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) এবং সিসা দূষণ প্রতিরোধ করা গেলে বছর ১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি অকাল মৃত্যু ঠেকাতে পারে। সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ, রান্নায় সবুজ জ্বালানির ব্যবহার এবং শিল্পকারখানা থেকে দূষণ রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বায়ুদূষণ কমাতে পারে। বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং এই প্রতিবেদনের সহ-প্রণেতা আনা লুইসা গোমেজ লিমা বলেন, সময়োচিত এবং সঠিক নীতি ও কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণের ধারা পাল্টে ফেলতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষা জোরদারে পদক্ষেপ এবং রান্নায় সবুজ জ্বালানির জন্য বিনিয়োগ ও অন্যান্য প্রণোদনা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি দূষণ কমাতে পারে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এমনকি বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি ঘটছে,মানুষের সম্পদের বিনষ্ট ঘটছে,স্থানচুত্যি ঘটছে এবং জীবিকার পরিবর্তনের মানুষের জীবনযাপনে বিরুপ প্রভাব পরছে। বজ্রপাতের মৌসুমেও বহু হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যেই তীব্র গরম আবহাওয়া বদলানো ইঙ্গিত দিচ্ছে। কয়েকদিন আগেই রোমেল আঘাত করেছে। এভাবে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রেশ শেষ হতে না হতেই আর একটি দুর্যোগ আঘাত করছে। প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও যে ক্ষয়ক্ষতি হয় সেটাও কম নয়। এমনকি পুরো এশিয়া জুড়েই তীব্র তাপপ্রবাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত এপ্রিলে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলে মৌসুমী তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মে মাসের শেষ দিকে তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়। ভিয়েতনামের তাপপ্রবাহ জুন পর্যন্ত স্থায়ী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ২০১৫ সালে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি ছিল একটি বড় পদক্ষেপ। এতে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো আশাবাদী ছিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে আমরা পাশে পাবো। যদিও এই জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের দায় তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু ফল ভোগ করছি আমরাই বেশি। বিশ্বের ১৮০ টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। যে অর্থ ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশগুলোর একটি। প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি বাস্তুচুত্য হচ্ছে অগণিত মানুষ। সেসব মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে চাপ বাড়ছে শহরের উপর। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, কালবৈশাখি, জ্বলোচ্ছাস, টর্ণেডোসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। শহরের উপর চাপ বাড়ছে। ভিক্ষাবৃত্তি বাড়ছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুকিতে রয়েছি আমরা। যদি তা হয় তাহলে আমাদের দেশের একটা অংশ ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু আমাদের দেশ নয়। এরকম নিচু বহুদেশ সমুদ্র গর্ভে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে আমাদের প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। আর প্রকৃতি বাঁচাতে প্রচুর প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে। যে বিপুল সংখ্যক গাছ প্রতিদিন আমাদের প্রকৃতি থেকে কাটা হচ্ছে তার চেয়ে খুবই কম সংখ্যক গাছ লাগানো হচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে যে সবুজায়ন ছাড়া মানব জাতির এ থেকে মুক্তি নেই কিন্তু উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে সংকটই বয়ে আনতে পারে।

লেখক: কলামিষ্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অলোক আচার্য পরিবেশ রক্ষা করি- বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ি মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর