Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দরকার মনের সংস্কার

শফিকুল ইসলাম খোকন
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:০৭

মানুষ আছে তো মন আছে। মানুষের সঙ্গে মনের একটি সম্পর্ক রয়েছে। আর মনের ওপর মানুষের মানসিকতা নির্ভর করে। যেটা ভালো আর মন্দ। এ জন্য অনেক সময় বলা হয়ে থাকে ভালো মনের মানুষ আর মন্দ মনের মানুষ। ভালো মন ভালো মানসিকতা তৈরি করে আর মন্দ মন মন্দ-খারাপ মানসিকতার জন্ম দেয়। সেই মানসিকতা বা মন দিয়ে নিজের, পরিবার, সমাজ, অফিস-আদালত, রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়। পরিবার পরিচালিত হয় পরিবারের প্রধানের মানসিকতার উপরে আর রাষ্ট্র পরিচালিত হয় নাীতিনির্ধারণী, আইন, বিধি দ্বারা। আর সেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন রাজনৈতিক দল। আর রাজনৈতিক দলে যারা থাকেন বা নেতৃত্ব দেন তারাও মানুষ। রাজনীতি যেহেতু একটি বায়োবিও বিষয় কিন্তু নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্যক্তি সেখানেও মনের দরকার। ভালো বা খারাপ। সেই মনের সংস্কারও দরকার।

বিজ্ঞাপন

আলোকিত মানুষ তৈরি মানে ভালো মন ও মানসিকতার মানুষ তৈরি করে তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। আর এটা যদি করা সম্ভব হয় তবে দেশের কাজে ও উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে দেশকে ইতিবাচকভাবে বদলানো সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনভাবে মানুষকে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। ভারতের সংবিধানপ্রণেতা বিআর আম্বেদকরকে নিচু জনগোষ্ঠীর লোক হিসেবে বিবেচনা করে তার শৈশবের শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছিল। নিচু জাতের বলে তাকে শ্রেণীকক্ষের বাইরের বারান্দায় বসে ক্লাস করতে হতো যাতে উঁচু জাতের মানুষরা অপবিত্র না হয়। এ ধরনের মানসিকতা কখনও কল্যাণকর হতে পারে না। কিন্তু বিআর আম্বেদকর নিজে ইতিবাচক মনোভাব ধারণ করতেন বলে সব ধরনের বৈষম্য ও বাধাকে অতিক্রম করে দেশ গঠনে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন। ২০১২ সালে হিস্ট্রি টিভি ১৮ আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা তিনি শ্রেষ্ঠ ভারতীয় নির্বাচিত হন। এখন তিনি সবার কাছে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। এখন যদি বলি বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছুসংখ্যক মানুষ ছাড়া অধিকাংশ মানুষের মাঝে একজন সম্মানের ব্যক্তি; যদিও দেশের রাষ্ট্র নায়কদের ভুলত্রটি থাকবেই, কেউ ভুলে উর্দ্ধে নয়। বঙ্গবন্ধু সর্বজনশ্রদ্ধেও ব্যক্তি থাকলেও সম্প্রতি তাকে ছোট করা হয়েছে। অনেকের মতে বঙ্গবন্ধু ছোট হয়েছেন তার মেয়ে শেখ হাসিনার কারণেই। তাছাড়া মেজর জিয়াউর রহমানকে স¦াধীনতার ঘোষক নিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে বিরোধ রয়েছে। মেজর জিয়া স¦াধীনতার ঘোষক এটি তো অস¦ীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ মানতেই চায় না। যা হোক এ বিষয়টি পরে এক সময় লিখবো আশা করছি।

বিজ্ঞাপন

তবে সবাই যে বিআর আম্বেদকর হবে, বঙ্গবন্ধু হবে, মাওলানা ভাষাণী হবে,মেজর জিয়া সেটা ভাবা ঠিক নয়। তাই যেখানেই বৈষম্য সেখানেই মানসিকতা পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন- আমাদের দেশে শ্রেণীবৈষম্যের বিষয়টি এখনও বিদ্যমান আছে। যা যুগ যুগ ধরে প্রচলিত প্রথা হিসেবেই আছে। এ ধারণা থেকে আমরা বলি নিন্মবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত, আবার কখনো কখনো হিন্দুদের ক্ষেত্রে বলে থাকি সংখ্যালঘূ ইত্যাদি। এই শ্রেণী বিভাজন শোষণের মনোভাব থেকে এসেছে কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। কিন্তু আমি মনে করি এসব মনোভাবই হচ্ছে প্রথম মন থেকে আসে, পরে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে চর্চা হয়। তবে একটি কথা মনে রাখা দরকার এ সমাজে টাকা আর ক্ষমতা থাকলে আর যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের শ্রেণীবিন্যাস একটি সমাজে বিদ্যমান থাকলে কখনোই মানসিকতা পরিবর্তনে সহায়ক হয় না। একসময় বর্ণবৈষম্যের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গরা। শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যে কালোরা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দেশটিতে যারা বর্ণবাদ নিয়ে ভাবছে না- তারা প্রত্যেকেই বলবে, শ্বেতাঙ্গরা এখনও শীর্ষে। তাদের দ্বারা অর্থনীতি এখনও পরিচালিত হচ্ছে। রাজনীতি ও গণমাধ্যমে তুলনামূলকভাবে তাদেরই প্রভাব বেশি। ভালো ভালো ঘরবাড়িতে ও বেশিরভাগ ভালো চাকরির সুবিধা এখনও তারা পাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এসবই সত্য বলে মনে হলেও এটাই একমাত্র চিত্র নয়। এর ঠিক উল্টো পিঠে রয়েছে শ্বেতাঙ্গদের দারিদ্র্যের চিত্র, যা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার তা হল- অবস্থানের দিক দিয়ে দিনে দিনে তাদের অবনতি ঘটছে।

বৈষম্য শব্দটি একটা সময় কম ব্যবহার হতো। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে বৈষম্য শব্দটি এখন মানুষের মুখে মুখে। শুধু তাই নয় টপ অব দ্য কান্ট্রি থেকে ওয়ার্ল্ডে; আমরা যাই বলি, যাই লিখি যাদের জন্য লেখা তারা যদি না দেখে বা না পড়ে তাহলে আমাদের লেখার কোন গুরুত্ব থাকে না। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশ স¦াধীন হয়েছে অনেক জীবনের বিনিময়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালিত হবে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে নির্বাচিত করার মাধ্যমে। কিন্তু স¦াধীনতার পর থেকে আমরা দেখে আসছি যারাই রক্ষক, তারাই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যায়। কিন্তু কেন? আমি বলছি সেখানেও মন-মানসিকতার দরকার। কিন্তু সেই মন মানসিকতা হবে ভালো, সাদা, রুপালী, স¦চ্ছা,সহমর্মীতা, সহানুভূতিমুলক আচরণ যা প্রতিহিংসার বহিপ্রকাশ ঘটবে না, কোন সহিংসতা হবে না। রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকবেই, তাই প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে সহিংসতার মাধ্যমে প্রতিশোধ নয়; এর নাম গণতন্ত্র নয়। আরেকটি বিষয়ও আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়, সমাজে যখন মানবিক বোধ কমে যায় এবং নানা রকম অনাচার বাড়ে, সেই সমাজকে সুস্থ, স্বাভাবিক বলা যায় না। আমরা সে রকম একটা অসুস্থ সময় পার করছি। বিজ্ঞানের কল্যাণে অর্থনীতির ব্যাপক যে উন্নতি হয়েছে, সেখানে এখন পৃথিবীর যেখানেই হোক, খেয়ে-পরে বাঁচার মতো একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধ অনেকটাই লোপ পেয়েছে। উত্তরণ একেবারে হবে বলে মনে হয় না। পর্যায়ক্রমে সেটা হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করতে হবে।

যা হোক এ মুহুর্তে একটি সুন্দর রাষ্ট্র পেতে সুন্দর, স¦চ্ছ, জবাবদিহিমুলক একটি রাজনৈতিক দল সরকার গঠণ করুক এটাই সবার প্রত্যাশা। ঠিক আমারও তাই, তবে তার আগে রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ হতে হবে, যদিও ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা আওয়ামী লীগ ব্যতিত সকল রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করেছেন। রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমেই সংস্কার ও নির্বাচনের পথ দেখাবে এমনটাই প্রত্যাশা করছি আমরা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা প্রবর্তন বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার বিকল্প নেই। ভবিষ্যতে আর যাতে কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারের আবির্ভাব না হয় তা নিশ্চিত করতেই সংস্কার চালাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনের আয়োজনও করতে হবে অন্তর্র্বতী সরকারকে।

বিননপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সবার মানসিকতার পরিবর্তন দরকার: তিনি বলেন, ভোট ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। সেজন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে সংবিধান অনুযায়ী জাতিকে নির্বাচনের মুখোমুখী করতে হবে।’ তার কথার সাথে আমিও সুর মিলিয়ে বলছি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভোট ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ ক্ষেত্রে আগেই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের যেমন মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে তেমনি মনের সংস্কার করতে হবে। পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের মানসিকতার পরিবর্তনসহ রাজনৈতিক দলও সংস্কার করা দরকার। গ্রামের প্রচতি প্র্রথা রয়েছে যেমন মানুষকে সংশোধনের জন্য প্রলয় হয়, মহামারি হয়, বিপদ হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক প্রলয় হয়েছে, অনেক রাজনৈতিক সংকট, দুর্যোগ হয়েছে যা থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তি, দল সংশোধন হয়েছে। এখন আবার সময় হয়েছে রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদের সংশোধন হওয়ার। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিন সেন গুপ্ত এবং বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর দুটি কা নিয়ে কলাম লিখছিলাম- ‘রাজনীতিবিদের সংশোধন হওযা জরুরী’। ঠিক ১৪ বছরের মাথায় এসেও আবারও বলতে হচ্ছে রাজনীতিবিদের সংশোধন হওয়া জরুরী। তার কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকে রাজনৈতিক দল তথা রাজনীতিবিদের হাতে। এ জন্যই তাদের দেশপ্রেম থাকা উচিত আগে, তাদের মন মানসিকতা থাকা উচিত সাদা, তাদের জবাবদিহিতাই বলে দিবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তারা স¦চ্ছ।

সম্প্রতি টিআইবি একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ৫৫ সুপারিশ মালা তুলে ধরেছেন। যদিও ওই সুপারিশমালাগুলো বাস্তবায়ন রাতারাতি হবে না, তারপরেও সময় লাগলেও বাস্তবায়ন জরুরী। বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থ পাচার, গুম-খুনসহ নানা অপকর্মের তথ্য ক্রমেই বেরিয়ে আসছে। এটি শুধু যে আওয়ামী সরকারের আমল তা নয়, বিগত বছরে যে রাজনৈতিক দল সরকারে ছিলো তারাও কমবেশি দুর্ণীতি, অনিয়ম করেছে। অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এসব অপকর্মের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা গ্রহণের পর ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। এ প্রবণতা রোধে এখন থেকেই সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। টিআইবি নতুন বাংলাদেশ গঠনে ৫৫টি সুপারিশ উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে অর্থ পাচার প্রতিরোধে টাস্কফোর্স গঠনসহ নানা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, দুই মেয়াদের বেশি কাউকে প্রধানমন্ত্রী না রাখা। পাশাপাশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা না থাকা, সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নমুক্ত রাখতে নির্বাচনকালীন অন্তর্র্বতী সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনেরও সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে-ব্যাংক খাতে ঋণ জালিয়াতি, সব ধরনের প্রতারণা ও অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক-কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা; বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ বাতিল করা; জাতীয় সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা; নির্বাচিত সংসদ-সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গণ-অনাস্থা প্রকাশের মাধ্যমে অপসারণ এবং ওই এলাকায় নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ ও অপসারণ প্রক্রিয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা, সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ ও সরকারি কর্মচারী (আচরণবিধি) ১৯৭৯ হালনাগাদ করা, দেশে-বিদেশে সব আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এ মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারাগুলো সংশোধন বা বাতিল করা। অধিকাংশই গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি আমরা। অবশ্য এসব সুপারিশকে বাস্তবায়ন করার জন্য সব রাজনৈতিক দল, স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বসে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে একটি রূপরেখা প্রণয়নে উদ্যোগী হতে হবে। লক্ষণীয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাহী ও বিচার বিভাগকে পৃথককরণই শুধু নয়, প্রভাবমুক্ত রাখাটাও জরুরি। সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ ক্ষমতায়িত নিজস্ব সচিবালয় স্থাপনের যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা হলে সুফল মিলবে নিশ্চয়ই। সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন সহজসাধ্য নয়, তবে সময় লাগলেও তা করতে হবে। সেই সঙ্গে কোন কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে, তার তালিকা করাও জরুরি। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে অগ্রাধিকারের তালিকার শীর্ষে রাখা উচিত বলে মনে করি আমরা।

যত কথাই লিখলাম বা বলার চেষ্টা করলাম এসবের মুলে রয়েছে মণ, আগে মন ঠিক করতে হবে। আমি কি করবো, কি করতে চাই, আমার লক্ষ উদ্দেশ্য কি? যা করবো, সেটা ভালো না খারাপ কাজ? সেটি কি জনকল্যাণের জন্য নাকি নিজের স¦ার্থের জন্য, আমার কথায় এবং কাজে অন্য কেউ কষ্ট পাবে কিনা ইত্যাদি দেখার বিষয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ সুফল পেতে হলে যারা দেশ পরিচালনা করবেন, তাদের শাসক নয়, সেবকের মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। জনসাধারণের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে সব ধরনের কর্মপরিকল্পনা তাদের গ্রহণ করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস, যদিও এ কথাটি কাগজ কলমে আর সভা সেমিনারে সীমাবদ্ধ। পরিতাপের বিষয়, যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন-এ কথাটি স্মরণে রাখতে পারেন না। ফলে এক পর্যায়ে মাঝে মধ্যে জনগণকেই তা মনে করিয়ে দিতে হয়। এখন যারাই সরকার গঠণ করবে তাদের মনে রাখতে হবে; রাষ্ট্রকে ভালোভাবে পরিচালনা করতে হবে, নিজেদের দুর্ণীতিমুক্ত থাকতে হবে, স¦চ্ছতা এবং জবাবদিহিতা থাকতে হবে। এটাও মনে রাখতে হবে সহিংসতা কারো জন্য কল্যাণকর নয়, পক্ষ প্রতিপক্ষ থাকবেই তার জন্য সম্পদ নষ্ট, সম্পদ লুট, ভাংচুর, সহিংসতা সমাধান নয়। এ জন্যই মন মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। প্রশ্ন আসতেই পারে মনের সংস্কার কেন প্রয়েজান? সব কিছুর উর্দ্ধে মন, এটা অস¦ীকার করার কোন সুযোগ নেই। ধরুণ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ বছর সরকারের ছিল, একনায়কতন্ত্র, একদলীয় কায়দায় জাতীয় নির্বাচন হওয়াসহ নানা কারণে সমালোচিত, অনেকে ভোট দিতে পারেননি। কোনোভাবেই ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু বিষয়। সব মিলিয়ে যার বহিপ্রকাশ ঘটেছে অভুত্থান। এ জন্য সব বিষয়ই সংস্কার দরকার। মনের সংস্কারের পরেই দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে রাজনীতির সংস্কার। কারণ রাজনৈতিক দলের ব্যানারে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হচ্ছে। এ জন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংস্কার সময়ের দাবি। কারণ আওয়ামী লীগের মতো দীর্ঘ মেয়াদী রাজনৈতিক দলের পদ আগলে রেখে আধিপত্ত বিস্তার, ক্ষমতার অপব্যবহার করা হচ্ছে, শুধু তাই নয় ত্যাগি নেতাদের মুল্যায়ন করা হচ্ছে না।

পরিশেষে, সমাজে যখন মানবিক বোধ কমে যায় এবং নানা রকম অনাচার বাড়ে, সেই সমাজকে সুস্থ, স্বাভাবিক বলা যায় না। আমরা সে রকম একটা অসুস্থ সময় পার করছি। বিজ্ঞানের কল্যাণে অর্থনীতির ব্যাপক যে উন্নতি হয়েছে, সেখানে এখন পৃথিবীর যেখানেই হোক, খেয়ে-পরে বাঁচার মতো একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধ অনেকটাই লোপ পেয়েছে। উত্তরণ একেবারে হবে বলে মনে হয় না। পর্যায়ক্রমে সেটা হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এরপর সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করতে হবে। যেহেতু মানুষের রাগ, অনুরাগ, ক্ষোভ সব কিছুই মন থেকে আসে, তাই আগে আমাদের মন ঠিক করতে হবে, মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, তবেই রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, অফিস-আদালত এবং রাষ্ট্র সব কিছুই পরিবর্তন হবে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষই যদি পরস্পরের প্রতি সহমর্মী হত তবে পৃথিবী সত্যিই একটা সুন্দর জায়গায় পরিণত হত। কিন্তু যেহেতু পৃথিবীব্যাপী সহমর্মিতা ছড়িয়ে দেয়ার কাজটা একটু দুঃসাধ্যই বটে। তারপরও এই দুঃসময়ে রাজনৈতিক দলগুলো শুরু করুন সহমর্মিতা। এই গুণের চর্চা হবে সত্যিকারার্থের এক ‘পুণ্য’, সুগম হবে সমঝোতার পথ, হবে দেশ রক্ষা, রক্ষা পাবে প্রাণ, রক্ষা হবে দেশের সম্পদ। আসুন আমরা সমর্মি হই, সহানুভূহতির হাত বাড়িয়ে দেই।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক

দরকার মনের সংস্কার মুক্তমত শফিকুল ইসলাম খোকন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর