Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশে কেন সক্রেটিস এর মতো শিক্ষক জন্মায় না?

মুহম্মদ সজীব প্রধান
৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:৩৪

এক হাতে অমোঘ সত্য আর অন্য হাতে হেমলক বিষ শক্ত করে ধরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহান দার্শনিক। অগত্যা হেমলক পানে তার কায়া বেয়ে নেমে আসে অবশতার করুণ ঢল। প্রাণ হারালেও জ্ঞানের জগতে অপ্রাণ না হওয়া এই ভাস্বর দার্শনিকের নাম সক্রেটিস। সক্রেটিসকে আমরা একজন দার্শনিক হিসেবে জানলেও সক্রেটিসের আরো একটি চমৎকার পরিচয় রয়েছে। সক্রেটিস একজন মহান শিক্ষক ছিলেন যার সংস্পর্শে প্লেটো, এরিস্টটল এবং আলেকজান্ডারের মতো অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত ছাত্রের অঙ্কুরোদগম ও বিকাশ হয়েছিল। যাদের আবিষ্কার ও সৃষ্টিকর্ম পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। এখানেই নিহিত রয়েছে, একজন শিক্ষকের চৌম্বকীয় ক্ষমতা যার আবেশ পৃথিবীর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত। এবার আসি বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি সক্রেটিসের মতো শিক্ষক নাই নাকি প্লেটো এর মতো ছাত্র নাই? এই বিষয়ে একটা বারোয়ারি বিতর্ক হতেই পারে। তবে আমরা বিতর্কে না গিয়ে আলোচনায় যাই।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সাথে একটি জাতির অগ্রগতির সেতুবন্ধনের তাৎপর্য নিয়ে খোলামেলা আলাপ করি। এই প্রসঙ্গে নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাই বলেছেন, ‘একটি বই, একটি কলম, একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক বিশ্বকে পরিবর্তন করে দিতে পারে।’ সত্যি বলতে, শৈশবে অ, আ, ক, খ শেখা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনে শিক্ষকদের বিকল্প কেউ নেই।

আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালো মানুষ হয়ে দেশ ও দশের সেবায় নিজেদেরকে বিলিয়ে দেওয়া। আর ভালো মানুষ গড়ার মূল দায়িত্ব শিক্ষকগণের উপরই ন্যস্ত। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও আত্মশক্তির বিকাশ, পরিশীলন, উন্নয়ন ও প্রসার সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সমাজ গঠনে, দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে, দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বিশ্বের দরবারে নিজ দেশের গৌরবময় অবস্থান গড়ে তুলতে একজন আদর্শ শিক্ষকের অবদান একজন রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী বা সমাজনেতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এর চির অম্লান দৃষ্টান্ত হলো, আমাদের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের শিক্ষকদের অনস্বীকার্য অবদান। বিজয়ের দুইদিন আগে আমাদের শিক্ষকদের প্রাণোৎসর্গ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। এক কথায় একজন আদর্শ শিক্ষক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও শ্রেষ্ঠ মানুষদের অন্যতম। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে দুইটা বিষয় রয়েছে যেখান থেকে শিক্ষকদের নিয়ে বিতর্কের মোশন শুরু। প্রথমত, আজকাল শিক্ষকরা শিক্ষকতা করেন নাকি চাকরি করেন? দ্বিতীয়ত, বর্তমানে শিক্ষকরা রাজনীতি করেন নাকি রাজনীতিবিদরা শিক্ষকতা করেন? পৃথিবীর সব দেশেই শিক্ষকদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশে, মানুষের মানসপটে শিক্ষাগুরু নিয়ে যে চিরচেনা চিত্র রয়েছে সেটাতে ধুলা জমে ঝাপসা হয়ে গেছে। বাংলাদেশে শিক্ষকদের মর্যাদা ধীরে ধীরে কমার পিছনে অন্যতম কারণ শিক্ষক সমাজের বিতর্কিত রাজনীতি চর্চা। তাছাড়া শিক্ষকদের একটি বড় অংশ ‘শিক্ষক-সত্তা’ কে ধারণ না করে শিক্ষকতাকে শুধু চাকরি হিসেবে দেখেন। শিক্ষকদের এই বিতর্কের বলয় থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। এর বাহিরে রাষ্ট্রীয় সীমাবদ্ধতাও অনেক বেশি। বাংলাদেশে শিক্ষকদের কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অপ্রতুল। যতোটুকু প্রশিক্ষণ হয় সেটা শুধুই নামেমাত্র প্রশিক্ষণ। রাষ্ট্রের বুঝা উচিৎ, শিক্ষক যত দক্ষ ও সৃজনশীল হবেন শিক্ষার্থীরাও ততোটাই সৃজনশীল হবেন। এ ব্যাপারটা সহজে বুঝার জন্যই আলোচনার শুরুতে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল এবং আলেকজান্ডারের কথা উল্লেখ করেছি।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান পৃথিবী প্রযুক্তির কল্যাণে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। এমতাবস্থায় জাতির ভবিষ্যত শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়া অত্যাবশ্যক। তাই শিক্ষকদের সর্বপ্রথম তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের একটি বড় অংশেরই তথ্য প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য দখল নেই। ফলে এদেশের লাখো প্রতিভাবান শিক্ষার্থী অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে যা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়। আধুকায়নের এ সময়ে এসেও আমরা মনে করি শিক্ষা মানে শুধুই দিন-রাত পাঠ চোকানো আর পরীক্ষার খাতায় তা উগলে ফেলা, এমনটাই আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন। অথচ শিক্ষা হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে এবং সমাজ আলোকিত হয়। গবেষণা, চিত্রাঙ্কন, অভিনয়, আবৃত্তি, বিতর্ক কিংবা লিখা-লিখি সহ সকল সহ-শিক্ষা কার্যক্রমই শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এসব কার্যক্রম আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় চোখে পড়ার মতো নয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের বিদ্যাপিঠগুলোতে সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য কোনো শিক্ষক ও পরিবেশ নেই। আর এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষেরও তেমন কোনো ভাবনা নেই। ফলশ্রুতিতে, শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পড়ে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলেও বাস্তব জীবনে তাদের প্রতিভা ও সৃজনশীলতা প্রস্ফুটিত হচ্ছে না। অন্যদিকে, পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো যখন গবেষণায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করছে তখন বাংলাদেশে গবেষণার হার খুবই অপ্রতুল। এর কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে শিক্ষকরা গবেষণা থেকে অনেক দূরে। আর এজন্য শিক্ষার্থীরাও গবেষণার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অবশ্য শুধু শিক্ষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন তা নয় বরং পুরো জাতি বঞ্চিত হচ্ছে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে প্রত্যাশিত গবেষণা নেই সেখানে স্কুল, কলেজে গবেষণার কথা তো চিন্তাই করা যায়না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণা করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ-ই নেই। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরকে সরাসরি দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষক কথাটা শুনলেই আমাদের মাথায় ভেসে ওঠে শিক্ষকদের কষ্ট ও অভাব জর্জরিত জীবন। একজন শিক্ষক সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ছাত্রদের ক্লাস নেন। আমি গ্রামে পড়াশোনা করেছি সেখানে দেখেছি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষকরা কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেল চালিয়ে নিয়মিত স্কুলে যান। এভাবে টানা এক মাস পরিশ্রম করার পর একজন শিক্ষক যে পরিমান বেতন পান সেটা দিয়ে সামাজিক অবস্থান রক্ষা করে জীবনযাপন করা বেশ কঠিন। তবে সময়ের সাথে সাথে শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে যা আশাব্যঞ্জক। এছাড়া, বাংলাদেশে অন্যান্য খাতের চেয়ে শিক্ষাখাতে বাজেট তুলনামূলক কম, তন্মেধ্যে গবেষণার জন্যও বরাদ্দ সীমিত। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেক চিন্তাশীল ও সৃজনশীল শিক্ষক গবেষণা করতে চাইলেও করতে পারেন না। শিক্ষা ও গবেষণা হচ্ছে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ তাই গবেষণা ছাড়া শিক্ষা নিতান্তই মূল্যহীন। কারণ গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার ভিত্তি গড়ে না উঠলে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করে রাষ্ট্র-উন্নয়নে দক্ষ ও মেধাবী জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আর এজন্য প্রথমেই শিক্ষকদের কে গবেষণামুখী করতে হবে এবং সরকারি উদ্যোগে তাদেরকে গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব স্থাপন করতে হবে, গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, ভালো গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশে ও স্বীকৃতি পেতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, দেশের নতুন প্রজন্ম যদি শিক্ষকগণের সান্নিধ্যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে দক্ষতা অর্জন করে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে পারে তা হলেই দেশের দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও পশ্চাৎপদ সংস্কৃতির অবসান ঘটবে এবং একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি হবে। অতঃপর বাংলাদেশের উর্বর মাটিতে দেখা মিলবে সক্রেটিসের মতো মহান শিক্ষক এবং প্লেটোর মতো জগদ্বিখ্যাত ছাত্র।

লেখক: কলামিস্ট, সংগঠক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম

সারাবাংলা/এসবিডিই

বাংলাদেশে কেন সক্রেটিস এর মতো শিক্ষক জন্মায় না? মুক্তমত মুহম্মদ সজীব প্রধান

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর