গুজবে কান নয়, এই বাংলাদেশ সবার
২ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৪
দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা অতিরঞ্জিত করে প্রচার করছে পার্শবর্তী দেশের গণমাধ্যমগুলো। এতে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। বিভিন্ন ঘটনার ভুয়া তথ্য ও ভিডিও ছড়িয়ে এ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অভিযোগ উঠেছে এসব গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে।
বিষয়টি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এক ফোনালাপে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানান। যাতে তারা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ইস্যুতে সরেজমিনে রিপোর্ট করতে পারেন।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর, বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত হিন্দুরা কিছু জায়গায় হামলার শিকার হয়েছেন। ভারত সরকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে একটি কমিটি করেছে এবং ভারতীয় গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রচারিত হচ্ছে। যদিও বেশ কিছু ভুয়া তথ্যও ছড়িয়ে পড়ছে।
নোয়াখালীর সেনবাগে নারী অপহরণের একটি ভিডিওকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে প্রচার করার চেষ্টা করা হয়েছে এসব প্রতিবেদনে। তবে, প্রকৃতপক্ষে এটি পারিবারিক বিরোধের ঘটনা। ওই নারী তার স্বামীর সাথে সংসার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং তার স্বামী তাকে জোরপূর্বক নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। গ্রামবাসীরা এতে বাধা দিয়েছেন।
অনলাইন যাচাই ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিস ল্যাব দুটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে তারা বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ছয়টি ভুয়া তথ্য ছড়ানোর পোস্ট শনাক্ত করেছে। এসব পোস্ট মূলত ভারত থেকে পরিচালিত এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়ানো হচ্ছে, এমনকি কিছু প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমেও তা স্থান পাচ্ছে।
একটি দোকানে আগুনের ভিডিও সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে (টুইটার) প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে এটি বাংলাদেশে হিন্দুদের দোকানে হামলার ঘটনা। এবং ভারতীয় গণমাধ্যম সুদর্শন নিউজও এটিকে হিন্দু বিরোধী হামলা হিসেবে প্রচার করেছে। ডিসমিস ল্যাবের যাচাইয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে দেখানো ঘটনাটি সাম্প্রতিক নয়। আসল ভিডিওটি গত জুলাই মাসে লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীরহাটে সংঘটিত এক অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য, যেখানে ১৫টি দোকান পুড়ে যায়। সুতরাং, এটি স্পষ্ট যে এই ঘটনাটি কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত নয়।
ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করা হয় ভারত থেকে পরিচালিত আরেকটি এক্স অ্যাকাউন্টে। তবে ডিসমিস ল্যাব যাচাই করে দেখেছে, বাড়িটি লিটন দাসের নয়। সেটি নড়াইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়ি। এ সম্পর্কে ৯ আগস্ট দুপুরে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক বার্তায় গুজবে কান না দিতে অনুরোধ করেন ক্রিকেটার লিটন দাস। তিনি ওই বার্তায় বলেন, বিভিন্ন মিডিয়াতে একটি খবর প্রচার হয়েছে আমাদের বাড়িতে হামলার ঘটনা নিয়ে, যার কোন সত্যতা নেই। কেউ এইসব গুজবে কান দিবেন না। আমি এবং আমার পরিবার এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাপদে রয়েছি। আমি বিশ্বাস করি আমাদের দেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ।
বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে সত্য কিন্তু এই হামলার সংখ্যা অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যমে। এ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের বার্তা দেয় দেশটির রাজ্য পুলিশ। ফেসবুকে এক পোস্টে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ জানায়, কিছু স্থানীয় টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যেভাবে খবর প্রকাশ হচ্ছে, তা খুবই দৃষ্টিকটুভাবে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক এবং ভারতের প্রেস কাউন্সিলের নিয়মাবলীর পরিপন্থি। দর্শকদের অনুরোধ, এই ধরনের কভারেজ দেখার সময় নিজস্ব বিচার-বিবেচনা প্রয়োগ করুন এবং মাথায় রাখুন যে চ্যানেলের দেখানো ফুটেজের সত্যতা কিন্তু কোনও নিরপেক্ষ তৃতীয় সংস্থা দিয়ে যাচাই করা নয়। একতরফা, বিদ্বেষমূলক এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারের ফাঁদে পা দেবেন না। শান্ত থাকুন, শান্তি বজায় রাখুন।
ভারত থেকে পরিচালিত আরেকটি এক্স অ্যাকাউন্টে হিন্দু নারীদের নির্যাতন করা হচ্ছে বলে দাবি করে একটি পোস্ট করা হয়। ডিসমিস ল্যাব বলছে, ২০২৩ সালে ভারতের তথ্য যাচাইকারী সংস্থা অল্টনিউজের করা একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, একই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে তখনও ছড়িয়েছিল। বলা হয়েছিল এটি বাংলাদেশে হিন্দুদের নির্যাতনের ঘটনা। যদিও ঘটনাটি বাংলাদেশের নয়। মূল ভিডিওটি ভারতের বেঙ্গালুরু শহরের একটি ঘটনা।
স্বাধীন তথ্য যাচাই করা প্রতিষ্ঠান ‘ফ্যাক্ট ওয়াচ’এর প্রধান অধ্যাপক সুমন রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, কিছু ঘটনা ঘটেছে ঠিকই, যেখানে হিন্দুদের বাড়ি আক্রমণ করা হয়েছে। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ওই ব্যক্তিরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এমন একটা আখ্যান তৈরি করা হয়েছে, যাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে। এটা একেবারেই ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত গণমাধ্যমকে জানান, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার পাশাপাশি ভুয়া ভিডিও ও পুরোনো ছবি ছড়িয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো তথ্য যাচাই না করে বিশ্বাস না করার এবং ভুয়া তথ্য প্রচার না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের সনাতন সম্প্রদায় তাদের আট দফা দাবি আদায়ের জন্য সম্প্রতি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সমাবেশে করেছে তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। ওই সমাবেশ থেকে দাবি আদায়ের জন্য ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। সমাবেশে বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। আমাদের উচিত এসব উসকানিমূলক বক্তব্য থেকে বিরত থাকা।
আসলে আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে ধর্মীয় পরিচয়ের আগে আমরা সবাই বাংলাদেশী। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যখন অংশগ্রহন করেছিলো তখন ধর্মীয় পরিচয়ের আগে আমাদের পরিচয় ছিলো বাঙালি। যে স্বাধীনতার জন্য আমরা হিন্দু-মুসলিম রক্ত দিয়েছি সেই দেশের শান্তি বজায় রাখতে আমরা সবাই কাজ করবো এটাই প্রত্যাশা। কোনো গুজব নয়, এই বাংলাদেশ আমাদের সবার এটা মনে রাখতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই