ইউক্যালিপটাস নিয়ে মব সাইকোলজি ও পরিবেশতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
৯ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:০০
বাংলাদেশে ইউক্যালিপটাস একটি অত্যন্ত পরিচিত উদ্ভিদ। প্লান্ট ট্যাক্সোনমি অনুযায়ী উদ্ভিদটি Martaceae পরিবারের Eucalyptus গণের অন্তর্ভূক্ত।বিশ্বের ৯০টি দেশের মোট এলাকার ১৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে ইউক্যালিপটাস উদ্ভিদ। দক্ষিণ আমেরিকার ৪৪ শতাংশ জমিতে, ব্রাজিলের ৫.৭ মিলিয়ন হেক্টর, চীনে ৪.৫ মিলিয়ন হেক্টর, ভারতের ৩.৯ মিলিয়ন হেক্টর এবং আফ্রিকার ৩.৮ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে রয়েছে ইউক্যালিপটাস। ১৭৭০ সালে স্যার জোসেফ ব্যাংকস নামের এক ব্রিটিশ অভিযাত্রী, প্রকৃতিবিদ এবং রয়্যাল সোসাইটির দীর্ঘদিনের সভাপতি ইউক্যালিপটাস-এর পরিচিতি সারা বিশ্বের মানুষের সামনে তুলে ধরেন।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বা আশরাফুল মাখলুকাত। মহান সৃষ্টিকর্তা সকল জীবকে মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন। ক্ষুদ্র এককোষী প্রোটোজোয়া থেকে বহুকোষী সিংহ পর্যন্ত মানুষের তথা পরিবেশ তন্ত্রের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আজকাল পরিবেশবিদগণ বিষাক্ত সাপ, হিংস্র বাঘ, ভয়ংকর কুমিরসহ সকল জীবকে রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ প্রাণীগুলো মানুষসহ অন্য যে কোন প্রাণীকে যখন তখন খেয়ে ফেলতে কিংবা মেরে ফেলতে পারে। অথচ আমরা কেউ বলছিনা এ প্রাণীগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এগুলোর বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য বিশ্বের কোনো দেশেই কোনো আইন নেই। নামকরা মিডিয়া গুলোতেও পরিবেশতন্ত্র রক্ষায় এদের পক্ষেই প্রচার চালানো হয়। ইউক্যালিপটাসের মতো একটি উদ্ভিদ নিয়ে সকলের মুখেই শুনি এ গাছটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের দেশের সকল নেতৃস্থানীয় গণমাধ্যম এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও দেখা যায় ইউক্যালিপটাস উদ্ভিদের ক্ষতিকর দিক নিয়ে অনেক লেখা, যুক্তি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। আমি নিজেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে এবং প্রায় একত্রিশ বছর ধরে এ বিষয়ে অধ্যাপনা করার সুবাদে ইউক্যালিপটাস প্রশ্নে ঘুরপাক খাচ্ছি। গত বিশ বছরে সাপের কামড়ে ভারতে বার লাখ মানুষ এবং বাঘের আক্রমণে বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর পঞ্চাশ জন মানুষ মারা যায়। কিন্তু ইউক্যালিপটাসের কারণে পৃথিবী ব্যাপী একজন মানুষও মারা যাবার বা রোগাক্রান্ত হবার খবর কারও কাছে আছে বলে আমার জানা নেই। তাহলে ইউক্যালিপটাস নিয়ে এত বেশি নেতিবাচক প্রচারণা কেন? বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘দশ চক্রে ভগবান ভূত’ অর্থাৎ দশজনে মিথ্যা বা ভুলভাবে যদি ভগবানকে ভূত হিসেবে মনে করে তা হলে ভগবানও নাকি ভূত হয়ে যায়। চিলে কান নিয়ে গেছে এরুপ গুজবের খবরে মানুষ সত্যতা যাচাই না করেই চিলের পিছনে দৌড় দেয় অথচ যার কান তার সাথেই আছে। গুজবে মানসিক প্রতিবন্ধী মহিলাকে ডাইনি ভেবে গ্রামবাসীরা পিটিয়ে মেরেছে এমন ঘটনার নজিরও আছে। ইংরেজিতে মব সাইকোলজি বলে একটি কথা আছে যার ব্যাখ্যা হলো অসত্য জিনিষও অতি প্রচারে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ওপর মানসিক প্রভাব বিস্তার করে। গত ২২.০৭.২০১৯ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা থেকে নেয়া ‘ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনির হিড়িক’ শিরোনামে মব সাইকোলজির কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি (৫০) নিহত হয়েছেন। সাভারে ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাত পরিচয় এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী। নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজারে ছেলেধরা সন্দেহে (৬৫) বছর বয়সের এক বৃদ্ধা মহিলা গণ পিটুনিতে মারা গেছে ইত্যাদি। এখানে ছেলে ধরার খবরটি মব সাইকোলজিতে রুপ নিয়েছে। মব সাইকোলজির প্রকৃতি নিয়ে একটি গল্পও তুলে ধরা যেতে পারে। প্রাচীনতম গল্পটা হয়ত অনেকেই জানেন। রানী মা মৃত যমজ সন্তান প্রসব করেছেন। গুজবের ডালপালায় ভর করে দূরতম প্রজার কাছে এ সংবাদ এভাবে পৌঁছাল যে রানী মা এক জোড়া কালো কাক প্রসব করেছেন! প্রসবের পরপরই ওড়ার চেষ্টা করায় কাক দুটির মৃত্যু হয়েছে। কালো সেই কাক দেখার জন্য প্রজারা দলে দলে ভিড় জমাতে লাগলো রাজমহলের আশেপাশে।
মব সাইকোলজিতে শুধু মানুষ নয় পশুপাখী, গাছপালাও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। যে কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা জায়গা নন্দিত থেকে নিন্দিত, প্রিয় থেকে অপ্রিয়, বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হতে পারে । আমার মনে হয় একটি নিরীহ গাছ ইউক্যালিপটাস, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপকারি বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও মব সাইকোলজির শিকার হয়েছে। নিরীহ ইউক্যালিপটাসের পক্ষে দু’চারটি কথা বলার চেষ্টাই আমার আজকের এ লেখার উদ্দেশ্য। তবে জানি না আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং আমাদের দেশের বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত ইউক্যালিপটাসের বিপক্ষে লিখিত যুক্তিগুলো খন্ডন করতে পারা যাবে কি, না তা পাঠক বিচার করবেন। দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাধর্মী জার্নাল অধ্যয়ন করে ইউক্যালিপটাস সম্পর্কে যে সকল ইতিবাচক তথ্য পেয়েছি তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১. Carbon Sequestration potential of Eucalyptus spp.: A review, June 2020. 2. Whz Eucalyptus -The Benefits and Uses of Eucalzptus Tree. 3. Eucalypptus: the Bessings of a Damned Tree.4. On farm evaluation of two fast growing trees for biomass production for industrial use in Adrash Pradesh. 5.Journal of nature science research.(vol 6.No.19.2016) 6. Controversities and Criticism of Eucalyptus Grown as Plantation Speicies. চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদ থেকে প্রকাশিত একশত চুয়াল্লিশ পৃষ্টার গবেষণা জার্নাল ‘ইউক্যালিপটাস ডিলেমা ইন বাংলাদেশ’-এর আলোকে এবং ইউক্যালিপটাস চাষে আমার নিজস্ব বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে ইউক্যালিপটাসকে পরিবেশ বান্ধব এবং মূল্যবান অর্থকরী উদ্ভিদ হিসেবে প্রমাণ করার তথ্য উপাত্ত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
ইউক্যালিপটাসের আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়ায় এবং বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে সিলেটের মালনীছাড়া চা বাগানে ছায়া প্রদানকারি উদ্ভিদ হিসেবে লাগানো হয়। ইউক্যালিপটাসের প্রায় ৭০০ প্রজাতি রয়েছে । বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী ৪৯ প্রজাতির বীজ আমদানি করে। দীর্ঘ ১০ বছর গবেষণার পর দেখা যায় যে, মাত্র তিনটি প্রজাতির ইউক্যালিপটাস আমাদের দেশে ভালো জন্মায়। এ তিনটি প্রজাতির মধ্যে রয়েছে Eucalyptus camaldulensis, E. brassiana Ges E. terreticornis. বর্তমানে বাংলাদেশের সব জেলায় রয়েছে এই তিনটি প্রজাতি। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের প্রচেষ্টার কারণে এ গাছ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বসতবাড়ি, অফিস, আদালত, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, হাটবাজারসহ ফসলের মাঠে বেশি শোভা পাচ্ছে। কিন্তু দু:খের বিষয় পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়াই ইউক্যালিপটাসকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু কারণের জন্য দায়ী করা হয়েছে। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। আর এখানকার নন্দ ঘোষ হচ্ছে ইউক্যালিপটাস গাছ। বিশেষ করে বলা হচ্ছে ইউক্যালিপটাস মাটি থেকে বেশি পানি শোষণ করে, গাছে পাখি বা পতঙ্গ বসে না, কোনো প্রাণী ইউক্যালিপটাসের পাতা খায় না, মাটির উর্বরতা নষ্ট করে, মাটির উপরি পৃষ্ট ধূয়ে যেতে সাহায্য করে, দেশীয় জীবকুলের বৈচিত্রের ভারসাম্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে ইত্যাদি। আশা করি এসকল প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান সম্মতভাবেই দেয়া যাবে।
গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলেছেন ‘What Bengal thinks today, India thinks tomorrow’ তবে আজকাল আবার উল্টোটাও দেখা যায়। ভারতে বন্যা দেখা দিলে পরে বাংলাদেশে সেটার প্রভাব পড়ে। ভারতের কোনো গুজবে আমরাও না বুঝে, না শুনে মেতে উঠি। ভারত থেকেই ইউক্যালিপটাস নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় বিগত শতাব্দীর আশির দশকে। গাছটির চাষাবাদ এত বেশি হচ্ছিল যে, তা থামাতে গুজব ছড়ানো হয়। ভারতের গুজরাটে বেশিরভাগ জমির মালিক দরিদ্র কৃষকদের জমি বর্গা দিয়ে টাকা পেত। কিন্তু দরিদ্র কৃষকরা বর্গার টাকা বা ফসল ঠিকমতো দিতে পারত না বিধায় জমিতে মালিকরা ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করা শুরু করে। জমির মালিকরা ইউক্যালিপ্টাস লাগিয়ে মাত্র ৫-১০ বছরে কয়েকগুণ টাকা বেশি পায়। ফলে সেখানকার কৃষি উৎপাদন কমে যেতে শুরু করে। তাই গণমাধ্যম সোচ্চার হয়ে উঠে। আর পরিবেশ কর্মীরা মিডিয়ার মাধ্যমে ইউক্যালিপটাসের বিরুদ্ধে প্রচার করতে থাকে যে এ গাছটি গুজরাটের বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। জমির মালিক-বর্গাচাষী দ্বন্ধের আসল ঘটনা চাপা পড়ে ইউক্যালিপটাসই নন্দ ঘোষের মতো দায়ী হয়ে যায়।
ভারত বর্ষ ছাড়াও বাইরের দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাও এর সাথে যোগ হয়। তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছে আফ্রিকার দেশ উরুগুয়েতে। বিশ্বের অন্যতম বড় কাগজের পাল্প কারখানা ‘ইউপিএম পাসো দে লস তোরোস’ কাগজ তৈরী শুরু করে ইউক্যালিপটাস থেকে। উরুগুয়ের বার লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো হয়। কাঠ থেকে কাগজ তৈরির জন্য প্রচুর পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। সে সময়ে উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে রেকর্ড পরিমাণ কম বৃষ্টি হয়েছে। তাই সুপেয় পানির অভাব দেখা দেয় নানা জায়গায়। আর পানি সংকটের এই দোষ পড়ে ইউক্যালিপটাসের ওপর। এএফপির মতো নামকরা সংবাদ মিডিয়াও নিউজ করেছে “ইউক্যালিপটাস গাছের কারণেই কি উরুগুয়েতে পানি সংকট?” ইউক্যালিপ্টাস নিয়ে সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমাদের দেশেও এক পর্যায়ে সরকারি অর্থে সরকারি জমিতে ইউক্যালিপ্টাস লাগানো বন্ধের আদেশ জারি হয়। ২০০৮ সালে এক প্রজ্ঞাপনে ইউক্যালিপটাসের চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় এবং এরপর বনবিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করার নীতি গ্রহণ করে। বন বিভাগ কিছু জায়গায় ইউক্যালিপটাস কেটে ফেলে দেয়।
কিন্তু ২০১৫ সালের ২০ জুলাই ভারতের ন্যাশনাল গ্রিণ ট্রাইবুনাল কতগুলো গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলে ইউক্যালিপটাসের পরিবেশগত কোন নেগেটিভ ভূমিকা নেই এবং এটি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকেও ক্ষতিগ্রস্থ করে না। ভারতের বিখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী ভিনাক্র পাতিল ‘লোকাল কমিউনিটিস এন্ড ইউক্যালিপটাস- অ্যান এক্সপিরিয়েন্স ইন ইন্ডিয়া’ (১৯৯৫) বলেন- (১) ইউক্যালিপটাস পানি ও পুষ্টির জন্য অন্য উদ্ভিদের সাথে প্রতিযোগিতা করে না। কারণ ইউক্যালিপটাসের মূল মাত্র ১.৫-২.০ মিটার গভীরে প্রবেশ করে এবং বৃষ্টিপাতের ফলে ভূ-পৃষ্টের উপরিভাগের পানিকে কেবলমাত্র গ্রহণ করতে পারে। (২) এই গাছের জন্য পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন নেই এবং এটি মাটি ধূয়ে যেতে দেয় না। (৩) এটা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে না। ইউক্যালিপটাসের পক্ষে অনেক গবেষণা লব্ধ ফলাফল এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ইতিবাচক মতামত থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের কর্ণাটক হাইকোর্ট নতুন করে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো বন্ধ করে দেয়ার আদেশ প্রদান করে। এতদসত্ত্বেও প্রতি বছর ভারতে ১,৫০,০০০ হেক্টর জমিতে ইউক্যালিপটাস নতুন করে লাগানো হয় এবং যা দ্বারা প্রতিদিন ৭০ মিলিয়ন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই কর্মসংস্থান গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শহরমুখী অভিযাত্রা বন্ধে সহায়তা করেছে। কাগজ কলগুলোর মালিকদের সংগঠণের আন্দোলনের ফলে ইউক্যালিপটাসের পরিবেশ তাত্বিক গুরুত্ব ও অর্থনৈতি গুরুত্ব বিবেচনা করে ৩০ জানুয়রি ২০১৯ সালে কর্ণাটক হাইকোটের বিচারপতি রবি মালিমাথের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৭ সালের কর্ণাটক হাইকোর্টের ইউক্যালিপটাস লাগানোর নিষিদ্ধ করার রায়কে বাতিল করে দিয়ে ইউক্যালিপটাস চাষাবাদের পথকে সুগম করে দেয়।
আরণ্যক ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বন বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইউক্যালিপটাস নিয়ে কী ধরনের গবেষণা হয়েছে এবং এর ভালো-মন্দ দিক নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা সমৃদ্ধ একটি প্রকাশনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ইউক্যালিপটাস ডিলেমা ইন বাংলাদেশ শিরোনামের একটি প্রকাশনার মাধ্যমে এ গাছের বিরুদ্ধে সব অভিযোগের বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের সমন্বয়ে সঠিক বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট জাতীয় পর্যায়ের এক কর্মশালায় ইউক্যালিপ্টাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। এসব কর্মশালার সুপারিশ হচ্ছে, গাছ টি নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়, তা পুরোপুরি সত্য নয়।
উদ্ভিদের জন্ম, বৃদ্ধি ও বিপাক তথা শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য পানির প্রয়োজন রয়েছে। ইউক্যালিপটাসের অনেকগুলো প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী মাত্র তিনটি প্রজাতির উপযুক্ততা প্রমাণিত হয়েছে। তবে গবেষকরা শুধু সতর্ক করেছেন যে, যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪০০ মিলিমিটারের কম, সেখানে ইউক্যালিপটাস লাগানো যাবে না। কারণ তাতে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০৩০ মিমি। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় সিলেটের লালখানে ৩৮৮০ মিমি এবং সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয় নাটোরের লালপুরে ১৫৪০ মিমি। উক্ত ফলাফলে দেখা যায় বাংলাদেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় তাতে দেশের যে কোন স্থানে ইউক্যালিপটাস লাগানো যেতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের মোট পানি সম্পদের পরিমাণ ১৪০৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম), তন্মধ্যে ভূগর্ভে ৫৪.০৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার এবং ভূ-পৃষ্টের উপরে প্রায় ১৩৫০ বিসিএম। গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা যায় ইউক্যালিপটাসের চেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করে এমন উদ্ভিদও আমরা চাষাবাদ করে থাকি। ইউক্যালিপটাসের বর্ধনশীলতা দেখে অন্য গাছের তুলনায় অধিক পানি গ্রহন করে বলে ধারণা করা হয় (Davidson ১৯৯৫)। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণায় দেখা গেছে, ইউক্যালিপ্টাস মাটি থেকে যে পরিমাণ পানি গ্রহণ করে তা কাঠ উৎপাদনশীলতার পরিমাপে বা গাছের মোট বায়োমাসের ভিত্তিতে হিসেব করলে এই পানির পরিমাণ অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় অনেক কম (Chaturvedi ১৯৮৩, Tiwari Ges Maltuv ১৯৮৩.) সেন্টার ফর সাইন্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই) এর প্রতিবেদন অনুসারে ইউক্যলিপটাস গাছের এক কেজি বায়োমাসের জন্য পানি প্রয়োজন ৭৮৫ লিটার, বাবলার ক্ষেত্রে ১৩২৩ লিটার/কেজি, শিশু গাছের জন্য ১৪৮৪ লিটার/ কেজি এবং এক কেজি ধান উৎপাদনে পানির প্রয়োজন হয় ২৫০০-৩০০০ লিটার।এ থেকে সহজেই বোঝা যায় ইউক্যালিপটাসের পানি শোষণের পরিমাণ অন্য গাছের তুলনায় কম। তাছাড়া ইউক্যালিপটাস মাটি থেকে গৃহীত পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মিতব্যয়ী। ইউক্যালিপটাস গ্রীস্মমন্ডলীয় অঞ্চলের উদ্ভিদ হলেও পানির অপচয় রোধের জন্য মরুউদ্ভিদের মতো এর পাতার উপর মোমের আস্তরন এবং পাতায় পত্র রন্ধের এবং কান্ড ও শাখা প্রশাখায় লেন্টিসেলের সংখ্যা কম থাকায় প্রম্বেদন বা বাস্প মোচন প্রক্রিয়ায় কম পরিমাণ পানি নির্গত করে সাশ্রয়ী ভূমিকা পালন করে (Karschon of Heth ১৯৬৭)।
ইউক্যালিপটাস মাটির পুষ্টিগুণকে নষ্ট করে এরুপ ধারণা যথেষ্ট বিজ্ঞান ভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বা সমর্থিত নয়। সকল গাছের ন্যায় ইউক্যালিপটাসও মাটি থেকে পুষ্টি বা প্রয়োজনীয় খনিজ লবণ শোষণ করে। এ জন্য পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদের জন্য গাছ সহ যে কোন শস্য জন্মানোর ক্ষেত্রে জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কোন গাছই নিজে থেকে মাটির পুষ্টি পদার্থ বাড়িয়ে দিতে পারে না। তবে গাছের পাতা, ফুল, ফল বা অন্যান্য অংশ মাটিতে পতিত হলে তা পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছুটা জৈব সার তৈরী করে সেক্ষেত্রে ইউক্যালিপটাসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইউক্যালিপটাস কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশনে গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন বলতে বাতাস থেকে কার্বনডাই অক্সাইড শোষণ করে অজৈব ক্র্বান অনুকে জৈব অনুতে পরিণত করা বোঝায়।একটি গাছ যত বছর বেশি বাঁচে এই সঞ্চিত কার্বন অনুর পরিমাণ তত বাড়ে। ইউক্যালিপটাস গাছ ১০-২০ বছর বয়সের মধ্যে সর্বাধিক পরিমাণ কার্বনকে সংবন্ধন করতে পারে। একটি পরিণত ইউক্যালিপটাস গাছ বছরে ৩৪.৭ কেজি (ডগলাস ২০১১) কার্বনকে সংবন্ধন করতে পারে যা অন্যান্য গাছের তুলনায় অনেক বেশি। এভাবে ইউক্যালিপটাস জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
ইউক্যালিপটাস গাছে পাখি কিংবা কীটপতঙ্গ বসে না। এমনকি কোনো জীব জন্তুও ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা খায় না। এ সকল উক্তি বিজ্ঞান সম্মত ও বাস্তব নয়। ইউক্যালিপটাসের ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে। কোয়েলা নামক একটি প্রাণীর প্রধান খাদ্য এই গাছের পাতা। কোয়েলার জটিল পুষ্টির প্রয়োজন এবং এটি ১২ প্রজাতির ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা খেয়ে তা পুরণ করে। কোয়েলা এই পাতা হজম করতে পারে কারণ কোয়েলার পরিপাকতন্ত্র বিশেষভাবে তৈরি যাতে এক থেকে দু’মিটার লম্বা একটা এপেনডিক্স রয়েছে। মানুষের এপেনডিক্সের দৈর্ঘ্য মাত্র ৮ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। কোয়েলার এইরকম অসাধারণ এপেনডিক্স থাকায় ইউক্যালিপটাস পাতা থেকে তার প্রয়োজনীয় প্রোটিন , কার্বহাইড্রেট এবং চর্বি গ্রহণ করতে পারে।
বাংলাদেশে কাঠের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। দেশের স্থানীয় চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ কিউবিক ফিট (সিএফটি) কাঠ আমদানি করা হয়। ২০২২ সালে ২৩টি দেশ থেকে বাংলাদেশ ৪৮.৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের কাঠ আমদানি করেছে। সামগ্রিক বিবেচনায় কাঠের ঘাটতি মেটাতে ইউক্যালিপটাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।অন্যান্য গাছের তুলনায় ইউক্যালিপটাস থেকে মাত্র ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সেই কাঠ উৎপাদন করা সম্ভব। সেগুন, শিশু, শাল গাছে থেকে ২৫-৩৫ বছরের আগে কাঠ আহরণ করা সম্ভব নয়। ইউক্যালিপসটাস গাছ বছরে ২-৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয় এবং গাছটি সারাজীবনে ৯০ মিটার বা ৩০০ফুট লম্বা এবং এর বেড় বা পরিধি ৭.৫ মিটার বা ২৪.৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। অন্য যে কোনো গাছের চেয়ে ইউক্যালিপটাসের বাণিজ্যিক ও ঔষধি গুণও নেহায়েত কম নয়। ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে বেশ ভারী, শক্ত ও টেকসই কাঠ পাওয়া যায়। এই কাঠ জ্বালানী, আসবাবপত্র, টেলিফোনের খুঁটি, বেড়া, সমুদ্রের বাঁধ এবং পথ তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ইয়েলো বক্স ও আয়রনবার্ক নামে পরিচিত বিভিন্ন গাছে সুন্দর সুন্দর গাম-নাটগুলোর ফুল থেকে মিষ্টি পানীয় পাওয়া যায়, যেগুলোকে মৌমাছিরা একধরনের সুস্বাদু মধুতে পরিণত করে। ইউক্যালিপটাস গাছের বাকল ও কাঠ থেকে কিনো নামে রক্তের মতো টকটকে লাল রঙের এক ধরনের আঠালো পদার্থ নির্গত হয়। জাহাজের কাঠকে শামুকজাতীয় প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা করার কিনো ব্যবহার করা হয়। রক্তক্ষরণ বন্ধের ওষুধ তৈরিতে কিনো ব্যবহৃত হয়। গাছের বাঁকল থেকে ট্যানিন পাওয়া যায়, যা চামড়া ও রং পাকা করার কাজে ব্যবহার করা হয়। ইউক্যালিপটাস গাছের কাঠের গুণাগুণ এবং সর্ববিধ ব্যবহারের গুণাবলী থাকায় বাজারে এই কাঠের মূল্যও তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই ইউক্যালিপটাসের বিরুদ্ধে অপপ্রচার থাকা সত্ত্বেও কৃষক ইউক্যালিপটাস চাষে বেশ আগ্রহী। কথায় বলে লাভে লোহারও কদর বাড়ে আর অলাভে সোনাও মানুষ কিনতে চায় না। ইউক্যালিটাসের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে তাই প্রমাণিত হয়েছে।
মানব সভ্যতার উন্নয়ন, অগ্রগতি, বিকাশ ও পরিপূর্ণতা নির্ভর করে মানুষের সঠিক চিন্তা-ধারার উপর। পরিবেশ তন্ত্র বা ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য বজায় রাখতে উদ্ভিদ,প্রাণীসহ অন্যান্য জীবের নির্দিষ্ট একটি মাত্রা রয়েছে। এই মাত্রার একটু ব্যতিক্রম হলে ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। পরিবেশ রক্ষায় শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমির যেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তেমনি একক কোন উদ্ভিদ প্রজাতি অধিকমাত্রায় রোপণ করা যাবে না। কোনো এলাকায় একটি প্রজাতির সংখ্যা অবশ্যই ১০% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে । উক্ত সীমার বেশি হলে তাকে মনোকালচার বলে যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। ইউক্যালিপটাসের ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিৎ। একটি এলাকার ভারসাম্যপুর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে কখনও ইউক্যালিপ্টাস-এর মনোকালচার করা যাবে না। এছাড়াও যত্রতত্র ইউক্যালিপটাস না লাগানোই ভালো। ইউক্যালিপটাস কে পরিবেশ বান্ধব করতে হতে হলে উপযুক্ত প্রজাতি নির্বাচন করে পরিত্যক্ত অনাবাদী জমি কিংবা যেখানে কোন ফসলই হয় না সেখানে লাগানোই উত্তম। ইউক্যালিপটাস লাগানোর ক্ষেত্রে সঠিক ও বাস্তব সম্মত বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার বিকল্প কিছু নেই। সবুজ অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হবে ইউক্যালিপটাস তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইউক্যালিপটাস নিয়ে মব সাইকোলজি ও পরিবেশতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মুক্তমত