বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন
৩০ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:২৬
সাম্প্রতিক কালে জলবায়ু পরিবর্তন ও জনজীবনে তার প্রভাব নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে বিশেষত: দেশের প্রথম শ্রেনীর দৈনিক পত্রিকায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে এর প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে। বর্তমানে দেশে গ্রীস্মকাল চলছে এর্ং কাল বৈশাখীর প্রকট তুঙ্গে। দেশের হাওর অঞ্চলে এখন পুরোদমে চলছে ধান কাটা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষকের বিরাম নেই। খোলা এই প্রান্তরে কৃষকের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত রোববার ২৬ এপ্রিল রাত থেকে ও গতকাল সোমবার ২৭ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে ২৪ ঘণ্টায় বজ্রপাতে এটি সর্বোচ্চ মৃত্যু বলে জানিয়েছে দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরাম। এদের তথ্যমতে, এ মৃত্যু নিয়ে বজ্রপাতে চলতি মাসে ৪৫ জনের মৃত্যু হলো। এটিও এ বছরের সর্বোচ্চ। আর এ মাসে বজ্রপাতে ৩০ জন আহত হয়েছেন। বজ্রপাতে নিহত হওয়ার সংখ্যাটাই কেবল খবর হয়; কিন্তু এতে যে অনেক মানুষ আহত হয়, তা নিয়ে কথা তেমন হয় না। অথচ বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের ভোগান্তি অনেক।
গত ২০২২ সালে সিরাজগন্জর উল্লাপাড়ায় পন্চক্রোশী ইউনিয়নের মাটিকাটা গ্রামের মাঠের মধ্যে একটি ইন্জিন চালিত ঘরে বজ্রপাতে ১৫জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল যাদের বেশীর ভাগই কৃষি শ্রমিক। এদের মধ্যে দুই বোন সহ তিন কিশোরী রয়েছে। তাদের সবাই গিয়েছিল ফসলের খেতে, কৃষি শ্রমিকরা রোপা আমনের চারা তুলছিল, সে সময় বৃষ্টি শুরু হলে তারা সবাই টিনের তৈরি একটি সেচ ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন বজ্রপাতে ঘটনাস্থলে ১৪জনের মৃত্যু হয়। পরে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছে অপর পাঁচজন। এই ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের পাশাপাশি এলাকাবাসীও শোকাভিভূত। বজ্রপাতে একসঙ্গে অনেক সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর করণ ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে বরযাত্রীদের একটি দলের ওপর বজ্রপাত হলে ১৭ জন মারা যায়। বরযাত্রীর বৃষ্টির সময় নদীতীরে অবস্থিত ইজারাদারের টিনের চালার টং ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল।
বজ্রপাতে প্রাণ হারালেন কৃষিকাজে থাকা ৩ নারী। গত ২৭শে এপ্রিল নিহত ১৩ জনের মধে তিনজন নারী। তাদেরই একজন বিশাখা রানী (৩৫)। তার বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের নাহারা গ্রাম। বিশাখা ওই এলাকার কৃষক হরিপদ সরকারের স্ত্রী। বাড়ির পাশে স্বামী-স্ত্রী মিলে নিজ জমি থেকে ধান তুলছিলেন। এ সময় কাছাকাছি কোথাও বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। এ সময় বিশাখা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। বিশাখা ওই এলাকার কৃষক হরিপদ সরকারের স্ত্রী। হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার আড়িয়ামুগুর হাওরে গতকাল বজ্রপাতে দুর্বাসা দাস (৩৫) নামে এক ধান কাটা শ্রমিক প্রাণ হারান। মিঠামইন উপজেলার শান্তিগঞ্জ হাওরে বজ্রপাতে ফুলেছা বেগম (৬৫) নিহত হন গতকাল। মিঠামইন থানার এসআই অর্পণ বিশ্বাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সকালে বাড়ির পাশে ধানের খড় শুকাতে দিচ্ছিলেন ফুলেছা বেগম। এ সময় বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়।
আবহাওয়াবীদগন গত বলছেন দক্ষিন বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ূ এবং উত্তর হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বাতাসের মিলনে বজ্রমেঘ, বজ্রঝর ও বজ্রপাতের সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের প্রতি বগর্ কিলোমিটার এলাকায় গড়ে ৪০টি বজ্রপাত হয়ে থাকে। এই বিষয়টি যেহেতু পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ত তাই গবেষনা, গবেষক ও জাতীয় নীতি নির্ধারনীতে তার প্রভাব নিয়ে তেমন কোন খবরাখবর পাওয়া যায় না এই কারনে যে গবেষনা বিষয়টি সবসমই একটি অনাগ্রধিাকারের বিষয় যা জাতীয় পরিকল্পনা কিংবা জাতীয় বাজেটেই হউক। তারপরও সারা পৃথিবী ব্যাপী কিংবা বাংলাদেশে কিছুকিছু গবেষনা সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতের অবস্থান নির্নয়ের গবেষনায় দেখা যায় যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মোট বজ্রপাতের সংখ্যা ১৮০০ ছাড়িছে গেছে প্রতি বর্গকিলোমিটারে। নাসার জি আই এস এস এর গবেষক কাল প্রাইস তার গবেষনায় উল্লেখ করেছেন জলবায়ূ পরিবর্তন দুটি প্রকৃতিক দুর্যোগ যেমন বজ্রপাত ও দাবানলকে বিশেষ ভাবে প্রবাভিত করে থাকে এবং পরিবেশে এখন যে পরিমান কার্বন আছে তার যদি দ্বিগুন বৃদ্ধি ঘটে তা হলে বজ্রপাত ঘটবে ৩২ ভাগ। তারমতে বায়ুদুষনের সাথে বজ্রপাতের সম্পর্ক খুবই নীবিড়। বেশির ভাগ গবেষকই মনে করেন বাসাতে সালফার ও নাইট্রোজেনের যৌাগগুলোর পরিমান, তাপ শোষন ও সাময়িক সংরক্ষনকারী গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির সংগে বজ্রপাত বাড়া কিংবা কমার সর্ম্পক রয়েছে । অস্ট্রেলিয় প্রবাসি বাঙ্গালী গবেষক উল্লেখ করেছেন দেশের উচ্চশীল গাছপালা কিংবা বনায়ন কমে যাওয়ায় বজ্রপাত ঘটনা ত্বরান্বিত হয়েছে। বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রানহানির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ২০১৬ সালে ১৭ মে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসাবে ঘোষনা করলেও এর কারন অনুসন্ধান কিংবা প্রতিকারের কি উপায় হতে পারে সে বিষয় দেশের আবহাওয়াবিধরা বা দুর্যোগ বিজ্ঞানীরা সে সস্পর্কে কোন তথ্য উপাত্ত দিতে পারছে না। এ নিয়ে অনেক গবেষকের মধ্যে অসোন্তষ্টিও রয়েছে। তারপরও কোন সমস্যা যদি ঘরে এসে উপস্থিত হয় তখন সকলই সজাক হয় কি করা যায় এবং বিষয়টি আসলে এত সহজ নয়।আমরা আমাদের জীবন বাচানোর তাগিদে এখন কিছুটা নড়ে চড়ে বসেছি এবং প্রবাদ আছে ’জলেকুমির ডাঙ্গায় বাঘ’ তার সাথে আরও একটি যোগ হয়েছে ’আকাশে বজ্রপাত’ এখন মানুষ যাবে কোথায়।
এখন বজ্রপাতের কবল থেকে রক্ষা পেতে হলে কী করতে হবে, আর কী করা উচিত নয়, সেটা অনেকেই জানেন না। বজ্রপাত সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। তালগাছ লাগানো হলেও এর সুফল মিলতে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে। গাছগুলোকে বজ্রপাত প্রতিরোধের মতো সক্ষম বা বড় হতে কমবেশি ১০ বছর সময় লাগতে পারে। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা জরুরী ভিত্তিতে লাইটনিং অ্যারেস্টার বসানোর ওপর জোর দিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেশের কোন কোন স্থানে লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর বসিয়েছে। এ ধরনের আরও যন্ত্র স্থাপন করা দরকার। হাওরাঞ্চলসহ যেসব এলাকায় বেশি বজ্রপাত হয় সেসব এলাকায় লাইটনিং অ্যারেস্টার যন্ত্র বসানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে বজ্রপাত প্রতিরোধী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। বজ্রপাতের ঝুঁকি প্রশমনে একগুচ্ছ সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর মধ্যে আছে বজ্রপাতের জানালা ও দরজা বন্ধ রাখতে হবে, গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশগুলোর প্লাগ খুলে রাখতে হবে, জলাশয়ে থাকলে দ্রুত উঠে আসতে হবে এবং অবশ্যই বিদ্যুৎ পরিবাহক বস্তুর ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে এবং সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। এখন যে ঝড়-বৃষ্টি হয়, তা খুব বেশি সময় ধরে থাকে না। তাই মেঘ দেখলে অন্তত আধা ঘণ্টা সময়ও যদি নিরাপদে থাকা যায়, তবে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এখন অনেকেই বলছে তাল গাছকে বজ্রপাতের উপশম হিসাবে কাজে কেন বাছাই করা যায় তা অনেকেরই মনে প্রশ্ন এবং কৃষি ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. এম এ ফারুক অনেক আগেই বলেছেন তাল গাছ একটি বহুজীবি উদ্ভিদ যার জীবন কাল নব্বই থেকে একশত বছর, ভূমি সংরক্ষনের সহায়ক সব জমিতে আইলে জম্মায়, মাটির মূল গভীরে বিধায় ফসল ক্ষতিকারক নয়, কম বৃষ্টিতে অধিক তাপমাত্রায় ও তীব্র বায়ু প্রবাহ সহ্য করতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু বীজ বপনের পর বজ্রপাতের ঝুকি হ্রাসের উপযোগী করতে ১৪ থেকে ১৬ বছরের অধিক সময় লাগবে। তবে এই পরিকল্পনার সাথে সুপারি গাছও বিবেচনায় আনা যায় যা দ্রত বর্ধনশীল ৫০-৬০ ফুট উচুতে হয় এবং তাল গাছের প্রতি ৩০ ফুটের মধ্যবর্তী স্থানে রোপন করা যায় ইত্যাদি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
সারাবাংলা/এএসজি