ঢাকা: ‘বিতর্কিত তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ এর ৫৭সহ কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর যে প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তা ‘আলসার’ পরিবর্তন করে ‘ক্যান্সার’ দেওয়ার মত নামান্তরই হয়েছে।’
আইন বিশেষজ্ঞরা তেমনটাই বলছেন। আর সাংবাদিক নেতা তথা সংবাদকর্মীরা বলছেন, এতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হলো।
নতুন আইনের ৩২ ধারায় যা বলা হয়েছে, তাতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অসম্ভব হয়ে পড়বে বলেই মনে করছেন তারা।
ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলো নতুন আইনে যুক্ত করায় আবারও সমালোচনা শুরু হতে পারে বলেও মনে করছেন সংবাদকর্মীরা। জাতীয় সংসদে উত্থাপনের আগেই আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা।
সোমবার (২৯ জানুয়ারি) মন্ত্রিসভায় নতুন এ আইনের খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
দেখা গেছে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এর মধ্যে ২৯ ধারায় মানহানিকর কোনও তথ্য দিলে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া, ৩২ ধারায় সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনও ধরনের তথ্য উপাত্ত, যেকোনও ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
নতুন আইনের খসড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, দাবি ছিল ৫৭ ধারা সমূলে উৎপাটন কিন্তু সেটি করা হয়নি। পুরাতন বিষয়গুলোকে নতুন মোড়কে এনে মূলত ফাঁকিবাজি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, নতুন এ আইনে খুবই অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। আর এ অষ্পষ্টতার কারণে যে কোন মানুষকে সহজেই হয়রানি করা সম্ভব হবে।
সাংবাদিকদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায় ছিল ৫৭ ধারা। এই ৫৭ ধারা অপপ্রয়োগ করে অনেক সাংবাদিকদের জেলে পাঠানো হয়েছে। আমরা সাংবাদিক সমাজ বরাবরই এ ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে মন্ত্রী আশস্ত করেছিলেন ৫৭ ধারা বাতিল হবে কিন্তু আজ নতুন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ৫৭ ধারার বিতকির্ত বিষয় নতুন করে ভিন্নভাবে যুক্ত করা হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক। এটা ধোকা দেওয়ার শামিল।
এ আইন সংসদে উত্থাপনের আগেই বাতিল দাবি করছি তা না হলে আগের মত কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবো, বলেন এই সাংবাদিক নেতা।
বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিষ্ট ফোরামের সভাপতি আরাফাত সিদ্দিকী সোহাগ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনের নামে নতুন যে আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে তা ৫৭ ধারার থেকেও খারাপ হয়েছে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে ৩২ ধারায় যা বলা হয়েছে তাতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় হাতকড়া পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এ আইন বলবৎ থাকলে তথ্য যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ থাকবে না। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও করা যাবে না।
এছাড়া এ আইনের শাস্তির বিষয়টিও অসমাঞ্জস্য রাখা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন এ সাংবাদিক নেতা।
৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে যে আইন আসছে তাতে আলসার নাম পরিবর্তন করে ক্যান্সার নামকরণ করার মত হয়েছে। আমরা এটা মেনে নিতে পারি না, বলেন তিনি।
সাংবাদিক প্রবীর শিকদার বলেন, “যেকোন কিছুর বিনিময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে হবে। কারণ, এটা ছাড়া কোন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না।”
৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে নতুন এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারায় যুক্ত করা হয়েছে। ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয়ভীতি দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
২৫ ধারায় কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখায়, তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
৩০ ধারায় না জানিয়ে কেউ যদি কোনও ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক-বীমায় ই-ট্রানজেকশন করে, তাহলে পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
সারাবাংলা/এজেডকে/এমএম