Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশু থেকে বৃদ্ধা, কে নিরাপদ?


৭ জুলাই ২০১৯ ১৯:০২

মৃত্যু, ধর্ষণ, খুন, কান্না, রক্ত কত কী-ই না প্রতিদিন দেখছি-লিখছি। দীর্ঘদিন ধরে এসব খবরের ভেতরে থাকায় দুঃসংবাদ বা দুর্ঘটনায় এখন তেমন একটা ভাবাবেগ হয় না। বরং নিউজরুমে যত বড় দুর্ঘটনার খবর আসে তত বেশি ব্যস্ত আর মনোযোগী হয়ে পড়ি।

কিন্তু গত কিছুদিন ধরে ধর্ষণ, বিশেষত শিশু ধর্ষণের খরবগুলো আর নিতে পারছি না। কেমন হতবিহ্বল, অসহায় লাগে। কখনো রাগ হয়, কখনো কষ্ট, কখনোবা হতাশা ভর করে।

এমন অনুভূতির তীব্রতা টের পেলাম গত ২৫ জুন (মঙ্গলবার) চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে চাচার হাতে ৯ মাস বয়সী শিশু ধর্ষণের খবরে। এরপর এলো ৩ জুলাই রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গণধর্ষণের শিকার কিশোরীর খবর। একে একে আসতে থাকে নারায়ণগঞ্জ বা নেত্রকোণায় মাদসারা শিক্ষকের ছাত্রী ধর্ষণের খবর…গণস্বাস্থ্যের ক্যান্টিনে ৮ বছরের শিশু ধর্ষণ। সব শেষে ঘুম কেড়ে নিলো গত শুক্রবার (৫ জুলাই) ওয়ারীর বনগ্রামে খালি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া সাত বছর বয়সী সামিয়া আফরিনের মৃত্যুর খবর।

যে ফুটফুটে ছোট্ট সামিয়াকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করেছে ওই ফ্লাটেরই আরেক বাসিন্দা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ গতকাল যখন সামিয়ার ময়নাতদন্ত শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করছিলেন, তখন আমি টিভির শব্দ কমিয়ে দিয়েছি। পাশের সহকর্মীকে বলেছি ফোনে নিউজটা নিয়ে নিতে। খবরটা আর পড়িনি, পড়ার সাহস হয়নি। খবরটা পোর্টালে আপলোড হওয়ার পরে না পড়েই শেয়ার দিয়েছি।

আজ দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে যখন সামিয়ার বাবা আব্দুস সালাম সাংবাদিকদের ঘটনা বললেন আর কাঁদলেন, তখন মনের ভেতরে এক অদ্ভুত তোলপাড় অনুভব করি। আব্দুস সালামের কথাগুলো এখনো কানে ভাসছে, ‘আমার পরীর মতো মেয়েকে কষ্ট দিয়ে মেরেছে। মেয়েটা মাকে বলেছে, মা মাত্র ১০ মিনিটের জন্য ওই বাসায় যাব, একটু খেলে চলে আসব। এসে তোমার পড়াগুলো দিয়ে দেবো।’

বিজ্ঞাপন

সামিয়ার বাবা দেশবাসীকে বলেছেন, ‘যাদের মেয়ে বাচ্চা আছে, তারা আগলে রাখবেন। এক মুহূর্তের জন্য আড়াল হতে দেবেন না। এইসব নরপিশাচদের হাত থেকে খেয়াল রাখবেন।’

কিন্তু ছেলে শিশুরাও কি নিরাপদ?

বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর বিশ্লেষণ করে আজ যে তথ্য তুলে ধরেছে তাতে এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সারাদেশে ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৮ জন ছেলে শিশু। ধর্ষণের পরে ১ জন ছেলে শিশুসহ মারা গেছে ১৬ জন।

কাল রাত থেকে জেদ চেপেছে, বন্ধু-পরিচিত-সমমনাদের নিয়ে একটা কিছু করব। সমাজের বিকৃত মগজ থেকে ‘ধর্ষণ’ শব্দটা উপড়ে ফেলব। কাল থেকে তাই ফেসবুকে অনেক গ্রুপে লিখেছি, আহ্বান জানিয়েছি কিছু একটা করি চলো, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-কিছু একটা।

পরিচিত অনেক সংগঠনের নেতাদের বলেছি, চলেন প্রতিবাদ করি। প্রতিরোধ করি। আর সহ্য হচ্ছে না।
কিন্তু দিনশেষে বুঝলাম সংবাদকর্মী হিসেবে লেখাই আমার কাজ। কিন্তু কী লিখব? সেই একই কথা, একই বক্তব্য- বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা…

আজও দেশের একাধিক মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ও নারীনেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। মনে হয়েছে, গত ১৫ বছর ধরে তারা একই কথা বলছেন, একই বক্তব্য দিচ্ছেন। আর আমরা তা লিখছি।

সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে আন্তরিকতা বা সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই আজ খবরের জন্য বক্তব্য নিতে গিয়ে তাদের দু’একজনের ওপর রাগও করেছি। বলেছি, কেন কোনো মুভমেন্টে যাচ্ছেন না? কেন ভিন্নভাবে বলছেন না? কেন আইন সংস্কার হবে না? উত্তরে তাদের বক্তব্য সেই একই রকম, ‘যে আইন আছে তার প্রয়োগই তো ঠিক মতো হয় না। দ্রুত বিচার আইন শুধু নামেই ‘দ্রুত’। রাষ্ট্র না এগিয়ে এলে এর মূল উৎপাটন সম্ভব না।

বিজ্ঞাপন

মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম আপার সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়। সুপ্রিমকোর্টের বারান্দায় বা তার চেম্বারে বিভিন্ন সময় আইন বা আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে কথা হয়েছে। বিভিন্ন মামলার খবর সংগ্রহের ফাঁকে আড্ডাও দিয়েছি বহুবার। আজ ফোনে তিনি ধর্ষণের মামলা নিয়ে বললেন, আইন আর কত পাল্টাবে? বিদ্যমান আইনের প্রয়োগই তো ঠিক মতো হচ্ছে না। দ্রুত বিচার শুধু নামেই দ্রুত। নির্দিষ্ট সময়ের পরও সময় বাড়ানো যায়। পুলিশ থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু যদি ঠিক থাকতো তাহলে একটা কথা ছিল। স্পেশাল আইন করেও কোনো লাভ নেই। পুলিশের রোল ঠিক নেই, তদন্ত হয় না। মামলা হয় অজ্ঞাতনামা।

তিনি বলেন, পুলিশ রাজনৈতিক মামলা যত গুরুত্ব নিয়ে দেখে ততটা গুরুত্ব এসব মামলায় দেয় না। এতো সময় কোথায় পুলিশের? সবার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না কেউ? হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) ঠিক মতো কাজ করছে না। পুরুষদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে শিশুরা। বিকৃত আকাশ সংস্কৃতি ধর্ষকদের আকৃষ্ট করছে। তারা কম বয়সীদের দিকে ঝুঁকছে। কারণ ছোটরা প্রতিরোধ করতে জানে না।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম জানান, সম্প্রতি দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আর শিশুদের প্রতি চলমান সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

পাড়ায় পাড়ায় কমিটি গঠন করে এই ধর্ষণ প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে অভিভাবক, শিশু সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা, স্কুল-কলেজ এবং পাড়ার তরুণদের সম্মিলিতভাবে এই অপরাধ ঠেকাতে এগিয়ে আসতে হবে বলেও মনে করেন শাহীন আনাম।

তিনি আরও মনে করেন, বিচারহীনতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা অসহনীয় অবস্থায় পোঁছেছে। আর শিশু ধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

কোস্ট ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক ফেরদৌস আরা রুমি হতাশার সঙ্গে জানান, এসব নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। দেশের পুরুষদের মগজে সমস্যা। এই সমাজে তাই এখন নারী-শিশু কেউ নিরাপদ না। পাঠ্যবইয়ে যৌন শিক্ষার বিষয়টা নেই। আমি হতাশ। ‘সেক্স’ বিষয়টাকে মগজে ধারণ করে প্যাকেটে বন্দি করে রাখতে হবে –এমন মাইন্ডসেট কেন? ছোট ছোট শিশুরা রেইপ হচ্ছে– ঘরের বা কাছের মানুষরাই হচ্ছে ধর্ষক। সেখানে কী বলব? কাকে বলব? কতদিন থেকে বলছি, লড়ছি-কোনো বিকার নেই। ধর্ষণ আর যৌন হয়রানি কমছে না, বরং বাড়ছে।

ফেরদৌস আরা রুমি, আমার বন্ধু। আমাদের চিন্তার জগৎ অনেকটাই কাছাকাছি। কিন্তু রুমির মতো হতাশ হতে চাচ্ছি না। আমাদের আরও সংগঠিত হতে হবে। আরও প্রতিবাদী হতে হবে। হতে হবে আরও বেশি সচেতন। নিজের ফ্ল্যাট থেকেই শুরু হোক সেই সচেতনার।

ভয় নিয়ে আমাদের সন্তানরা বেড়ে না উঠুক। এ দেশ আমার, আমাদের। এখানে আমাদের সন্তানরা হাসবে, খেলবে, ঘুরবে স্বাধীনভাবে। ধর্ষকের ভয়ে আমরা কুঁকড়ে থাকব না। অন্যায় আর অনিয়মকে প্রশয় দিচ্ছি বলেই আজ শিশু-কিশোরী-তরুণী-বৃদ্ধা কেউ নিরাপদ না।

সংবিধান যদি সত্যি হয়, দেশ যদি সত্যিই স্বাধীন হয় তবে রাষ্ট্রকে আমাদের সেই নিরাপত্তা দিতেই হবে। এটা আমার-আমাদের প্রাপ্য অধিকার। আমাদের নিরাপদ আর ভালো রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

এ রাষ্ট্র আমার। আর যেহেতু রাষ্ট্রটা আমার, তাই এ দেশ তেমনই হবে যেমন আমরা চাইব। আমাদের এই সম্মিলিত চাওয়াকে প্রতিবাদে-শক্তিতে রূপ দেওয়ার সময় এখনই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আর পিছপা হওয়ার সময় নেই আমাদের হাতে।

টপ নিউজ ধর্ষণ নিরাপত্তা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর