লাইসেন্স আছে?
১ আগস্ট ২০১৮ ২০:২১
অগ্রণী স্কুলে আকাশী নীল জামা, সাদা ওড়না-পাজামা আর হলিক্রস কলেজে পুরো দস্তুর সাদার শুভ্রতায় পার করে এলাম গোটা স্কুল কলেজ জীবন। নীল জামা পরিষ্কার থাকলো কিনা, সাদা ওড়না পাজামা কিংবা সাদা জামায় ঠিকমত নীল দেয়া হয়েছে কিনা এই নিয়ে মা খুব চিন্তিত থাকতেন। আমি ওসবের ধার ধারতাম না। পড়া-ই ছিল মূল কাজ। ছবি আঁকা, হাতের কাজ আর বই পড়ে পুরো স্কুলকলেজ জীবন পার করে দিয়েছি। রাস্তায় নামার সাহস আমার হয় নি। রাস্তার নামার সাহস আমার ছিল না। এতো প্রাণ তখনও ধারণ করতে পারি নি ফুসফুসে। পরীক্ষার ফলাফল কেন্দ্রিক নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করেছি কেবল।
সহপাঠীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত দুদিন ধরে দেখছি স্কুল কলেজের বাচ্চাগুলো ফুঁসে উঠেছে। ওদের দেখে মেরুদণ্ডের উপস্থিতি পরখ করলাম। প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে স্যালুট ঠুকে দিলাম। তারা আমাদের চাইতেও অনেক বেশি অগ্রসর, অনেক বেশি সাহসী। সম্মান তাদের করতেই হবে।
এই সেই বাচ্চারা – প্রবীণেরা যাদের কিনা বলেন সারাদিন গেমস খেলে কাটানো, সারাদিন স্যারের বাসায় পড়া, রেস্টুরেন্ট কাঁপানো ফাস্টফুড খেয়ে বড় হওয়া, মনের জানালায় আলোবাতাসহীন মানুষ হয় এরা। প্রবীণেরা নাক শিটকে যায় এরা নাকি পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ে না, সারাদিন ফেসবুকে কাটায়। প্রবীণেরা মোটিভেশন দেন; “বাচ্চাদের ইস্যু” বলে পাশ কাটান সমস্ত দূর্ঘটনাকে। প্রবীণেরা টক শোতে যান; গিয়ে অকথ্য ভাষায় ঝগড়া করেন। তারাই আবার বাসায় ফিরে বাচ্চাদের বলেন, “ভালো মানুষ হও, মানুষের মত মানুষ হও।” আর ফুটফুটে বাচ্চাগুলো জীবনের মানে বোঝে না। জীবনের মানে শুধু এদের কাছে “দোস্ত, খেতে যাবি?” আর খিলখিল হাসি। এই বয়ঃসন্ধিকালীন বাচ্চা গুলো সহপাঠীর রক্তের ধারা বুঝতে গিয়ে থমকে গেছে। এই যাতনা তাদের এতোটাই সিক্ত করেছে যে তারা চাইলেও আর শান্ত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে পারছে না। এরাই বলছে “আমরা নয় টাকায় এক জিবি চাই না, নিরাপদ সড়ক চাই”। হ্যা হ্যা, এরাই বলছে। এরাই বলছে, “আন্দোলন করে আমরা দোষী হলে দোষী বঙ্গবন্ধু, সালাম, জব্বার।”
প্ল্যাকার্ডে মাকে বলে দেয়া হয়ে গেছে, “মা তুমি আমার জন্যে আর অপেক্ষা কোরো না। আমি আর ঘরে ফিরব না”। ওপার থেকে মা বলেছেন, “যা দিলাম তোকে দেশের জন্যে কুরবানি করে”। মায়ের কাছে ফিরে এসেছে একজোড়া রক্তাক্ত সাদা বাটা-নর্থস্টার জুতো। বাবার কাছে ভাঙ্গা ছাতা। মা-বাবা সাজিয়ে রেখেছেন স্মৃতি।
মা-বাবার ট্যাক্সের টাকায় পোষা পুলিশ ওদের মাথা ফাটাচ্ছে, ফাটাবে। এটাই হবার কথা ছিল। অহিংস আন্দোলন সহিংস করার শুরুটা তো কারো না কারো হাত ধরে হতেই হবে। অবশ্যই রাষ্ট্রীয় গুন্ডারা শুরুটা করবে। পালটা মার দিলেই আমার সন্তানেরা হবে রক্তাক্ত। রক্তে ভিজে যাবে আমার আসাদের শার্ট। মাকে লেখা তার শেষ চিঠিটা থাকবে পকেটে, ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
আমাদের এই বাচ্চাগুলোর কথাগুলো না শুনে, ওদের নয় ধারার কথাগুলো না বুঝেই যোগাযোগ মন্ত্রী ওদের পড়ায় ফিরতে বলছেন। শুনে ঠিক হাসি পেল। গতবছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন শিক্ষার্থী মৃত্যুর পরে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য বলেছিলেন সাতদিনের মধ্যে ওভার ব্রিজ করে দেবেন। আমরা ফিরে ছিলাম। আমাদের শিক্ষার্থীরা বুলেট বিদ্ধ হয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রক্তাক্ত হয়ে ফিরেছিল – আসলে ওদের ফেরানো হয়েছিল রাজনীতির মারপ্যাঁচে। কই সেই সাতদিন তো আজও আসে নি, হয়নি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়বাংলা গেটে কোন ওভারব্রিজ। হয়তো রাস্তায় আরও কয়েকটা লাশ পড়লে উপাচার্য আবার আশ্বাস দেবেন। ওভারব্রিজ হয়তো হবে, হয়তো হবে না। কিন্তু যে লাশগুলো পড়ছে তাদের কী হবে? তারা কি কেবল সংখ্যায় ভারি হবে? নাকি বিশ হাজার কিংবা পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েই বেকসুর খালাশ পেয়ে যাবে কোন না কোন মন্ত্রীর শ্যালকরূপী জল্লাদের দল?
প্রিয় যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়েদুল কাদের আমাদের বাচ্চাগুলোকে পড়ায় ফিরতে বলেছেন। বুকের ভেতরে বাচ্চাগুলোর অসহায় কান্না আমি টের পাই। বাচ্চাগুলোর কান্না মগজে জ্বালা ধরায়। হঠাৎ করে মৃত বাচ্চারা সারি বেঁধে আমার সামনে দাঁড়ায়। আমাকে মন্ত্রী ভেবে প্রশ্ন করে বসে ওরা –
“পড়া কাকে বলে মন্ত্রী? আমারই চোখের সামনে মারা যাবে আমার সহপাঠী আর আমি পড়ায় ফিরব? আমারই সহপাঠীর বাবা চিৎকার করে কাঁদবেন তার সন্তানের জন্যে, আমি পড়ায় ফিরব? ঢাকা চট্টগ্রামে শহরে শহরে একের পর এক থেঁতলে যাওয়া লাশ পড়ছে সেগুলো দেখে আমি মুখ বুজে ফুঁপিয়ে কাঁদব? এও সম্ভব? কিন্তু কিন্তু এরকম করতে করতে আমি নিজেই হয়ে উঠব জ্যান্ত লাশ। বেডরুমে গিয়ে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব না, রাস্তায় নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব না তাহলে আমাকে কোথায় নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব? প্রিয় মন্ত্রী, প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজছি। খুঁজে পেলেই পড়ায় ফিরে যাব কথা দিচ্ছি!”
আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি ওদের সামনে। নিঃসীম নিস্তব্ধতায় আমার দিকে তাকিয়ে ওরা হঠাৎ করে হায়েনার হাসি হেসে ওঠে। আমি টের পাই ওরা মন্ত্রীর হাসি অনুকরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাচ্চারা তো ভীষণ অনুকরণ প্রিয়। হাসি শুনে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের “গুলি দিয়ে গেঁথে দিয়েছেন, ইচ্ছে করলেও আলগা হতে পারব না।” আউড়াতে আউড়াতে আমি জ্ঞান হারাই। আমার সাথে জ্ঞান হারায় সমস্ত তেলতেলে সুকুমারবৃত্তি। জ্ঞান হারাবার মুহূর্তে আমার খুব মুর্দা ফকির হতে ইচ্ছে করে। টিকে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ে আমার সন্তানের ক্ষতবিক্ষত লাশেরা আমাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যায় আরেকজনের কাছে। ওখানে গিয়েও জিজ্ঞেস করে একই প্রশ্ন। করুক প্রশ্ন, জবাব এবার পেতেই হবে। জিজ্ঞেস করুক জনে জনে, “লাইসেন্স আছে?”
সারাবাংলা/আরএফ