Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৭ দফার সংলাপে কী পেল ঐক্যফ্রন্ট?


২ নভেম্বর ২০১৮ ০১:২৩

।। তরিকুর রহমান সজীব ।।

ঢাকা: শেষ হলো সংলাপ। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে সাড়ে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা এই সংলাপের পর আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের সবাই এক সুরে জানিয়েছেন, ‘খোলামেলা’ ও ‘ফলপ্রসূ’ আলোচনা হয়েছে। তবে ঐক্যফ্রন্টের যে সাত দফা দাবি নিয়ে এই সংলাপ, তার বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের আশ্বাস বা ইতিবাচক সাড়া মেলেনি বলেই সংলাপ শেষে জানিয়েছেন উভয় পক্ষের নেতারা। এই সংলাপকে রাজনৈতিক আলোচনার সূচনা বলেও অভিহিত করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সদ্য গড়ে ওঠা বিরোধী দলীয় জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যেকার বহুল প্রতীক্ষিত এই সংলাপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে শুরুর পর তারই সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে রাত ১০টা ৪০ মিনিটে শেষ হয় বৈঠক। মাঝখানে নৈশভোজের বিরতিও ছিল সংলাপে।

সংলাপ শেষে গণভবন থেকে বেরিয়ে উভয় পক্ষের নেতাদের বড় একটি অংশই গণমাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানান। তাতে একদিকে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট এই সংলাপকে ‘খোলামেলা’ ও ‘ফলপ্রসূ’ বলে অভিহিত করলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা এই সংলাপে ‘আশাপ্রদ’ কিছু দেখছেন না বলেই জানিয়েছেন। যে সাত দফা দাবি নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল এবং যে সাত দফাই ছিল এই সংলাপের অন্যতম মূল আলোচনার বিষয়, সেগুলো মেনে নিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত না পাওয়ার কারণেই যে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের এই প্রতিক্রিয়া, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রহমান, ১৪ দলের অন্যতম নেতা সাম্যবাদী দলের সভাপতি দিলীপ বড়ুয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমও বলেছেন, সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেন, সংলাপে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আলোচনা অব্যাহত থাকবে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের সবাই-ই জানিয়েছেন, সভা-সমাবেশসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কোনো ধরনের বাধা দেওয়া হবে না। পাশাপাশি বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলার বিষয়েও তালিকা চাওয়া হয়েছে সরকারের কাছে। বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এর বাইরে নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকের উপস্থিতিতে কোনো ধরনের আপত্তি নেই বলেও জানানো হয়েছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি তারা এটাও জোর দিয়েই বলেছেন, সংবিধানের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হবে না।

এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে ঐক্যফ্রন্ট শিবিরে। জোটের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন বলেন, আলোচনা আশাপ্রদ হয়নি। গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জগলুল আফ্রিদও বলেন, সাত দফা মানা হয়নি। মিথ্যা মামলার তালিকা দিতে বলা হয়েছে, তারা দেখবেন।

পরে এক সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ বক্তব্য রাখলেও বিশেষ কোনো সমাধান তারা পাননি। ড. কামাল হোসেন স্পষ্ট করেই বলেন, একটি বিষয় ছাড়া (সভা-সমাবেশের অনুমতি) আর কোনো বিষয়েই কোনো সমাধান পাইনি।

এর আগে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমরা সন্তুষ্ট নই। পরে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মামলা প্রত্যাহার ও তার মুক্তির বিষয়ে সংলাপে আলোচনা হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট কিছু বলেননি। তবে আলোচনা চলতে পারে বলেও মত দেন তিনি।

সংলাপে অংশ নেওয়া উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলে এটুকু স্পষ্ট হওয়া যায়, ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির কেবল তৃতীয় দফাটি নিয়েই স্পষ্ট বক্তব্য তারা পেয়েছেন আওয়ামী লীগের কাছে। বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার এই দাবি সম্পূর্ণভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন উভয় দলের নেতারাই।

এছাড়া, ষষ্ঠ দাবিতে উল্লেখ করা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের কোনো আপত্তি নেই বলে জানানো হয়েছে সংলাপে। ওবায়দুল কাদের জানান, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বরং তারা স্বাগতই জানাবেন। এর বাইরে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ নিয়ে তেমন কিছু বলেননি কোনো পক্ষের নেতাই।

এর বাইরে সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তুলে ধরা সাত দফা দাবির প্রথমেই ছিল, অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। এর মধ্যে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলাগুলো বিবেচনার আশ্বাস দেওয়া হলেও সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া ও নিরপেক্ষ সরকার গঠন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সংবিধানের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হবে না। অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়েও আগের মতোই বলা হয়েছে, এটা আদালতের বিষয়। এখানে সরকারের কিছু করার নেই।

ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় দাবিতে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। আলোচনায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের আলোচনার বিষয়ে কিছু না জানানো হলেও ওবায়দুল কাদের ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচনে স্বল্প পরিসরে ইভিএম ব্যবহারেও আমাদের তাদের নেই। ফলে এই দাবিও স্পষ্টতই সাড়া পায়নি আওয়ামী লীগের কাছে।

কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সামাজিক গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের অভিযোগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতার করা ব্যক্তিদের মুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চেয়ে ঐক্যফ্রন্টের চতুর্থ দাবিটি নিয়েও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস মেলেনি।

ঐক্যফ্রন্টের পঞ্চম দাবিতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়ার কথা বলা হয়। আর সপ্তম দাবিতে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা এবং নতুন কোনো মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়ার দাবি জানানো হয়। সংলাপের আলোচনায় সংবিধানের আলোকে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে প্রকারান্তরে এই দুইটি দাবিও নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।

ফলে স্পষ্টতই এই সংলাপ থেকে ঐক্যফ্রন্টের প্রাপ্তির ভাড়ারে খুব বেশি কিছু যুক্ত হয়নি। বিশেষ করে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির চেয়ারপাসন খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে সরকারি দলটির কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্যের প্রত্যাশা থাকলেও সেই প্রত্যাশা কোনোভাবেই পূরণ হয়নি।

যে কারণে সংবাদ সম্মেলনে আজকের সংলাপ থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অর্জন কী— এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেই দিয়েছেন, ‘সব সময় কি সব অর্জন হয় না কি? এটা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে।’

তরিকুর রহমান সজীব, জয়েন্ট নিউজ এডিটর, সারাবাংলা ডটনেট

আরও পড়ুন-

গণভবনে সাড়ে ৩ ঘণ্টার সংলাপ

সংলাপের স্বস্তিতে ইতিহাসের অস্বস্তি

আলোচনা অব্যাহত থাকবে: ওবায়দুল কাদের

‘প্রধানমন্ত্রী লম্বা বক্তৃতা দিলেন, বিশেষ সমাধান পাইনি’

‘খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি প্রধানমন্ত্রী’

এখন সবাই মিলে দেশটাকে এগিয়ে নিতে হবে, সংলাপের সূচনায় শেখ হাসিনা

সারাবাংলা/টিআর/জেডএফ

আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংলাপ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর