নুসরাতের মৃত্যু কি আমাদের চোখের পর্দা এখনো সরাবে না?
১১ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:৩৮
আগুনে পোড়া মেয়েদের আর্তনাদ যে আমাদের যাঁতাকলে পেশা মানুষের ভোঁতা অনুভূতিকে কাঁপিয়ে দিতে পারে, তার একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে ছোট্ট মেয়ে নুসরাত। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নুসরাতকে নিয়ে অসংখ্য আলোচনা করছেন আমাদের দেশের বিজ্ঞজনেরা। তাদের আলোচনার সঙ্গে আমিও একমত— নুসরাত তো হিজাব পরত, ও তো ইসলামী শিক্ষাই গ্রহণ করছিল। তবুও কেন নুসরাতের ওপর এমন অমানবিক অত্যাচার? যারা তাদের জীবনের প্রায় সমস্ত সময় এবং শ্রম ব্যয় করে নারীদের পর্দার সঙ্গে চলাকে উৎসাহ দিত, নারীর শিক্ষার পথ বন্ধ করতে এবং যেকোনো উপায়েই হোক নারীই এ বিশ্বের যাবতীয় পাপের উৎস— এমন ধারণাগুলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রচার করত, এখন তারা কী বলবে? এই প্রচারের মাত্রা এতটাই বিষাক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আজ আমাদের দেশে একটি কিশোরীকে লাঞ্ছিত করার পর তাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলার পরও সেই খুনির বিচার না চেয়ে বরং খুনির মুক্তির দাবিতে খোদ নারীর একটি দলই পথে নামে। কতটা অশিক্ষার পর্যায়ে পৌঁছালে একটি দেশে এমন একটি সময় আসতে পারে, তা আমরা দেখছি এই প্রতিবাদী মেয়ে নুসরাতের প্রতিবাদের সূত্র ধরে।
আরও পড়ুন- বাঁচানো গেলো না নুসরাতকে
ব্যক্তিজীবনে আমি একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পুড়ে যাওয়া একজন নারী। আমার পোড়ার মাত্রা ছিল ৬০ শতাংশ। ২২ বছর ধরে আমার এই অভিজ্ঞতার কারণে আমি যখনই শুনি কোনো মেয়ের পোড়ার মাত্রা অনেক বেশি, আমি মনে মনে তার বাকি জীবনের সঙ্গে যা ঘটবে, সব যেন দেখে ফেলি এক মুহূর্তে। নুসরাতের প্রতিবাদী কণ্ঠে ছিল ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবি। নুসরাত যদি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েও থাকে, তাহলেও কি সে দাবি মুছে যাবে? দেশের পোড়া মানুষের উন্নত চিকিৎসার জন্য এখন সরকারি ও বেসরকারি আধুনিক হাসপাতাল হয়েছে। সেসব চিকিৎসার সব আধুনিকতা হার মেনেছে নুসরাতদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার কাছে।
কেন আমরা নুসরাতের মৃত্যুর পর ওর জন্য স্মৃতিচারণ হিসেবে এত সামাজিক আলোচনা করছি? কারণ এমন ভয়ানক হিংস্রতার সঙ্গে যে মেয়েটিকে মেরে ফেলা হলো, মিডিয়ার কল্যাণে ওর জন্য আজ গোটা দেশের মানুষ সেই হিংস্রতা জেনেছে। ওর জন্য সারাদেশের মানুষ কাঁদছে।
নুসরাতের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চোখের দেখায় যতগুলো দিক দেখা যায়, তা আমার থেকেও অনেক বেশি উপায়ে দেখার জন্য অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন আমাদের দেশে। তবে আমার মতামত একটু পেছনের কারণগুলো নিয়ে। প্রথমত আমি বলব দেশে ধর্মীয় গোঁড়ামির চর্চার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথা।
আমার বাবার একজন মামাত ভাই ছিলেন হাফিজ। তিনি যখন বাড়িতে থাকতেন, আমরা গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেলে দেখেছি— কাচারি ঘরের জানালায় বসে থাকতেন পুকুরে গোসল করে ভেজা কাপড়ে উঠে আসা প্রতিবেশী নারীদের শরীর দেখার জন্য। আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দেবো, তার আগে আমাদের স্কুলের আরবি শিক্ষকের বাসায় আমরা ব্যাচ করে পড়তে গিয়েছিলাম ছয় জন মেয়ে। হুজুর স্যার আমার পাশে একদিন বসে আমার হাঁটুতে তার কনুই রেখে সোফার টুলের ওপরে খাতা রেখে লিখছিলেন। ধীরে ধীরে সেই কনুই দিয়ে এতটাই চাপ দিতে থাকেন যে আমার ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠা মুখ দেখে আমার সব বান্ধবীরা আমার দিকে খুব অসহায়ের মতো তাকাতে শুরু করে। যে দু’জনের কথা বলছি, তারা গ্রাম ও শহরের উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। এসব মানুষদের দেখেছি কথায় কথায় হাদিসের উদাহরণ দিতে। কিন্তু সব মুহূর্তে নারীদের সঙ্গে অশালীনতা ঘটানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো— ধর্মীয় শিক্ষার জন্য পারিবারিক শিক্ষাই যথেষ্ট। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়তো পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমেই যে শিক্ষা নিয়েছেন, সেই শিক্ষা থেকেই তিনি এতটা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হয়েছেন। আমি দেখেছি, আমার মা-বাবা তাদের সময়ে পরিবার থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং তা থেকেই এই বিধান মেনে চলার অভ্যাস। আমাদের সময় আমরাও কেবল পারিবারিক আয়োজনে ধর্মীয় শিক্ষা নিয়েছিলাম। তবু আমি সাধ্যমতো ধর্মীয় বিশ্বাসের বিধানকে মেনে চলি। এ দেশের কোটি মানুষও তাদের শৈশবের জীবনে পারিবারিক আয়োজনে যে ধর্ম শিক্ষা পেয়ে থাকে, তাই মন থেকে চর্চা করেন এই পূর্ণ বয়সে এসেও।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। যে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা নারীদের প্রতি তীব্র অসম্মানজনক মানসিকতার শিক্ষা পায়, যারা বিজ্ঞান চিন্তাকে, সংস্কৃতি চর্চাকে ও প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রয়োজনকে অস্বীকার করছে বেড়ে ওঠার কারণে সম্পূর্ণ একটি আলাদা মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে বলা চলে। যে কারণে আজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত হোঁচট খাচ্ছে এসব মানুষ। ক্রমাগত হোঁচট খেয়ে এরাও হয়ে উঠছে সামাজিক আচরণে হিংস্র ও সম্পূর্ণ বেমানান একটি জনগোষ্ঠী। আমাদের মধ্যে যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, তারা কি দেশে অথবা বিদেশে এই ভাষায় গবেষণা করছেন না? তারা শিক্ষাব্যবস্থার শুরু থেকেই গবেষণা করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা পাননি। চর্চার মাধ্যমে একটি ভাষাকে নিজের দখলে নিয়েছেন। তবে কেন আরবি শিক্ষার জন্য এখনো আমাদের দেশে একটি জনগোষ্ঠীর শিক্ষাব্যবস্থাকে আলাদা করে রাখা হচ্ছে?
মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে শুরুতেই এই শিক্ষার অনুসারীরা আলোচকদের নাস্তিক বলে সম্বোধন শুরু করে দেন। তাদের আমি দৃঢ় ভাষায় বলতে চাই, আমি আমার সমস্ত বিশ্বাস থেকেই আমার ধর্মকে মেনে চলি। এবং আমি প্রশ্ন করতে চাই, ধর্মের ব্যাখ্যার কোথায় আছে যে নারীকে ধর্ষণ করা যাবে?
কেবল মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার নয়, এর পাশাপাশি আমাদের দেশে যতগুলো এতিমখানা সরকারি ও বেসরকারিভাবে পরিচালনা করা হয়, সেগুলোতে শিশুরা কেমন আছে, সেই খোঁজটাও এখন থেকে নিয়মিত নেওয়া দরকার। অনেকদিন আগে ঢাকার একটি নামি এতিমখানার শিশুদের জন্য আমি মিষ্টি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানকার অফিস রুমে বসে নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় আমি দেখেছিলাম, অফিসের সবার ব্যবহার ছিল লুকোচুরিতে ভরা এবং তারা আতঙ্কিত। সেই এতিমখানার শিশুদের জন্যা আরও অর্থ প্রয়োজন— এই বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে তারা বলেন, এতিমখানার শিশুরা ঠিকভাবে খেতে-পরতে পারে না। তাই তাদের মুখের মলিনতা কখনো মুছে যায় না। এমন ব্যাখ্যা আমরা সাধারণভাবে শুনে থাকি। কিন্তু আমার আমার বারবারই মনে হতে থাকে, এখানে আরও ব্যাপক পর্যায়ে অন্যায় কিছু ঘটছে। কে জানে, এখানেও হয়তো রয়েছে আরও অনেক নুসরাতের গল্প।
প্রশাসনের সঙ্গে মিডিয়া ও সরকারি-বেসরকারি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের একাত্মতা প্রয়োজন। যে নুসরাত আজ চলে গেল, কোনো চেষ্টাতেই তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তবে চোখের পর্দা সরিয়ে আমরা আজ বাঁচাতে পারি হাজারো নুসরাতদের, একটি ব্যাপক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে। এসব চেষ্টা হওয়া দরকার ন্যায়বিচার ও একটি নিরাপদ দেশের জন্য। যদি এই খুনির বিচার প্রকৃত অর্থে ন্যায়সঙ্গতভাবে না হয়, তা আরও অনেক খুনির জন্ম দেবে। আমরা কি তেমন রাষ্ট্র চাই?
লেখক: লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
সারাবাংলা/টিআর