‘ঢাবিয়তাবাদ ও উদারতা’
২২ জুলাই ২০১৯ ১৩:৫৮
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনে অনেক রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলো ইতিহাসের নানা পর্যায়ে বারংবার আলোচিত হয়েছে৷ অক্সফোর্ড অফ দ্য ইস্ট মেটাফোর, বঙ্গভঙ্গের আলোচনা, সাম্প্রদায়ীকতা, ব্রিটিশ ভূ রাজনীতি ইত্যাদি পাশ কাটিয়ে প্রায়শঃই মানুষ ভুলে যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য ছিলো পূর্ব বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে শিক্ষিত করে তোলা। একটি সংবেদনশীল, আত্ম পরিচয়যুক্ত, মার্জিত, শিক্ষিত , বিবেকবান মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরির কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছিলো; এই বিশ্ববিদ্যালয় সে পরীক্ষায় ভালোভাবেই পাশ করেছে।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে যে অভিযোগগুলো করা হয় তার মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে গবেষক তৈরি না করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়া, শিক্ষক থেকে ছাত্র সব অংশীজনের দলাদলি, ছাত্রদের সকল সুবিধা নিশ্চিত না করা, আক্যাডেমিক পড়াশুনা বাদ দিয়ে সরকারি চাকরির প্রতি অধিক ঝোঁক প্রভৃতি। অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামের জায়গা হচ্ছে দেশের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃত্ব তৈরি করা, সরকারি চাকরিতে একচেটিয়া আধিপত্য, পর্যাপ্ত আমলা তৈরি করা, সর্বপোরি দেশের মানদণ্ডে পর্যাপ্ত মানসম্মত গ্রাজুয়েট তৈরি করা। এবং অবশ্যই এসব সুনামের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি। দেশের চাহিদার নিরিখে যদি নেতা, আমলা, গ্রাজুয়েট ইত্যাদিকে ‘ভাত’ ধরি তাহলে র্যাংকিং, গবেষণা, বৈদেশিক মানদণ্ড ইত্যাদি হলো ‘বিরিয়ানি।’ অর্থাৎ সরলীকরণ করে এটা বলা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে দেশের মানুষের ভাতের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে কিন্তু বিরিয়ানী খাওয়াতে পারেনি। ভবিষ্যৎ বা বিরিয়ানির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে না ভাবলে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে এতেই সন্তুষ্ট থাকা যায়!
প্রতিষ্ঠার উদ্দ্যেশ্যসমূহের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে উদার হিসেবে পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশের শিক্ষিত সমাজ প্রতিনিধিত্বে প্রতিষ্ঠানটির ধারেকাছেও কেউ নেই। এই উদারতার ট্যাগলাইনের পিছনে স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, সেনা শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন যেভাবে কাজ করেছে তেমনিভাবে বাংলাদেশের এখন অবধি বিকশিত হওয়া মুক্তবুদ্ধি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চার পিছনে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্রদেরও এই উদার আচরণের সুনাম ছিলো, এখনো কিঞ্চিৎ আছে বৈ কি! মোটাদাগে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে আবাসিক হল, কলাভবন, অপরাজেয় বাংলা, কার্জন হলের উদারতা গহণ করার মানসিকতা কমেছে। এটি অবশ্য ভালো। বহিঃর্বিশ্বে যেভাবে জাতীয়তাবাদের নামে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, তুরষ্কে রাষ্ট্রপ্রধানরা একটি পপুলিস্ট ধারার সফল রাজনীতির সূচনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তাতে আকৃষ্ট না হওয়াটাও শোভনীয় নয়; যেখানে আমরা ক্রমশঃ আমাদের বিরিয়ানীর চাহিদার দিকে ঝুঁকছি। এই পপুলিস্ট ধারার জাতীয়তাবাদ এখানে ঢাবিয়তাবাদে রূপ নিয়েছে৷ এই উদারতা গ্রহণ না করার মানসিকতাকে দেশের বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টারগুলো ভালোভাবে লুফে নিয়েছে। তাদের শব্দ ব্যাবহারের রাজনীতির দিকে তাকালে একটা চিত্র পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেখানে নিজেদের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’ নামেই পরিচয় দিতো এখন তারা নিজদের ইংরেজি ইয়ান প্রত্যয় যোগ করে ঢাবিয়ান বলতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ঢাবি’, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘রাবি’, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘চবি’ বলার রাজনীতির দিকে তাকালে কোচিং সেন্টারদের স্কুলিং আরো পরিষ্কার হয়। এই সেন্টারগুলো শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে শেখায় ঢাবিতে না হলে চবি, চবিতে না হলে রাবি, রাবিতে না হলে ইবি। মনে হয় এরা স্বতন্ত্র কোন বিশ্ববিদ্যালয় নয়; একই মায়ের পেটের আপন ভাইবোন। কোচিং সেন্টারগুলো আবার প্রতিষ্ঠানের মাঝে উচ্চতর-নিন্মতর বিভাজন করে দেয়। বলে দেয় এটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়, এটা খারাপ। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও এদের এই ঢাবিয়তাবাদ স্কুলিং থেকে নিজেদের বের করে আনতে পারে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবশ্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মতো এতোটা আশীর্বাদপুষ্ট নন। দেশের প্রচলিত সংস্কৃতিতে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অনুর্ত্তীন্ন হন তারাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কোচিংয়ের দ্বারস্থ হন তারপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেয়ে কোচিং সেন্টার স্কুলিংয়ের ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। দেশের সামগ্রিক শিক্ষার মান, সেশনজট, অপ্রতুল সম্পদ ইত্যাদি সমস্যার মধ্য দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ কেউ উৎকৃষ্ট গ্রাজুয়েট হয়ে বের হন ঠিকই তবে বেশিরভাগেরই এমন অবস্থা তৈরি হয় যে, তারা পাশ করে না পারেন চাকরি করতে না পারেন মাঠে কাজ করতে। এই অবস্থার পিছনে তাদের কোন দায় নেই। এই দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যতসংখ্যক গ্রাজুয়েট তৈরি করছে তত সংখ্যক উপযুক্ত কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারছেনা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোকে নিকটবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত এক্ষেত্রে আশাজাগানিয়া। এতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কিছুটা বিদ্যা ভাগাভাগি করার সুযোগ হয়, সম্পদের কিছুটা ব্যবহার বাড়ে, পড়াশুনা-পাঠদানের পদ্ধতি কিছুটা উন্নতি করার সুযোগ হয়। এতে মূল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কিছু না হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক লাভ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ অধিভুক্তকরণের পিছনে যে আন্দোলন করছে তা যৌক্তিক। যে বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের ভার বইতে পারছেনা সে কিভাবে অতিরিক্ত সাতটি কলেজের ভার বইবে তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। শিক্ষকরা নিজেদের শিক্ষার্থীদের সময় দিতে পারছেননা, রেজিস্ট্রার ভবনে ছাত্রদের সাধারণ কাজ করতেও কয়েকদিন লাগে, আবাসন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত, লাইব্রেরিতে বসার পর্যাপ্ত জায়গা নেই; এই প্রত্যেকটি দাবিই যৌক্তিক৷ তবে এই সমস্যাগুলো সমাধানের উপায়ও আছে। প্রথমতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত শিক্ষকগণ নিজের বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা সান্ধ্যকালীন কোর্সে কয়টি ক্লাস নিতে পারবেন তার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া। নির্দিষ্ট সময় পর পর শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা৷ রেজিস্ট্রার বিল্ডিংকে যত দ্রুত সম্ভব অটোমোশনের আওতায় নিয়ে আসা। নতুন হল এবং লাইব্রেরির সুবিধা বাড়াতে যে প্রকল্পগুলো হাতে আছে তা দ্রুততার সাথে শেষ করা। আবাসিক হলগুলো পরিচালনায় কিছুটা হলেও আগের ধারায় ফিরে যাওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও তাদের আগের সেই উদার পরিচয়ে কিছুটা হলেও ফিরে যাওয়া উচিত৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচয় দেওয়া, ভিন্ন রঙের সার্টিফিকেট, কনভোকেশনে আলাদা পরিচয় ইত্যাদি যেসব দাবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাত কলেজ আন্দোলনে প্রকাশ্যে করেছে এটি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে, ঐতিহ্যের সাথে একেবারেই বেমানান৷ বিদ্যা বা জ্ঞান কোন ভল্টে রাখা টাকা বা সোনা নয় যে অন্য কাউকে দিলে কিছুটা কমে যাবে। বিদ্যার মহাসমুদ্র থেকে এক বালতি পানি দিলে তা কমেনা বরং বাড়ে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদারতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ এক অধ্যাপক বলেছিলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথ শাহবাগ, নীলক্ষেত, চানখারপুল, পলাশীতে কোন গেট নেই। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয় উদার। এই বিশ্ববিদ্যালয় সবাইকে গ্রহণ করতে পারে।’ আবার সকলকে এটাও মনে রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য ছাত্রদের পড়াশুনা করানো। অন্য সকল অংশীজন তাদের সহযোগিতা করার জন্য চাকরি করেন মাত্র। শিক্ষার্থীদের ভাগ্য নিয়ে খেলার অধিকার তাদের নেই৷ সাময়িক সংকটকে সৃষ্টির প্রসব বেদনা ধরে সকলের উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে মহিমান্বিত করবে।
মাজহারুল কবির শয়ন, সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)
সারাবাংলা/এমএম
৭ কলেজ অধিভূক্তি ডাকসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাজহারুল কবির শয়ন সাত কলেজ