Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্লিজ ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’কে থামান


২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ২১:১৩

মহান বিজয়ের মাসে এখন পর্যন্ত চারবার শিরোনাম হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠন। নিশ্চয়ই ভাবছেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় কোনো কাজ করেছে। তাহলে চলুন তাদের অর্জনগুলো দেখে আসি।

ঘটনা ১: ৪ ডিসেম্বর: ফাঁস হওয়া একটি টেলিফোন কথোপকথনের সূত্র ধরে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে ডাকসু ভবনের সামনে মানববন্ধন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের আলটিমেটাম এবং ডাকসু ভবনে তালা লাগিয়ে দেয়া।

বিজ্ঞাপন

নুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার, মানববন্ধন করার, পদত্যাগ দাবি করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু ডাকসু ভিপির রুমে তালা লাগানোর কোনো অধিকার কারো নেই। কথোপকথন ফাঁস হওয়ায় ডাকসু ভিপি নুর যতটুকু কোনঠাসা হয়েছিলেন, রুমে তালা লাগিয়ে তাকে সেখান থেকে ঘুরে দাড়াতে সহায়তা করেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। পরিস্থিতি যাই হোক, আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারো নেই।

ঘটনা ২: ১৩ ডিসেম্বর: ১২ ডিসেম্বর ছিল সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সর্বোচ্চ দন্ড পাওয়া যুদ্ধাপরাধী একাত্তরে কসাই কাদের হিসেবে পরিচিত কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের দিন। সেদিন জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম কসাই কাদেরকে ‘শহীদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রথম পাতায় তিন কলাম শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। যা দেশজুড়ে ক্ষোভ আর নিন্দার ঝড় তোলে। একজন দন্ডিত যুদ্ধাপরাধীকে ‘শহীদ’ বলা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল অভিহিত করে অনেকেই তাদের বিচার দাবি করেছে। আমি নিজেও করেছি।
একই দাবিতে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সংগ্রাম অফিসের সামনে অবস্থান নেয় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। আমি তাদের দাবি এবং কর্মসূচির সাথে একমত। বরং বিক্ষোভটাকে ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগত থেকে রাজপথের অ্যাকচুয়াল জগতে নিয়ে যাওয়ায় তাদের ধন্যবাদ জানাই। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। এরপর তারা সেটাই করেছে, যেটা সংগ্রাম চাইছিল। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা সংগ্রাম অফিসে ঢুকে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। বর্ষীয়ান সম্পাদক আবুল আসাদকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে আনে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের এই হামলার পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। কসাই কাদেরকে ‘শহীদ’ বলে সংগ্রাম ও জামাত যতটা বিপাকে পড়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হামলা তাদের সেই বিপদ থেকে উদ্ধারে সাহায্য করেছে। যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদেরকে শহীদ বলার গুরু পাপটি আলোচনার আড়ালে চলে যায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সংবাদপত্র অফিসে ভাংচুর এবং সম্পাদককে হেনস্থার ইস্যুটিই প্রাধান্য পায়। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হামলা কার লাভ, কার ক্ষতি হলো? ক্ষতি হলো সরকারের, লাভ হলো জামায়াতের। সংগ্রাম কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তাদের বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে ধন্যবাদ জানাবে।

বিজ্ঞাপন

ঘটনা ৩: ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদী মানববন্ধনের আয়োজন করে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর ও ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ভারতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের কারণে প্রতিবাদী ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছিল। ‘ভারতের অভ্যন্তরীন বিষয়ে’ প্রতিবাদ করার এখতিয়ার নেই বলে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ তাদের ওপর হামলা চালায়। বাহ, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ দেখি মানুষের প্রতিবাদ করার বিষয় এবং এখতিয়ারও ঠিক করে দিচ্ছে।

এই তিনটি ঘটনাতেই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ আইন হাতে তুলে নিয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেয়া হয়ইনি; উল্টো জামাত-শিবিরকে প্রতিহত করা ও ডাকসু ভিপিকে ঠ্যাঙ্গানোর কারণে অনেকের বাহবা পেয়েছেন তারা। সরকারের প্রশ্রয় পেলে, পুলিশ কিছু না বললে জামাত-শিবির বা নুরুকে প্রতিহত করা কোনো বীরত্বের কাজ নয়। এখানে কোনো লড়াই নেই, একতরফা হামলা। বিরুদ্ধ সময়ে জামাত-শিবিরের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে লড়াই করা হলো সত্যিকারের লড়াই। আমাদের অনেকেই দেখি, এইসব একতরফা হামলায় বেশ তৃপ্তি পান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উর্ধ্বে তুলে ধরা গেল বলে বড়াই করেন। কিন্তু এতে যে দেশের ও সরকারের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে সেটা বিবেচনায়ই নেন না।

পরপর তিনটি হামলায় প্রশ্রয়ই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের আরো বড় হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। আরো বাহবা পাওয়ার আশায় ২২ ডিসেম্বর দুপুরে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ডাকসু ভবনে নুর এবং তার সহযোগীদের ওপর হামলা চালায়। পরে তাদের সাথে যুক্ত হয় ছাত্রলীগও। তাদের হামলায় নুরসহ অন্তত ২২ জন আহত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম হাসপাতালে ছুটে যান। আহতদের দেখে জাহাঙ্গীর কবির নানক এ হামলাকে ‘বর্বর ও পৈশাচিক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, যে মঞ্চই হামলা করুক, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জাহাঙ্গীর কবির নানককে ধন্যবাদ। এই ব্যবস্থাটা আরো আগে নিতে পারলে দেশের অনেক ভালো হতো এবং পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না।

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তৎপরতা ও কর্মকান্ড দেখে মনে হয়, দেশে কোনো সরকার নেই, পুলিশ নেই, আইন-আদালত নেই। তাদেরকে বোধহয় দেশরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যেখানেই অন্যায়-অনিয়ম সেখানেই তারা যাবে এবং মেরে ঠিক করে দেবে। ২২ ডিসেম্বর ডাকসুতে হামলার যুক্তি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ দাবি করেছে, নুর বহিরাগতদের নিয়ে ডাকসু অফিসে এসেছিলেন এবং তাদের কাছে লাঠিসোটা ছিল। সন্দেহ নেই গুরুতর অভিযোগ। কিন্তু সেটা দেখার দায়িত্ব তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর বা পুলিশের; কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নয়।

দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায়, দেশে আইনের শাসন আছে; এটা যদি আপনি বিশ্বাস করেন; তাহলে কোনো অবস্থাতেই আইন হাতে তুলে নেয়ার, কারো ওপর হামলা করার, কোনো হামলাকে সমর্থন করার, হামলাকারীকে বাহবা দেওয়ার, উসকানি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর যদি মনে করেন, যেখানে ইচ্ছা সেখানে হামলা করে দেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করবেন, সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন; তাহলে সরকার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে।

শেখ হাসিনা বারবার প্রমাণ করেছেন তিনি প্রতিহিংসা নয়, আইনের শাসনে বিশ্বাস করেন। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে চাইলে তিনি তিনমাসের বিচারের বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শেষ করতে তাঁকে দুইবার ক্ষমতায় আসতে হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেও তিনি কোনো শর্টকাট ব্যবস্থা নেননি। যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকরের আগে সর্বোচ্চ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আর শেখ হাসিনার অনুসারীরা কথায় কথায় হামলা করে, মারধোর করে সব ঠিক করে ফেলতে চান। শিবির হলেই হামলা করার ঠিকাদারী নিয়ে নেন। বুয়েটে আবরারকে শিবিরের ট্যাগ লাগিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনায় সরকার কতটা বিপদে পড়েছিল আশা করি ভুলে যাননি। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো, আমরা আবরার হত্যার ঘটনা থেকে শিক্ষা নেইনি। অতি উৎসাহী ছাত্রলীগ আর এইসব ভুইফোড় সংগঠনের অপকর্মে ম্লান
হয়ে যায় শেখ হাসিনার সরকারের অনেক অর্জন।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমাদের সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গা। কোনো একটি ভুঁইফোড় সংগঠন তার নামের আগে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি লাগিয়ে যা ইচ্ছা তাই করবে, তা চলতে দেয়া উচিত নয়। এতে মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো উদার, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র; যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, চিন্তার স্বাধীনতা থাকবে, সমাবেশ করার অধিকার থাকবে, আইনের শাসন থাকবে।

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ

প্রভাষ আমিন মত-দ্বিমত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ সারাবাংলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর