Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অকশনে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন


১৩ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৫৩

রয়েল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্স, অকশন তত্ত্বে অবদানের জন্য দু’জন মার্কিন অর্থনীতিবিদকে  ২০২০ সালে আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে অর্থনীতি বিজ্ঞানে Sveriges Riksbank পুরস্কার, যা অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কার নামে পরিচিত, প্রদানের জন্য মনোনীত করেছে। নিলাম বা অকশন হলো এমন ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া যেখানে সকলের উপস্থিততে সর্বোচ্চ দরদাতার নিকট পণ্য বা সেবা বিক্রি করা হয়।

অকশন বলতে সাধারণত কোন মূল্যবান সামগ্রী, পেইন্টিং বা প্রাচীন মূল্যবান পণ্যসামগ্রী বিক্রি করা বোঝানো হলেও বর্তমানে সকল ধরণের পণ্য ও সেবা অকশনের মাধ্যমে বিক্রয়যোগ্য। সাধারণত এখানে পূর্ববর্তী বিডিং হতে পরবর্তী বিডিং এ উর্ধ্বক্রমানুসারে মূল্য ডাকা হয়।  অকশন প্রক্রিয়াটি তখনই অবলম্বন করা হয় যখন সাধারণ বাজার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ে বিক্রেতা কাঙ্ক্ষিত  আয় থেকে বা ক্রেতা কাঙ্ক্ষিত পণ্য পাবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অকশন প্রক্রিয়ার মধ্যে পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় হলে একদিকে বিক্রেতা যেমন তার বিক্রির জন্য নির্বাচিত পণ্য হতে প্রত্যাশিত আয় সর্বোচ্চ করতে পারে তেমনি ক্রেতাও তার কাঙ্ক্ষিত পণ্য বা সেবাটি তার চাহিদামূল্যে বা তার চেয়ে কম মূল্যে পাবার সম্ভাবনা থাকে।

বিজ্ঞাপন

প্রথম অকশনের দৃষ্টান্ত হিসেবে  খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দে প্রাচীন গ্রীসে বিবাহযোগ্য নারীদের বিবাহের জন্য অকশন হওয়ার কথা জানা যায়। তবে সেই অকশনের প্রাইস কল হতো নিম্ন-ক্রমানুসারে এবং রিজার্ভ মূল্যের সমান বা তার বেশি হলে সর্বনিম্ন দরদাতাকে পাত্র হিসেবে নির্বাচন করা হতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাচীন অকশনসমূহ হতো ফার্মের পণ্য, স্থাবর সম্পত্তি বা কৃতদাস বিক্রির উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধকালীন, কর্নেল বা তদূর্ধ্ব পদধারী সেনাবাহিনীর সদস্যগণ যুদ্ধের লুণ্ঠিত সামগ্রী অকশনের মাধ্যমে বিক্রি করতেন। কিন্তু মহামন্দার সময় ব্যাপক আকারে অকশনের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী বিক্রি হতে লাগল যখন জনগণ দেউলিয়া হয়ে পড়ল এবং তাদের স্থাবর সম্পত্তি নগদায়নে বাধ্য হলো।

বিজ্ঞাপন

১৯০০ সালে প্রথম জোন’স ন্যাশনাল স্কুল অব অকশনিয়ারিং এবং অরেটরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে অকশনের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে ১৯৯০ সালে বিক্রেতাগণ অকশনের মাধ্যমে বিক্রয়ের জন্য মাধ্যম হিসেবে কম্পিউটার, সেলফোন , ফ্যাক্স মেশিন, প্রজেক্টেরের ব্যবহার শুরু করলেন। ১৯৯৫ সালে ই-বে নামক প্রথম অনলাইন বিডিং সাইট প্রতিষ্ঠিত হয়ে অকশনকে সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। এর ফলে সাধারণ জনগণ অকশনের মাধ্যমে যেকোনো পণ্য ক্রয় করার সুযোগ পেল। বিভিন্ন প্রকার অকশন পদ্ধতি রয়েছে— ইংলিশ অকশন, ডাচ অকশন, ফার্স্ট প্রাইস  সিল্ড বিড অকশন, সেকেন্ড প্রাইস সিল্ড বিড অকশন প্রভৃতি। এর মধ্যে ইংলিশ অকশন ও ফার্স্ট প্রাইস সিল্ড বিড অকশন অধিক প্রচলিত।

বিগত কয়েক বছরে অর্থনীতিতে মৌলিক গবেষণায় অবদানকে যেমন অসমতা থেকে শুরু করে আবহাওয়াগত পরিবর্তন বা আচরণগত অর্থনীতিকে স্বীকৃতি জানানোর পর সুইডিশ একাডেমি এবার বাস্তব প্রয়োগযোগ্য ক্ষেত্রে অবদানকে স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করেছে। অকশন তত্ত্বকে পুনর্গঠন ও নতুন অকশন ফরম্যাট উদ্ভাবনের স্বীকৃতি স্বরূপ অধ্যাপক পল আর মিলগ্রম (৭২) ও অধ্যাপক এমিরেটস উইলসনকে (৮৩) অর্থনীতি বিষয়ে নোবেল পুরষ্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তাদের ধারণা ব্যবহার করে এয়ারক্রাফট ল্যান্ডিং স্লট থেকে ফিশিং কোটা পর্যন্ত সকল  পণ্য বা সেবার বিক্রি প্রক্রিয়াকে সুসম্পন্ন করা সম্ভব। তাদের তত্ত্ব ব্যবহার করে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মতো সেবা যা সাধারণ বাজার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিক্রি করা কষ্টসাধ্য ছিল তাও সফলভাবে বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে। এমনকি নবায়নযোগ্য শক্তির বাজারকেও এ তত্ত্বের দ্বারা বিকাশ করার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।

মার্কিন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মানবিক ও বিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক পল আর মিলগ্রমের কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বিডিং কৌশলের বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন অকশনের ফরম্যাট নির্ধারণ যা একজন বিক্রেতাকে সর্বোচ্চ প্রত্যাশিত আয় দিতে সক্ষম যেখানে একজন বিডার, বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপিত পণ্যের ব্যক্তিগত মূল্য পরিমাপের চেষ্টা করে। অকশন তত্ত্বের ব্যক্তিগত মূল্য মডেলে প্রত্যেক বিডার নিজস্ব ব্যক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে বিক্রিতব্য পণ্যের মূল্যায়ন করতে পারে যাকে ব্যক্তিগত মূল্যায়ন পদ্ধতি বলে।

অপরপক্ষে স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুলের প্রফেসর এমিরেটস উইলসনের কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সাধারণ মূল্য পদ্ধতি, যা হলো একটি পণ্য বা সেবার মূল্য কত হতে পারে তা নির্ধারণের সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। এভাবে একটি অকশনে বিক্রিতব্য পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য কত হতে পারে তার ভিত্তিতে একজন বিডার তার প্রস্তাব নির্ধারণ করতে পারে এবং অতিরিক্ত মূল্য প্রদানের আশঙ্কা এড়াতে পারে।

তাদের অবদানের কারণে একটি অকশন প্রক্রিয়ায় বিক্রেতা ও ক্রেতা/বিডার তাদের স্ব স্ব উপযোগ সর্বাধিকীকরণকে নিশ্চিত করতে পারে এবং অকশন প্রক্রিয়াটি একটি যৌক্তিক প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপিত হয়। এভাবে এই দু’জন অধ্যাপক তাদের কাজের মধ্য দিয়ে নতুন অকশন ফরম্যাট উদ্ভাবন করেছেন যা দ্বারা তারা বহু আন্তঃসম্পর্কিত পণ্য বিক্রি করতে সমর্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয় অকশনের মতো একটি প্রক্রিয়াকে ক্রেতা-বিক্রেতা ও করদাতা সকলের উপযোগ নিশ্চিত উপযোগ করতে সমর্থ হয়েছেন। তাদের এই পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করে ১৯৯৪ সালে মার্কিন কর্তৃপক্ষ টেলিকম অপারেটরগণের নিকট অত্যন্ত মূল্যবান রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রি করেছিল এবং এর দ্বারা করদাতাদের স্বার্থ নিশ্চিত করা গিয়েছিল। এরপর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো পণ্যের মূল্য নির্ধারণে তাদের এই তত্ত্ব ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাদের অবদানের কারণে ই-বে’র মতো প্রতিষ্ঠানের উত্থানের দ্বারা ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে অকশন প্রক্রিয়াটি সাধারণ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। আর এভাবে সারাবিশ্বে ক্রেতা, বিক্রেতা ও করদাতা সকলের নিকট তা অনেক সহজলভ্য হয় এবং তারা প্রত্যেকেই উপকৃত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব কমাতে এমিশন ভাতা নির্ধারণের অকশনের ক্ষেত্রেও তাদের এই তত্ত্ব ও মেথোডলজি সফলভাবে প্রয়োগ করে।

এই দুই অধ্যাপক অকশনের মাধ্যমে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে  সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত করছেন। উন্নত অর্থনীতিতে প্রতিটি দ্রব্যই অকশনে বিক্রি হতে পারে। অকশন সেখানে সাধারণ ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের দেশে সীমিত আকারে অকশনের ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়। এ উদ্দেশ্যে সরকারি-বেসরকারি কিছু অনলাইন অকশন সাইটও রয়েছে। কারণ আমাদের দেশে অকশন বা নিলামে সাধারণ পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের কোন ঐতিহ্য নেই বিধায় অকশন এখানে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।  অবৈধভাবে আমদানিকৃত আটককৃত পণ্য যা জনজীবনের জন্য ক্ষতিকর নয়, কোনো দেউলিয়া বা ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বন্ধকী সম্পত্তি বা সরকারি কোন পণ্য ক্রয়-বিক্রয় নিলাম বা অকশনের মাধ্যমে করা হয়। সাধারণত বাংলাদেশে কাস্টমসের মাধ্যমে আটককৃত মালামাল অকশনের মাধ্যমে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কাস্টমস আইনের ৮২ বা ২০১ ধারা বা এনবিআরের এ সংক্রান্ত পরিপত্র অনুসরণ করা হয়।

সরকারি পণ্য/সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সকলের যৌক্তিক অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করার মাধ্যমে সর্বনিম্ন দরদাতাকে নির্বাচন কর হয় এবং পণ্য ক্রয় করা হয়। সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ বা বিধিমালা ২০০৮ কার্যকর রয়েছে। কিন্তু সরকারি পণ্য বা সেবা অকশনের মাধ্যমে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধান থাকলেও সরকারি প্রকিউরমেন্টের মতো সুসংবদ্ধ আইন বা বিধির ঘাটতি রয়েছে। এটি আমাদের সরকারি পণ্য নিলাম/ অকশনের মাধ্যমে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরণের সীমাবদ্ধতা। আমাদের দেশে যদি বিস্তৃত অর্থে অকশনের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের রীতি চালু করা যায় এবং এক্ষেত্রে উইলসন- মিলগ্রমের পুনর্গঠিত অকশন ফরম্যাট প্রয়োগ করা সম্ভব হয় তাহলে এর ফলে ক্রেতা, বিক্রেতা ও করদাতা সকলেই সমানভাবে উপকৃত হবেন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (অর্থনীতি), ফাইন্যান্স অফিসার,  কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, ঢাকা

অকশন