Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভালোবাসার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


২০ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৫০

২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে পাশকৃত ২৮ নং আইন বলে ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়। ১৫তম প্রতিষ্ঠাবর্ষ অতিক্রম করে ২০ অক্টোবর ১৬তম বর্ষে পা রেখেছে এই বিদ্যাপীঠ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ দেশে। তবে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এত অল্প সময়ে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠ হিসেবে স্থান করে নিতে পারেনি। এক ঝাঁক তরুণ মেধাবী শিক্ষক; আর জীবনের নানা বাঁকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ডালা সাজিয়ে বসা খ্যাতিমান অধ্যাপকের পদভারে মুখরিত এই বিদ্যাপীঠ অল্প সময়েই ভর্তিচ্ছুকদের পছন্দের তালিকায় প্রথমদিকে নাম লিখিয়েছে। তাই প্রতি বছরই মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে এই বিদ্যাপীঠে। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে ভর্তি পরীক্ষায় গত কয়েক বছর এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে লিখিত পরীক্ষা চালু হলেও ভর্তিচ্ছুকদের কাছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর্ষণ একটুও কমেনি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত ভর্তিচ্ছুকদের পদভারে এই বিদ্যাপীঠের ক্যাম্পাস মুখরিত হওয়াই প্রমাণ করছে শিক্ষার্থীদের প্রথম দিকের অন্যতম পছন্দ তালিকায় এখনও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করেও স্নাতক সম্মান শেষেই চাকরির বাজারে অভাবনীয় সফলতা পেয়েছে। বিসিএস পরীক্ষায়ও তাদের সাফল্যের হার ঈর্ষনীয়। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও পিছিয়ে নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়। চারুকলার কার্যক্রম চালু, পয়েলা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব এবং ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রগতিশীল দিবসগুলো উদযাপনের মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে পুরনো ঢাকায় একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছে। যা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রগতিশীলতা চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত করেছে।

বিজ্ঞাপন

অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শূন্য থেকেই পথ চলা শুরু করেনি। এর রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। পাঠশালা থেকেই যার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৮৬৮ সালে। বর্তমান জগন্নাথ ক্যাম্পাস যেখানে অবস্থিত সেই জায়গায় এই পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন বালিয়াটির জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরী। জগবাবুর পাঠশালাকে ১৮৮৪ সালে কলেজে উন্নীত করেন জমিদার জগন্নাথ রায় চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী। এবার ব্রিটিশ সরকারের নেক নজর পড়ল এই বিদ্যাপীঠের উপর। ওই বছরই এই বিদ্যাপীঠকে ‘ঢাকা জগন্নাথ কলেজ’ হিসেবে স্বীকৃত দেয় বিট্রিশ সরকার। অচিরেই ভারতে খ্যাতিমান বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে এই কলেজ নিজের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। ১৮৮৭ সালে স্কুল ও কলেজ শাখাকে পৃথক করা হয়। তখন স্কুলের নাম হয় ‘কিশোরী লাল জুবিলি স্কুল’। শিক্ষাক্ষেত্রে ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে ১৯২০ সালে ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ আইন’ পাশ করে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘর পুড়েছিল ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে। ১৯২১ সালে জগন্নাথ কলেজকে অবনমন করা হয় ভারতীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ‘জগন্নাথ কলেজ এ্যাক্ট’ পাশ করে। এই আইনের ফলে এই বিদ্যাপীঠকে ‘জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’ নামকরণ করে এর স্নাতক পর্যায়ে পাঠদানের ক্ষমতা রহিত করা হয়। এই বন্ধ দুয়ার খুলেছিল ওই ঘটনার ২৮ বছর পর। ১৯৪৯ সালে এই বিদ্যাপীঠে পুনরায় স্নাতক পর্যায়ে পাঠদান শুরু হয়।

ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে এই বিদ্যাপীঠের অসামান্য অবদান রয়েছে। জগন্নাথ কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের আন্দোলনে, মিছিল-মিটিং-স্লোগানে পাকিস্তানিদের দোসর মোনেম খানের গদি টলমল করছিল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানও কম যান না। তিনিও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ফন্দি আঁটছিলেন কিভাবে সায়েস্তা করা যায় এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র-শিক্ষকদের। ১৯৬৮ সালে এক দুরভিসন্ধিমূলক চক্রান্তে আর তৎকালীন অধ্যক্ষ ইরশাদুল্লাহর বুদ্ধিহীনতায় জগন্নাথ কলেজকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা জুতসই মওকা পেয়ে গেল সরকার। সরকার সমর্থিত গুণ্ডা ছাত্র সংগঠন এনএসএফ এর সাথে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সংঘাতে শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় জগন্নাথ কলেজ। খুললো মাস ছয়েক পরে একেবারে সরকারি কলেজ হয়ে। সরকারিকরণের মাধ্যমে স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম পাদপীঠ এই বিদ্যাপীঠে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ডিগ্রি স্তরকে ছাঁটাই করে নিয়ে যাওয়া হলো মহাখালীতে। নবীন কলেজের নাম দেয়া হলো ‘জিন্নাহ কলেজ’ (বর্তমান তিতুমীর কলেজ)।

স্বাধীন বাংলাদেশে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল এই বিদ্যাপীঠ। সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই বিদ্যাপীঠের ছাত্র-শিক্ষকরা অসামান্য অবদান রেখেছিল। ১৯৭২ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীর বদন্যতায় পুনরায় এই বিদ্যাপীঠে উচ্চস্তরের পড়ালেখা চালু হয়। ওই সময়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স খোলার অনুমতি পায় এই বিদ্যাপীঠ। বাংলাদেশের অন্য অনেক কলেজের মতো এই কলেজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষ থেকে একে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।

সর্বশেষ ইতিহাস প্রায় সবার জানা: ২০০৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগে মহান জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৫) পাশ হয়। জগবাবুর পাঠশালা থেকে এই বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে পরীক্ষমূলকভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্য আরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে সাজানো হয়। নিজস্ব আয়ে চলবে বলে একটি ধারা সংযুক্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় আইনে। সর্বশেষ ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে সেই ধারাও বিলুপ্ত হয়েছে। সরকারও রাজি হয়েছে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে।

তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে হল না থাকায় এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের ব্যয়বহুল ঢাকা শহরের নানা মেস-বাসা-বাড়িতে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। প্রিয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালে বড় কষ্ট হয়। কাক ডাকা ভোরে উঠে যাদেরকে ক্যাম্পাসের বাস ধরতে হয়। আর ক্লাস থাক আর না থাক কাঠফাটা রোদে এখানে সেখানে ঘুরে-ফিরে ফিরতে হয় পড়ন্ত বিকেলে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ক্লান্ত দেহ-মন পড়তে বসতে সায় দেয় না। হল না থাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও তাদের বাড়তি খরচ করতে হয়। তাই সেই টাকা যোগাড় থেকে গরিব পিতাকে নিস্তার দিতে ক্লাস শেষে ছুটতে হয় টিউশনি দিতে।

এভাবে রচিত হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর দিনলিপি। গত বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কয়েকদিন আগেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের ১৪৬তম সভায় ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন: ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হলে থাকার স্বপ্ন পূরণ হবে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ইতিহাসের অবসান হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাত্র ১১ দিন পূর্বে এমন প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ায় গত বছরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয় ভিন্ন আবহে।

এই বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হলের উদ্বোধন হবে। আর ওই উদ্বোধনের মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ্যত্ব ঘুচে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পাবে। নতুন এই আবাসিক হলে ছাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা হলেও ছাত্রদের অপেক্ষা করতে হবে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খুশি। কারণ ছাত্রী হলের যাত্রা শুরুর মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করবে। তবে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্রদের আবাসনের আক্ষেপ থেকে যাবে। তাই আজ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শেষ করে ভালবাসার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণরূপে বিকশিত করার জোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জবি প্রশাসন ও সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর