দোষ আলুর না পেঁয়াজের?
২৬ অক্টোবর ২০২০ ১৫:১০
চাল, ডাল, তেল, কাঁচা মরিচসহ নিত্যপণ্যের বাজারে লাগাম টানার চেষ্টায় পেরে উঠছে না সরকার। চেষ্টায়-কৌশলে কোনো কমতি নেই। সরকারের সৌভাগ্য হচ্ছে, মানুষ বিরক্ত হলেও ক্ষেপছে না। ক্ষোভ-বিক্ষোভে রাস্তায় নামছে না। এ ছাড়া, এক ইস্যু আরেক ইস্যুকে বরবাদ করে দিচ্ছে। ইস্যুর জটও লাগছে। চালের পর ডাল, ডালের পর তেল। পেঁয়াজের মধ্যেই মরিচ। নতুন যোগ আলু।
ডাল-আলুর ভর্তা দিয়ে গরীবি খাওয়ার অবস্থা কঠিন। এরপরও মানুষ খাওয়ার অভাবে মরছে না। বাজারে সবই আছে। কোনোটারই আকাল নেই। ঘাটতি-সরবরাহে ঘাটতি নেই। গত বছর কয়েক চাল, তেল, পেঁয়াজ নিয়ে জালিয়াতি-কারসাজির সঙ্গে মানুষ হাত-পা বাঁধা বন্দির মতো সন্ধি করে ফেলেছে। বাধ্য হয়েছে। এবার নতুন করে যোগ হলো আলু। এর আগে, আলু নিয়ে এমন কাণ্ডের সঙ্গে মানুষ পরিচিত নয়। সরকার কয়েক দফায় আলুর দর পুনর্নির্ধারণ করেছে। খোদ সরকারি বিপণন প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি দৈনন্দিন বাজারদরের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এখনো প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। এই হিসাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নির্ধারিত খুচরা দরের চেয়ে তা এখনো কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। কেবল তাই নয়, হিমাগারগুলোতেও সরকারের ঠিক করে দেওয়া দরে আলু বিক্রি হচ্ছে না।
প্রথমে গত ৭ অক্টোবর হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজিতে ৪ টাকা মুনাফা ধরে আলুর দাম নির্ধারণ করা হয় ২৩ টাকা। শতাংশের হিসাবে প্রায় ২১ শতাংশ মুনাফা। কিন্তু হিমাগার মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা এই মুনাফায় নাখোশ। তারা আবার গত ২০ অক্টোবর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করে হিমাগার পর্যায়ে আলুর দর পুনর্নির্ধারণ করে। এবার হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দর আগের চেয়ে চার টাকা বাড়িয়ে ধরা হয় ২৭ টাকা। এ হিসাবে তাদের মোট মুনাফা দাঁড়ায় কেজিতে আট টাকা। শতাংশের হিসেবে যা ৪২ শতাংশ। পরের নির্ধারিত অতিরিক্ত মুনাফার হিসাব ধরলেও শুধু হিমাগার পর্যায়েই ব্যবসায়ীরা ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এই হিসাব করা হয়েছে শুধু দাম নির্ধারণের পর ১০ লাখ টন আলুর মুনাফা ধরে।
প্রশ্ন থেকেই যায়, কাদের স্বার্থে আবার আলু দর পুনর্নির্ধারণ করা হলো? আগের ঠিক করা দর থেকেই-বা কেন সরে এলো সরকার? এসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি। তবে, এ কথা সবারই জানা গত বছর কয়েক আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা আলুর দাম পাননি। এবার চাহিদার কারণে দাম বেড়েছে। আর হিমাগারে রাখা সিংহভাগ আলুর মালিকই কৃষকরা। আলুর এই বাড়তি দরের সুবিধা কি আসলে পাচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা? কোটি টাকা খরচ করে যে কর্মকর্তারা আলু চাষের অভিজ্ঞতালব্ধ হয়েছেন তাদের কাছে এ সংক্রান্ত জবাব থাকলেও থাকতে পারে।
আলুকাণ্ডের মধ্যে পেঁয়াজকাণ্ড খানিকটা আড়াল হয়ে গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে পেঁয়াজের কেজি শত টাকা ছাড়িয়ে যায়। পরে সেটা ৩০০ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। তখন ক্যাসিনোকাণ্ড পেঁয়াজের ধাক্কাকে গুঁড়িয়ে দেয়। এবার এখন পর্যন্ত সেই লক্ষণ নেই। গত বছরের পেঁয়াজকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ভারত যেন পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের এক মাস আগে বাংলাদেশকে নোটিশ দেয়, ঢাকায় নবনিযুক্ত হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীকে এ অনুরোধ করেছেন তিনি। আগামী তিন বছরের মধ্যে যেন বাংলাদেশ পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে, এ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা চেয়েছেন। পেঁয়াজের দাম কবে নাগাদ কমবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না টিপু মুনশি। তবে তিনি পেঁয়াজের ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে চাল নিয়েও একই কাণ্ড। সরকারের ঠিক করে দেয়া দামে চাল বিক্রি হচ্ছে না কোথাও। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে প্রতি কেজি উৎকৃষ্টমানের মিনিকেট চাল ৫১ টাকা ৫০ পয়সা করে ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৪৫ টাকা দরে ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। পরে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর চালের পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম ধরে দেয়। মিলগেটে প্রতি কেজিতে নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত ২ টাকা বাড়িয়ে পাইকারি এবং পাইকারি পর্যায় থেকে প্রতি কেজিতে আরও আড়াই টাকা বাড়িয়ে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির জন্য দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেই হিসাবে উৎকৃষ্টমানের মিনিকেট প্রতি কেজি ৫৩ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করবেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা তা বিক্রি করতে পারবেন ৫৬ টাকা কেজি। একইভাবে পাইকারি বাজারে মাঝারি মানের মিনিকেট বিক্রি হবে কেজিতে ৪৭ টাকা এবং খুচরা বাজারে তা ভোক্তার কাছে বিক্রি করা যাবে প্রতি কেজি ৪৯ টাকা ৫০ পয়সায়। কিন্তু বাস্তব ভিন্ন। নিয়ন্ত্রণহীন। নির্ধারিত দামের বেশি মূল্যে চাল বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি কোনো কাজে আসেনি। আলামতে স্পষ্ট সরকার যতো হুমকি-ধমকিই দিক, চালবাজ-ধড়িবাজরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল।
আসলে চাল, ডাল, তেল, আলু যা-ই হোক। দাম বাড়লেও দোষ, কমলেও দোষ। বাড়লে বলা হয় মানুষকে ভোগান্তি দেওয়ার কথা। আর কমলে বলা হয় কৃষক দাম পাচ্ছেন না। এর বিপরীতে চালবাজি-কারসাজি তো রয়েছেই। চালবাজির সঙ্গে চালের যোগসাজশ থাকতে হয় না। চালের নিজের শক্তি নেই। নিজস্বভাবে চাল অচল-স্থবির একটি খাদ্যপণ্য মাত্র। নানা পণ্যের সঙ্গে এই চাল নিয়েও নিরন্তর চালবাজি। কাজটি করছে চালবাজরা। এরা চিকিৎসা, প্রাণরক্ষাকারী ওষুধ-পথ্যসহ সব কিছু নিয়েই চালবাজিতে পারঙ্গম। এখানে দয়া-মায়া, নৈতিকতার কিছু নেই। কিন্তু উচ্চারণ হচ্ছে চাল শব্দটি। যা মোটেই ধান থেকে বের করা খাদ্যপণ্য চাল নয়। আবার দোষ খুঁজতে গিয়ে আমরা টেনে আনছি আলুকে। পেঁয়াজকেও। আলুর দোষ-পেঁয়াজের দোষ বলে কিছু বদ স্বভাবকে ইঙ্গিত করা হয়।
বাংলা অভিধানে আলুর দোষের কোনো প্রতিশব্দ নেই। সমার্থক শব্দও নেই। ব্যাখ্যামুলক অর্থ আছে। এর অর্থ করা হয়েছে ‘মেয়েদের প্রতি পুরুষের মাত্রাতিরিক্ত ও অশোভন আসক্তি’। পেঁয়াজের দোষের অর্থগত অবস্থাও প্রায় এমনই। মানে মাদক খাওয়া। এ নিয়ে কিছু গল্প, চুটকি, জোকস রয়েছে। যেমন, ছেলের স্বভাব-চরিত্র বেশ ভালো। কেবল টুকটাক পেঁয়াজের দোষ আছে। মাঝে মাঝে একটু পেঁয়াজ খায়। সুকুমার রায়ের সৎপাত্র হিসেবে উপস্থাপিত গঙ্গারাম নামের যুবকটিকে এই দোষে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আলুর দোষে গঙ্গারামের বাইজি বাড়িতে যাওয়া বা পেঁয়াজ খাওয়ার জের আজও প্রাসঙ্গিক কি-না, সেই চিন্তা বাদই থাক।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন