জেলহত্যা; জাতির বেদনাদায়ক বিরল স্মৃতি
৩ নভেম্বর ২০২০ ১৪:২৩
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর গোটা দেশের মানুষ শোকে মুহ্যমান। পিতৃহত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই জাতিকে সাক্ষী হতে হয় আরেকটি কলঙ্কজনক ঘটনার। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ও ন্যক্কারজনক হিসেবে বিদিত।
১৫ আগস্টের বেদনাদায়ক অধ্যায়ের আড়াই মাস পর তৎকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (বর্তমানে জাদুঘর) একই বছরের ৩ নভেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। নির্মম এই ঘটনার ঠিক আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। এই সরকার পুরোপুরি সেনা সরকার ছিল না। এদিকে জাতির পিতার হত্যাকারী রশিদ, ফারুক ও তার কয়েকজন সহযোগী ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গভবনে অবস্থান নেন। মোশতাক ও তার সরকারের ওপর এই খুনিদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
এ নিয়ে সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এমন প্রেক্ষাপটে ২ নভেম্বর মধ্যরাতে (ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী ৩ নভেম্বর প্রথম প্রহর) মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আধাসামরিক সরকারের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ।
এমন অবস্থায় মোশতাক ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রীরা বুঝতে পারে যে, তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধুকে অকালে হারিয়ে দেশের মানুষ আশায় বুধ বেধেছিল জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে। জাতির বিশ্বাস ছিল— সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান জাতিকে আগের ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। কেননা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বাঙালির পরম নেতা বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন তারা।
এসব বুঝতে পেরেই সেনা অভ্যুত্থানকালে জেলখানায় হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর চার বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে। স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ও মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ ও মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিমের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ঘৃণ্যতম এ হত্যাকাণ্ড ঘটায় রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং তার সহযোগীরা।
কী ঘটেছিল সেই রাতে
জেলখানার ভেতর ৪৫ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর এই চার সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই রাতের বর্ণনা পাওয়া যায় তৎকালীন আইজি প্রিজন’স এন নুরুজ্জামান ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্তব্যরত ডিআইজি প্রিজনস কাজী আবদুল আউয়ালের প্রতিবেদন থেকে। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর তারা এই প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবের কাছে জমা দিয়েছিলেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ আগস্টের পর জাতীয় চার নেতাসহ আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাকে আটক করে কেন্দ্রীয় কারাগারের রাখা হয়েছিল। নিউ জেলের পাশাপাশি তিনটি কক্ষে তাদের রাখা হয়। ১ নম্বর কক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদসহ আটজন বন্দী। ২ নম্বর কক্ষে ছিলেন এ এইচ কামারুজ্জামানসহ ১৩ জন। ৩ নম্বর কক্ষে ছিলেন এম মনসুর আলীসহ ২৬ জন। সেই রাতে ১ নম্বর কক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে রেখে বাকি ছয়জন বন্দীকে অন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।
আর ২ নম্বর কক্ষে থেকে এ এইচ কামারুজ্জামান ও ৩ নম্বর কক্ষ থেকে এম মনসুর আলীকে ১ নম্বর কক্ষে নেওয়া হয়। এই কক্ষেই তাদের চারজনকে ৩ নভেম্বর রাতের শেষ প্রহরে (মূলত ২ নভেম্বর দিবাগত রাত ৪টা থেকে ৪:৩৫ টা) একসঙ্গে হত্যা করা হয়।
প্রতিবেদনে ঘটনার বর্ণনায় আইজি প্রিজন’স এন নুরুজ্জামান উল্লেখ করেন, “… মেজর রশিদ আবার ফোন করে আমাকে জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয় এবং ১. জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ২. জনাব মনসুর আলী ৩. জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৪. জনাব কামারুজ্জামান-এই ৪ জন বন্দীকে যেন তাকে দেখানো হয়।”
“এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোন প্রেসিডেন্টকে দেওয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান, আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশিদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছি কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি আমাকে তা পালন করার আদেশ দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৪ জন সেনা সদস্যসহ কালো পোশাক পরা ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে পৌঁছান। ডিআইজি প্রিজনের অফিসকক্ষে ঢুকেই তিনি আমাদের বলেন, পূর্বোল্লিখিত বন্দীদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে তাকে নিয়ে যেতে। আমি তাকে বলি, বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি আমাকে কিছু বলবেন। উত্তরে তিনি জানান, তিনি তাদের গুলি করবেন। এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি নিজে এবং ডিআইজি প্রিজন’স ফোনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। সে সময় জেলারের ফোনে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের আরেকটি কল আসে। আমি ফোনটি ধরলে মেজর রশিদ জানতে চান, ক্যাপ্টেন মোসলেম সেখানে পৌঁছেছেন কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দিই এবং তাকে বলি, কী ঘটছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন মেজর রশিদ আমাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে ক্যাপ্টেনের বন্দীদের গুলি করার ইচ্ছার কথা জানাই। প্রেসিডেন্ট জবাব দেন, সে যা বলছে তাই হবে। তখন আমরা আরও উত্তেজিত হয়ে যাই। ক্যাপ্টেন মোসলেম বন্দুকের মুখে আমাকে, ডিআইজি প্রিজন, জেলার ও সে সময় উপস্থিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন, যেখানে উপরোল্লিখিত বন্দীদের রাখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ও তার বাহিনীকে তখন উন্মাদের মতো লাগছিল এবং আমাদের কারও তাদের নির্দেশ অমান্য করার উপায় ছিল না।”
প্রতিবেদনে তিনি আরও উল্লেখ করেন, “তার নির্দেশ অনুযায়ী পূর্বোল্লিখিত ৪ জনকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করা হয় এবং একটি রুমে আনা হয়, সেখানে জেলার তাদের শনাক্ত করেন। ক্যাপ্টেন মোসলেম এবং তার বাহিনী তখন বন্দীদের গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল সবাই মারা গেছে কিনা তা নিশ্চিত হতে জেলে আসে। তারা সরাসরি সেই ওয়ার্ডে চলে যায় এবং পুনরায় তাদের মৃতদেহে বেয়নেট চার্জ করে।” (সূত্র: সিমিন হোসেন রিমি; আমার ছোটবেলা, ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ১৯৫-২০০।)
হত্যাকাণ্ডের বিচার
জেলখানায় নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞের পরদিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন’স কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তার নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করেন। গুলি করার পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
ঘটনার পরদিন মামলা করা হলেও এই মামলার তদন্ত থেমে ছিল ২১ বছর। এরপর থেমে থেমে চলে মামলার কার্যক্রম। ঘটনার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তিন আসামি মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১২ আসামি হলেন— লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।
২০০৮ সালে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য রায়সহ মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে আসে। এ ছাড়া কারাগারে থাকা যাবজ্জীবন দণ্ডিত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) আপিল করেন। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির মধ্যে মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পান। আপিলকারী চার দণ্ডিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পান। যাবজ্জীবন দণ্ডিত অপর আট আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে।
অবশ্য সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) জেল হত্যায় অব্যাহতি পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৮ জানুয়ারি ২০১০)
এদিকে জেলহত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। আপিল বিভাগ দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে হাইকোর্টের খালাসের রায় বাতিল করে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১১ আসামির কাউকে এখনও সাজার আওতায় আনা যায়নি। আসামিদের সবার অবস্থান সম্পর্কেও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি জেলহত্যায় নিহত জাতীয় চার নেতার একজন এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে রাজশাহীর জনমানুষের এই নেতা বললেন, চার নেতার পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আমারও দাবি— যারা এই জঘন্য কাজ করেছিল তাদের শাস্তি হোক। তাদের দেশের বাইরে থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হোক।
আমরাও চাই যারা রাতের অন্ধকারে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হিসেবে বিবেচিত জেলখানায় এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছিল তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হোক। বাঙালি জাতি কোনো কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে চায় না। জাতি কলঙ্কমুক্ত হতে চায়। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তা করবে বলেই বিশ্বাস।
অসাম্প্রদায়িক ও দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধুকে আমরা আর পাবো না, পাবো না জাতীয় চার নেতাকে। চলতি বছরে আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার আদর্শেই গড়ে উঠুক নতুন প্রজন্ম।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; জামালপুর