আওয়ামী লীগ অতীত ভুলে যেতে চায়!
৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৬:৫৯
‘আগের নাঙল যেদিকে যায়, পেছনের নাঙলও সেদিকেই যাবে’। অর্থাৎ মাটি উর্বর করতে প্রথম কৃষক জমিতে হাল চাষ নিয়ে এগিয়ে গেলে পেছনের কৃষকরাও তাকে অনুসরণ করে, প্রথম কৃষকের পেছনে-পেছনে যেতে থাকে। অথবা সহজ করে বললে, যিনি পথ দেখান, তাকেই মানুষ অনুসরণ করে।
যেমন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সেই ছাত্রজীবন থেকেই নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। অধিকার বঞ্চিত মানুষদের সাহস দিয়েছেন। যেখানে অত্যাচার হয়েছে, সেখানেই শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আর এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর আত্মপ্রত্যয়। মানুষ প্রতিবাদী হয়েছে, আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে।
‘খোকা’ থেকে ‘মুজিব ভাই’ হিসেবে তিনি সার্বজনীন ভালোবাসার, শ্রদ্ধার আর নির্ভরতার মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কারণ, তিনি সবার অধিকারের কথা বলেছেন। সবার প্রাপ্য সম্মান দিতে পেরেছেন। যার যতটুকু অবদান, তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোর বিরোধী ব্যক্তিদেরও তিনি ভালোবাসা দিয়ে জয় করেছেন। স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বাঙালির ‘মুজিব ভাই’ হতে পেরেছেন।
এই ‘মুজিব ভাই’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির পিতা’ হয়েছিলেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রাম করেছেন দীর্ঘ চব্বিশ বছর। জীবনের সোনালী অংশটুকু কারাগারেই কাটিয়েছেন। স্বাধীনতাকামী বাঙালির স্বপ্ন, আশা আর ভালোবাসাগুলোকে নিজের করে ভেবেছেন, আপন করে ধারণ ও লালন করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের কথার মধ্য দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কথার বহিঃপ্রকাশ হতো। আর তাই ৭ই মার্চের মন-মন্ত্রময় ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছে। সম্ভ্রম বিনাশে দুই লাখেরও বেশি নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ অত্যাচার সহ্যের লাল-সবুজ’র বাংলাদেশ আজ বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল।
‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ ও ‘বাংলাদেশ’ এক ও অভিন্ন অংশ। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া যেমন বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না, আবার বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করতে হলেও সবার আগে শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস লেখতে হবে। একটি ছাড়া আরেকটি অসম্পূর্ণ—এটাই ইতিহাসের পাঠ।
আবার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এদেশের কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, পাহাড়ি, ছাত্র, জনতা, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলিমরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে, তাদের বাইরেও ইতিহাসের পবিত্রতা রক্ষা হবে না।
ইতিহাস একটি জাতির শিকড়। পবিত্র আমানত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে এই পবিত্র আমানতের খেয়ানত শুরু করেন জিয়াউর রহমান। যার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কখনো জাতীয় ব্যক্তিত্বদের সম্মান দিতেন না—এই কথাটি সার্বজনীন মন্তব্য। তবে, ক্ষমতার জন্য সম্মান করার ভান করতেন, অভিনয় দেখাতেন—এটিও সত্য। আর বিএনপির অনেক নেতাকর্মীরাও পরবর্তী একই ধারা বজায় রেখেছে। খোদ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাত্রদলের নেতাকর্মী দ্বারা তালাবদ্ধ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, শিক্ষক ও ভদ্রলোকখ্যাত সর্বজনস্বীকৃত জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ফটো-ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক, দেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো চিকিৎসকও বিএনপির নেতাকর্মী দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন। জীবন বাঁচাতে রেললাইন ধরে সেই দৌড়ের দৃশ্যে আজও দেশের সচেতন মহল শঙ্কিত, ঘৃণা করে।
সঠিক ইতিহাস একটি জাতির সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে সহায়তা করে। সুনাগরিক সৃষ্টি করে। কিন্তু বাংলাদেশ এদিক দিয়ে অনেকটাই গরীব, আন্তরিকতার অভাব আর অবহেলার দৃষ্টান্ত অহরহ। এদেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়ে থাকেন স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ব্যক্তি ও মহল। এদেশের প্রখ্যাত কবি তার জাতীয় পুরস্কার না পাওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফেসবুকে। আর তখন একশ্রেণির কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। এদেশের সম্মানীদের সম্মান যথাযথভাবে দেওয়া হয় না। যার যতটুকু অবদান, স্বীকৃতি জানাতেও কার্পণ্যবোধ করা হয়। আবার এদেশের জ্ঞানী, গুণীদের কথা—তেমনটা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। অন্যদিকে, সমালোচনা-রীতিমত অসহ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যেন।
বরং ভিন্নমতের নামে, বাক স্বাধীনতার নামে যখন সংসদে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে মিথ্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি করা হয়, তখন রাষ্ট্র নীরব সমর্থক হয়ে যায়। যখন ওয়াজ-মাহফিলের নামে জাতীয় বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদের নামে অপপ্রচার করা হয়, হত্যার ফতোয়া দেওয়া হয়, তখনও রাষ্ট্র নীরব দর্শক হয়ে পড়ে। আবার যখন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান লেখক-ব্লগারদের চাপাতির কোপে হত্যা করে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় কর্মকর্তার দায়িত্বের প্রতি অদক্ষতা আর উদাসীনতার দৃশ্য ভেসে বেড়ায়।
‘ইতিহাসের শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না’—কথাটি প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক-নাট্যকার বার্নার্ড শ তার নিজ দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে বললেও বাংলাদেশের বেলায় কথাটি একেবারেই অমূলক নয়। নিকট অতীতের রাজনীতির পর্যবেক্ষণ করলে এটিই সত্য বলে প্রতীয়মান। এদেশের রাজনীতিকেরা যদি ইতিহাস থেকে সঠিক শিক্ষা নিতেন, ধারণ করতেন, তাহলে স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর বাংলাদেশ আজ এতটা কঠিন অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়াত না। জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী অপশক্তিও ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস, সুযোগ পেত না।
কারণ, আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছি না। জাতীয় ব্যক্তিত্বদের যথাযথ মূল্যায়ন করছি না বলেই আজ মানবতা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অপশক্তি চারপাশ দখল করার চেষ্টা করছে। যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতাকামী ঐক্যবদ্ধ হয়েছে—আজ এখানেও হতাশার প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান। রাজনীতি যখন আমলা কিংবা প্রশাসন নির্ভর হয়ে পড়ে, রাজনীতির চর্চায় কিংবা কর্মসূচীতে যখন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট দখল করে, যখন রাজনীতিবিদের মতো প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তার বক্তব্য-বিবৃতি প্রতীয়মান হয়—তখন গোটা রাজনীতির সাথে রাজনীতিবিদও থমকে দাঁড়ায়। লজ্জা পায় রাজনীতি আর অবমূল্যায়ন করা হয় প্রখ্যাত রাজনীতিবিদের।
৩ জানুয়ারি দেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, যিনি আমৃত্যু শুদ্ধ রাজনীতির চর্চা করেছেন—সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবস ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মাটি ও মানুষের রাজনীতির ধারক ও বাহক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের আত্মার মাগফেরাত, শান্তি কামনা করলেও আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল রীতিমত অবহেলা করেছে। দলের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অবমূল্যায়ন করেছে। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী স্বয়ং আওয়ামী লীগ থেকেই পালন করা হয়নি। এর চেয়ে দুঃখজনক, হতাশার বিষয় বর্তমান উদীয়মান রাজনীতিবিদের কাছে আর কী হতে পারে?
আর এই হতাশার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ শুধু আগামীর রাজনীতিবিদের মাঝেই দৃশ্যমান হয়নি, দেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, সংবাদ উপস্থাপক সহ বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য শ্রেণিপেশার মানুষের ক্ষোভগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যোগ্যদের ‘অবমূল্যায়ন’ প্রতিক্রিয়া শোনা গেছে। অনেকে আবার ছাত্রলীগ, যুবলীগ সহ অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিয়েও সমালোচনা করেছে।
আমি উপরেই উল্লেখ করেছি—আগের হাল যেদিকে যাবে, পেছনের হালও সেদিকেই এগুবে। আওয়ামী লীগ যেখানে তার দলের গ্রহণযোগ্য ও শুদ্ধ রাজনীতির ধারক-বাহক, সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী দলীয়ভাবে পালনে অবহেলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, সেখানে পেছনের উদীয়মান রাজনীতিবিদের দোষইবা কতটুকু।
তবে, ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহবুব উল আলম হানিফকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। বেলা শেষে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু নেতাকর্মী নিয়ে ঠিকই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন ও তার রুহের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন।
ঐতিহাসিকভাবে, আওয়ামী লীগ ইতিহাস বিকৃতি কিংবা মুছে ফেলার রাজনীতি নয় বরং ইতিহাস সৃষ্টির রাজনীতি করে। আর এটাই আওয়ামী লীগের ‘ঐতিহ্য’। আর এই ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি ঘটলে, আওয়ামী লীগের নিজস্বতা বলতে কিছু থাকবে না। আওয়ামী লীগ সৃষ্টি ও স্বীকৃতি নিয়েই উদীয়মান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তৈরি করবে—এটাই বাঙালির প্রত্যাশা।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)