রক্তাক্ত পথ থেকে তুলে নেই ক্ষমতার হাত
২৬ জানুয়ারি ২০২১ ০১:৩৬
চলতি মাসের ১৮ জানুয়ারি দুপুরের পর থেকে অনলাইন গণমাধ্যম আর টেলিভিশনে সবচেয়ে আলোচিত ছিল রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় একটি বাসের চাপায় আকাশ ও মিতুর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর। ১৯ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত খবরটি পত্রিকায় ছাপা হয় আরেকটু ভিন্নভাবে। অর্থাৎ বাসচাপায় মৃত্যু হওয়া দম্পতি রেখে গেছেন ছোট্ট শিশু ‘আনজুমকে’। বাবা-মায়ের সঙ্গে অবুঝ শিশুটির ছবিটি ছাপা হয়েছে বেশিভাগ গণমাধ্যমে। সকালে যারা পত্রিকার পাতায় এই ছবিটি দেখেছেন, তাদের অনেকেই চোখের জল ধরে আর রাখতে পারেননি। বছরের শুরুতে সড়কে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা এটি। যে ছবিটি কাঁদিয়েছে বহু মানুষকে, তেমনি আতঙ্কিত করে তুলেছে, এটাই স্বাভাবিক। যৌক্তিক।
আনজুম যখন প্রতিদিনের মতো বিছানায় ঘুমে, তখন বাবা-মা অফিসের জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে যান। পরম যত্নে আদরের সন্তানকে হয়তো সেদিনও ঘুমে রেখে এসেছিলেন আকাশ আর মিতু। আনজুমের যখন ঘুম ভাঙল, ঠিক তখন তার সামনে বাবা-মায়ের নিথর দেহ!
একবার ভাবুন তো? যদি আপনার বা আমার পরিবারে এমন একটি ঘটনা ঘটে, এমন নির্দয় একটি সকাল এসে উপস্থিত হয়, তখন উপলব্ধি কেমন হবে? নিষ্পাপ এই শিশুটির নিরাপদ ভবিষ্যতের দায় এখন কে নেবে? বাবা-মায়ের অভাব কি অন্য কাউকে দিয়ে পূরণ হয়? শিশুটির ভবিষ্যৎ যেভাবে রচনা করার কথা ছিল, তা কি পিতা-মাতার অনুপস্থিতিতে হবে? এমন না হোক, বাবা-মায়ের রক্তাক্ত লাশ শিশুটির মনে মারাত্মকভাবে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে। শিশুটি যদি বাকশক্তি হারায় অথবা কথা না বলে। দুঃস্বপ্নে রাতে চিৎকার করে ওঠে। তাহলে তো তারও ভবিষ্যৎ একেবারেই অনিশ্চিত। সব মিলিয়ে এ কথা বলা যায়, বাবা-মায়ের মৃত্যুতে এই শিশুটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। এমন সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। বাসটির চালক পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও কবে বিচার হবে? বিচার হলেও কি শিশুটি ফিরে পাবে বাবা-মাকে?
অথচ দুর্ঘটনার এমন মারাত্মক প্রভাবগুলো আমাদের কারো মনে একবারও হয়তো রেখাপাত করে না। যদি করেই থাকে, তবে এত আলোচনা আর সমালোচনার মধ্যেও সড়ককে কেন নিরাপদ করা যাচ্ছে না? প্রতিবছর সড়কে গাড়ি বাড়ছে। অথচ দক্ষ চালক বাড়ছে না। লাইসেন্সবিহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রায় ১৭ লাখ চালক দাবড়ে বেড়াচ্ছে দেশ। সরকারি হিসাবের বাইরেও আরও কত লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছে, এর সঠিক পরিসংখ্যান কারো হাতে নেই। সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ার পেছনে রয়েছে গাড়ি চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা। সেই সঙ্গে আইন না মানার প্রবণতাও বাড়ছে। মূলত এসব কারণেই সড়কে দুর্ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। নিরাপদ হচ্ছে না সড়ক-মহাসড়ক। এমন একটি দিন নেই, যেদিন গণমাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের খবর থাকে না।
কয়েক বছর আগে রাজধানীর যানজট আর সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে একটি সেমিনার হয়েছিল। সেখানে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এসেছিলেন। ঢাকার সাবেক একজন পুলিশ কমিশনার মতামত দিয়ে বলেন, ‘আমরা যদি আইন মানি, তাহলেই যানজট কমবে অন্তত ৬০ ভাগ। তেমনি সড়ক দুর্ঘটনাও নিয়ন্ত্রণে আসবে।’ এই মতের যৌক্তিকতা যথেষ্ট। কারণ গোটা পরিবহন সেক্টর যে মহাবিশৃঙ্খল, তা নতুন করে বলার কিছু নেই।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘ডেলিভারিং রোড সেফটি ইন বাংলাদেশ: লিডারশিপ প্রায়োরিটিস অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভস টু ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে দুর্ঘটনাকবলিত প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মারা যায় ১০২ জন। পাশের দেশ ভুটানে এ সংখ্যা ১৬ দশমিক ৭০, ভারতে ১৩, নেপালে ৪০ ও শ্রীলংকায় ৭।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের দুর্ঘটনায় গড়ে দুজন সাইকেলচালকের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়। দুই বা তিন চাকার মোটরযানের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ১১ দশমিক ২০। আর গাড়ি ও হালকা যানের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ হাজার যানের দুর্ঘটনায় ১৩ দশমিক ৩০ জন গাড়িচালক ও ২৮ দশমিক ৬০ জন যাত্রী প্রাণ হারায়। ট্রাকচালকদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৬ দশমিক ১০, বাসচালকের ক্ষেত্রে ৮ দশমিক ২০ ও বাসযাত্রীর সংখ্যা ২৮৬ দশমিক ৬০। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আবার সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএর হিসাব মতে, প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় প্রায় ৩০ জন। সে হিসাবেও বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৮০০। আবার বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বছরে ১২ হাজার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকর্ড অনুযায়ী ২০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এটা ঠিক যে পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেসব দেশে যথাযথভাবে বিচারের মুখোমুখি হয় চালকরা। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। গোটা পরিবহন খাতই বেসরকারি খাতে জিম্মি, তেমনি রাজনৈতিক প্রভাবে এই সেক্টরে ভালো কাজ যেমন করা দায়, পাশাপাশি শৃঙ্খলা ফেরানোও কঠিন হচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ২০২০ সালের বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৬ হাজার ৬৮৬ জন। আহত ৮ হাজার ৬০০ জন। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ বেপরোয়া গতি। বেশিভাগ দুর্ঘটনাই গাড়িচাপায়। সংগঠনটি বলছে, ২০১৯ সালের সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেলে সড়ক দুর্ঘটনা ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। বুয়েটের গবেষণা বলছে, মোট দুর্ঘটনার ৩৫ ভাগই মোটরসাইকেলে।
মোটরসাইকেলের বিষয়টি কেন সামনে আসছে। এর কারণ হলো ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে এখন সাইকেলের বিকল্প মোটরসাইকেল। রাজধানীতে অ্যাপভিত্তিক যাত্রীসেবা চালুর পর মোটরসাইকেল কেনার প্রবণতা বেড়েছে বহুগুণ। তরুণদের আকৃষ্ট করতে নতুন নতুন অফার নিয়ে সামনে হাজির হচ্ছে মোটরসাইকেল কোম্পানিসহ অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে এই বাহনটি যেমন বিক্রি বেড়েছে, তেমনি অদক্ষ চালকও বাড়ছে। আমদানি-নিষিদ্ধ ইজিবাইকেও দেশ সয়লাব। এতেও বাড়ছে বিপজ্জনক চালকের সংখ্যা।
বিআরটিএ বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, ভালো মানের একটি হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। আর মৃত্যুঝুঁকি কমে ৪০ শতাংশ। বড় শহরের বাইরে হেলমেট না পরার প্রবণতা বেশি। দুজনের বেশি মোটরসাইকেলে চলা নিষিদ্ধ থাকলেও কেউ তা মানছে না। মানানোর জন্য বাধ্য করাও সম্ভব হচ্ছে না।
নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিআরটিএ গোটা পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে কার্যত ব্যর্থ হচ্ছে। তবে এর পেছনে আছে জনবলসংকটসহ সদিচ্ছার অভাব। তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে যেমন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তেমনি দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই জায়গা থেকে চলমান সংকটকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে সড়ককে নিরাপদ করার জন্য রাষ্ট্রের কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিবহনের চালক বা শ্রমিকদের ধারণা পেশাগত কারণে তাদের জীবন অনেক ক্ষেত্রেই তুচ্ছ। সামাজিকভাবেও তাদের মর্যাদা অনেক কম। তাই অনেক সময় তারা জীবনের মায়া করেন না। মানবিক বিষয়গুলো অনেক সময় তাদের স্পর্শ করে না। ফলে ইচ্ছামতো যানবাহন চালান অনেক চালক। যাদের দুর্ঘটনা ও মৃত্যু নিয়েও তেমন কোনো ভাবনাও নেই।
বাস্তবতা যদি তাই হয়, এ ক্ষেত্রে পরিবহন শ্রমিকদের মানবিক বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করা জরুরি। প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। সেই সঙ্গে দুর্ঘটনায় ‘হিউম্যান লস’ হওয়ায় বিষয়গুলো গবেষণায় তুলে আনতে হবে। এমন একটি গবেষণা যদি সবার সামনে তুলে ধরা যায়, তা হলে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হতে পারে। সেই সঙ্গে ‘আইন মানা’ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। নিশ্চিত করতে হবে আইনের কঠোর প্রয়োগও। বেপরোয়া গতির যান স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমানোর প্রযুক্তি দ্রুত চালু করতে হবে। ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধসহ নিষিদ্ধ যানবাহন মহাসড়কে চলাচল রোধ করা এখন সময়ের দাবি। করোনার মধ্যেও কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে বছর শেষে এমন পরিসংখ্যান আসেনি। এ জন্য সরকার, মালিক, শ্রমিক, পথচারী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার দায়িত্ব রয়েছে।
সর্বোপরি পরিবহন সেক্টর থেকে রাজনীতির হাত সরিয়ে নিতে হবে। কোনো রকম ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করা যাবে না। তেমনি পাঠ্যপুস্তকে ট্রাফিক আইন ও দুর্ঘটনার ক্ষতির বিষয়গুলো যুক্ত করা জরুরি। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পুরোপুরি কার্যকর করা সহ এই সেক্টরে তদারকি বাড়াতে হবে। সবাই সমানভাবে জেগে উঠতে পারলে এই দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে আনা খুব কঠিন হবে না। এর মধ্য দিয়ে সড়কে ‘রক্তস্নান’ কমবে। তেমনি আনজুমরাও নিরাপদ থাকবে। পরিবারের আদর-স্নেহ আর ভালোবাসায় বেড়ে উঠবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। সড়কে চলাচলে কমবে শঙ্কা।
লেখক: লেখক ও সাংবাদিক