Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুচির নৈতিক পতন ঘটেছিল আরও আগে


১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৫২

মিয়ানমারের জন্য সামরিক শাসন নতুন কিছু নয়, স্বাধীনতার ৭২ বছরের মধ্যে ৬০ বছর ধরে দেশটি থেকেছে সেনা সরকারের অধীনে। সম্প্রতি কথিত গণতন্ত্রের যাত্রা পথে হোঁচট খেয়ে আবার সরাসরি সেনা শাসনে ফিরল মিয়ানমার। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেনাবাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) ভরাডুবি হবে এটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার ছিল। নির্বাচনে হয়েছেও তাই। ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে সুচির ‘ক্ষমতাসীন’ ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। নির্বাচনে এই ফলাফলের পর ইউএসডিপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে কারচুপির এক হাজারও অধিক অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। এসব অভিযোগকে ইস্যু করে মিয়ানমারের সরাসরি ক্ষমতা নিলো সেনাবাহিনী। ক্ষমতা না দিলেও মিয়ানমারের অঘোষিত ক্ষমতাসীন সেনাবাহিনী। ২০০৮ সালে সংবিধানে যে সংশোধনী আনা হয়েছিল তার ফলে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অধীনে চলে যায়। এছাড়া সংসদের মোট আসনের ২৫ ভাগ কোটা সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষণ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সামরিক ক্যুর পেছনে চীনের মৌন সমর্থন রয়েছে। এটা বলা অবান্তর নয়, মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক পরিবেশ স্থায়ী হলে সেখানে পশ্চিমা প্রভাব বাড়বে এই আশঙ্কা চীনের আছে। চীন এই ঘটনাকে মিয়ানমারের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে বর্ণনা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের হুমকি দিয়েছে। বারাক ওবামার আমলে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে উৎসাহিত করতে তৎকালীন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিল মার্কিন প্রশাসন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে মার্কিন-মিত্র ও মিয়ানমারের পরীক্ষিত মিত্র জাপান চুপ থেকেছে। জাপান মিয়ানমারে চীনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া আসলেও আসিয়ান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া ছিল গতানুগতিক। কোনো কোনো সামরিক বিশেষজ্ঞ বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘আরটুপি’ রেজুলেশন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সামরিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করছেন। রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনে মার্কিনীরা যেখানে তর্জন গর্জনে সীমাবদ্ধ ছিল সেখানে এই ইস্যুতে তারা এতদূর যাবে না। একটি বিশ্লেষণ রয়েছে যে, নতুন মার্কিন প্রশাসনকে চীন থেকে ফিরিয়ে মিয়ানমার বা আফ্রিকামুখি নানা সংকটে ব্যস্ত রাখার কৌশল রয়েছে চীনের। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন মিয়ানমারে খুব কৌশলে পা ফেলবে। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া ও মিয়ানমারে চীন অন্য কোনো দেশের—বিশেষ করে পশ্চিমাদের উপস্থিতির ঘোরতর বিরোধী। ফলে মিয়ানমারের উপর যে কোনো অবরোধ আরোপে দেশটির পাশে ছাতা হবে চীন।

বিজ্ঞাপন

ইতিমধ্যে জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাব আটকে দিয়েছে চীন। অন্যদিকে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে সম্ভব সব করছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সুচি ও তার দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ইন্টারনেট, ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করছে।

তবে সেনাবাহিনীর মধ্যে নিজস্ব চাপ ছিল এই অভ্যুত্থানের পক্ষে। সেনাপ্রধান মিং অং হ্লাইং-সহ ডজনখানেক জেনারেলের মেয়াদ শেষের দিকে। ক্ষমতা থেকে সরলেই তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক আদালতের পরোয়ানা এসে পড়তে পারে। কিন্তু সুচি তাদের মেয়াদ বাড়াতে রাজি ছিলেন না। অন্যদিকে জাতিসংঘের অধিবেশনে রোহিঙ্গা জাতিগত নিধনকে অস্বীকার করলেও গাম্বিয়ার করা মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গাদের ‘দুর্দশা’র কথা স্বীকার করেন সুচি। সেই সঙ্গে হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য সহিংসতায় সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার বিচার হতে পারে বলেও মন্তব্য তার। ফলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সুচির উপর আস্থা উঠে যায়। জেনারেলরা নিজেদের বাঁচাতে সরাসরি ক্ষমতার মসনদে বসে।

তবে মিয়ানমারের এই পরিস্থিতি রোহিঙ্গা সংকটকে আরও জটিল করতে পারে। কারণ সেনাবাহিনীর বর্তমান পদাতিক লোকজন জঘন্য ধরনের বর্ণবাদী ও উগ্রবাদী। রোহিঙ্গাসহ আরও প্রায় চারটি জাতিগোষ্ঠীকে তারা নিজেদের বলে স্বীকার করে না। তারা প্রত্যাবাসন আলোচনাকে আরও দীর্ঘায়িত করতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক অঙ্গনে দক্ষতা ও কৌশলতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত। এই শরণার্থীদের দায়ভার বাংলাদেশের পক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে বহন করা সম্ভব নয়।

সুচির ভবিষ্যত কী
অং সাং সুচি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। দীর্ঘ পনের বছর কেটেছেন হাজত বাস। তিনি তার বলিষ্ঠতার বলে হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্র ও শান্তির প্রতীক। কিন্তু যে সেনাবাহিনী মিয়ানমারের গণতন্ত্রকে মাটি চাপা দিয়েছিল, সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে গত নির্বাচনে সমঝোতা করে একটি ‘হাইব্রিড’ সরকারের নামমাত্র প্রধান হয়েছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাদের গণহত্যা চলাকালে তিনি নির্লজ্জভাবে সেনাবাহিনীর পক্ষে নিয়েছিলেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনকে অস্বীকার করে জাতিসংঘে সর্বোচ্চ আসনে দাঁড়িয়ে তিনি রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালানো সেনাবাহিনীকে নির্দোষ দাবি করেন। সারা বিশ্বে যখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর চালানো জাতিগত গণহত্যা নিয়ে সোচ্চার তখন সুচি সারাজীবনের সুনাম, পুরস্কার সব বিসর্জন দিয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। সুচি যখন পনের বছর কারাগারে ছিলেন তখন রোহিঙ্গারা প্রার্থনারত ছিল সুচি ফিরলে তাদের অধিকার মিলবে। কিন্তু সুচি ফিরে রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয়কে অস্বীকার করলেন। আর ক্ষমতায় আসীন হয়ে জাতিগত নিধনকে মেনে নিলেন। সুচির প্রতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাশার প্রতিদান এভাবেই দিয়েছিলেন তিনি।

আর যে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ‘হাইব্রিড’ ক্ষমতা ভাগাভাগির লোভে জীবনের সব অর্জন বিসর্জন দিলেন, সেই সেনাবাহিনী তাকে প্রতিদান দিলো ক্যু দিয়ে। কোনভাবে সামরিক ক্যু’কে সমর্থন করা যায় না, কিন্তু এতদিন মিয়ানমারে যা চলেছে তাকেও গণতন্ত্র বলা যায় না। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রাধান্য দেয়, কিন্তু সংখ্যালঘুর অধিকারকে সংরক্ষণ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্তৃত্বে ও জনপ্রিয়তার মোড়কে সংখ্যালঘুকে নিধন করা গণতন্ত্র নয়। কিন্তু সুচি তাই করেছিলেন। কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা বলছে, সুচির জন্য তাদের কোনো দুঃখ নেই। এরকম অনেকেরই সুচির প্রতি কোনো সমবেদনা নেই আজ। আজ হয়ত সামরিক ক্যু’র মাধ্যমে অং সাং সুচি সরকারের পতন ঘটল, কিন্তু সুচির নৈতিকতার পতন ঘটেছিল বহু আগে। ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে যাওয়া অং সাং সুচি ক্ষমতাহীন বন্দি জীবনে আলো ফিরে পাবেন, এটাই প্রত্যাশা। কবিগুরু লিখেছেন, ‘অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ’।

অং সান সুচি মিয়ানমার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর