Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার মতোই সুশৃঙ্খল হোক স্বাস্থ্যখাত


১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৬:২৩

বাংলাদেশে এখন ভ্যাকসিন উৎসব চলছে। সরকারের সঠিক পদক্ষেপে একটি সফল ও ব্যতিক্রমী ভ্যাকসিন উৎসবে মুখরিত পুরো দেশ। সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশে খুব দ্রুত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আসে। প্রথম দিকে জনমনে একটু সংশয় থাকলেও বর্তমানে ভ্যাকসিন কেন্দ্রে ভিড় প্রমাণ করে এখন আর সংশয় নেই। এখন বইছে স্বস্তির বাতাস।

ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয়, আঞ্চলিক পর্যায়ে কমিটি গঠন এবং সে অনুযায়ী সঠিক পরিকল্পনা টিকা কর্মসূচিকে উৎসবে পরিণত করেছে, একথা বলা যায়। কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি রয়েছে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটি, ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা ওয়ার্কিং গ্রুপ, জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় কমিটি হলো কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটি। দেশে করোনার টিকাদান কার্যক্রম সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য ১৬ সদস্য বিশিষ্ট জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গঠিত। স্বাস্থ্যের বাইরে অন্যান্য বিভাগের প্রতিনিধিত্ব থাকায় টিকার কমিটির পরিধি বিস্তৃত হয়েছে, যা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। দেশে প্রথম করোনা ভ্যাকসিন উদ্বোধন হয় ২৭ জানুয়ারি। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬৮ জন মানুষ করোনার ভ্যাকসিন নিয়েছেন। এর মধ্যে নারী ছিলেন ৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৪৯ জন। এটা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী সাফল্য। দেশব্যাপী এই বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর সঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

সাংবাদিক সাহাবুদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, করোনা টিকা কর্মসূচি ব্যবস্থাপনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, এত সুন্দর অভিজ্ঞতা হবে বলে কখনও কল্পনাও করিনি।

বিজ্ঞাপন

জাপানের হিতসুবাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক বিল্লাল বাপ্পী, কয়েকজন বন্ধু মিলে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন সীতাকুন্ডে। তিনি জানান, বাংলাদেশ ভ্যাকসিন গ্রহণ কর্মসূচি এত সূচারুরূপে আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলেই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। তিনি বলেন, টিকা একটি উৎসবের মতো আয়োজন, আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একই কেন্দ্রে টিকা গ্রহণ করি, টিকা ব্যবস্থাপনা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করেছে।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা নিশাত আরা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নৌবাহিনীর হাজি মহসীনকে টিকা কেন্দ্র বেছে নেন। টিকা কিংবা ইনজেকশন ভীতি ছোটবেলা থেকেই এই গৃহিণীর। গত মঙ্গলবার যথারীতি হাজির হন টিকা কেন্দ্রে। তিনি জানান, টিকার ব্যবস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে টিকাভীতি দূরীভূত হয় নিমিষেই। সুন্দর ও একটি সুষ্ঠু পরিবেশে টিকা গ্রহণ ও টিকা পরবর্তী একটি সহায়ক পরিবেশ মন ভালো করে দেয় বলেও জানান তিনি।

এত কিছুর পরও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে কিছু অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে উঠে করোনাকালে। করোনা আমাদের দেখিয়ে দেয়, আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা নাজুক। ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা সোহানা ইয়াসমিন। গভীর রাতে পেটব্যথা দিয়ে কাতরাতে থাকেন। ছুটেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। ভর্তি হতে পারেন না। প্রচণ্ড ব্যথা বেদনা দিয়ে সারারাত কাটাতে হয় অ্যাম্বুলেন্সের নিথর সিটে। সোহানা ইয়াসমিনের মতো হাজারো রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েন এই করোনায়। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই করোনা ঢাকাসহ সারাদেশ আইসিইউ সংকট কতটা প্রবল, করোনাকালে টের পেয়েছে দেশের জনগণ।

সাহেদ কিংবা সাবরিনা, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের মধ্যে কিভাবে এদের আগমন ঘটেছে কিংবা প্রভাব বিস্তার করেছে, সেগুলো এখন সবারই জানা। কিছু ব্যক্তির কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে গভীর সংকটে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় রয়েছে নানা অভিযোগ। গত বছর রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালের কর্মচারীদের মারধরে কিভাবে পুলিশের একজন এএসপি নিহত হন। যেখানে নামকরা সরকারি একটি হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ও পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে এবং গ্রেফতার হন। খোদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছরের ২০ অক্টোবর একজন নবজাতককে মৃত ঘোষণা করে পরিবারকে হস্তান্তর করেন। পরিবারের লোকজন ধর্ম মতে দাফনের সময় শিশুটি নড়ে উঠে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালকের গাড়ির ড্রাইভারের বিত্ত বৈভবের নানা সংবাদে গত বছর ছিল সরগরম। কিভাবে  একজন গাড়িচালক বনে যান শত কোটি টাকার মালিক।

কোভিড-১৯ এর কারণে অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরাও চিকিৎসা পাননি বলে খবরে প্রকাশ। কেন্দ্রীয়ভাবে সঠিক তদারকির প্রকট সংকট চোখে পড়ে। তারপর দৃষ্টি দেন প্রধানমন্ত্রী। আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। দৃশ্যমান কিছু উদ্যোগ স্বাস্থ্য খাতকে একটি উন্নত সেবাখাত হিসেবে তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে করোনাকালে আমরা দেখেছি জীবনের মায়া ত্যাগ করে কিভাবে ডাক্তার ও নার্সরা সেবা দিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক চিকিৎসক। সম্মুখসারির এসব যোদ্ধারা দেখিয়েছেন মানবতা কিভাবে বেঁচে আছে।

স্বাস্থ্য খাতে উদ্যোক্তাদের বাণিজ্যিকীকরণ মনোভাব পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে। অভিযোগ আছে, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও টেস্ট দিয়ে অতিরিক্ত খরচের দিকে রোগীকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই বিষয়টি অধিক গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সমাধানের পথ খোঁজতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সরকারিভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার সুযোগ আরও সম্প্রসারণ করা দরকার। যাতে রোগীরা সহজেই নির্ভুল সেবা পায়।

আমাদের রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বেশি থাকে। এটিকে কিভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। বিশেষায়িত হাসপাতালে থাকার কথা জটিল ও মূমূর্ষ রোগীদের। কিন্তু আমাদের এখানে তার ব্যতিক্রম। তুলনামূলক কম ও অল্প চিকিৎসায় রোগ সেরে উঠবে এমন রোগীদের অন্য হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সম্প্রসারণ করা দরকার। বর্তমান সরকার সারাদেশের হাসপাতালগুলোকে অত্যাধুনিক করার কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সে হিসেবে জনবল কিন্তু বাড়ছে না। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে সাথে জনশক্তি বৃদ্ধির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

স্বাস্থ্য সেবা অর্থায়ন কৌশলপত্র (২০১২-২০৩২) বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন বৃদ্ধি ও তার অধিকতর সুষম ব্যবহারের একটি রূপরেখা। কৌশলপত্রটি ২০১১-২০১৬ মেয়াদি স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচির (এইচটিএনএসডিপি) লক্ষ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য কর্মসূচির সার্বজনীন নীতিমালা এবং জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১-র সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই কৌশলপত্রটি আরও বৃহৎ পরিসরে দ্রুত বাস্তবায়নের পথে আমাদের এগুতে হবে। স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণকালে সেবা গ্রহীতার আর্থিক সুরক্ষায় এই কৌশলপত্রটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

যেভাবে সারাদেশে একটি সুন্দর ব্যবস্থাপনার মধ্যে করোনা টিকা কর্মসূচি চলছে, স্বাস্থ্যখাতকে এভাবে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। প্রতিটি পর্যায়ে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। বৃহৎ পরিসরে এবং সঠিক পরিকল্পনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে একটি মডেল হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ রয়েছে। করোনার টিকা ব্যবস্থাপনার মতোই সুন্দর ও সুশৃঙ্খল হোক পুরো স্বাস্থ্যসেবা খাত।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর