১৯৭১ থেকে ২০২১; উন্নয়নশীল দেশ হলো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ
৬ মার্চ ২০২১ ২২:০৩
প্রতি বছর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে লিখি। ভাষণের গুরুত্ব, এর ব্যাপ্তি, ৭ মার্চের ভাষণই যে মূলত আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার শুরু সে বিষয়ে লিখি। এবার একটু ভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে চাই। স্বাধীনতা লাভের ৫০তম বছরে এসে বাংলাদেশ বিশ্বের অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পাকাপোক্তভাবে উন্নীত হয়েছে। এটি একটা অসামান্য অর্জন, অবিশ্বাস্য অগ্রগতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে এতদিন বাংলাদেশ অনুন্নত রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত ছিল। যদিও আমরা বলছি আমাদের উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে প্রায় ৫০ বছর লেগেছে, আসলে বিষয়টি তা নয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল এই ২১ বছর এবং ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই ৭ বছর, মোট ২৮ বছর বাংলাদেশ জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া, এবং সেনা শাসনের কাল যুগে নিমজ্জিত ছিল। এই ২৮ বছরে উন্নতি সাধন করা তো দূরে থাক, বাংলাদেশ যে পরাধীনতা থেকে মুক্ত ছিল—এটাই বরঞ্চ আমাদের ভাগ্য বলতে হবে। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন ২৮ বছরকে যদি আমরা হিসেব থেকে বাদ দেই, তবে বলা যায়— মূলত স্বাধীনতা লাভের ২২ বছরের মধ্যে আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি।
বাংলাদেশকে পরাধীন রাষ্ট্র থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন করতে বঙ্গবন্ধু এই যাত্রা শুরু করেন মূলত ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে দিয়ে। বঙ্গবন্ধু সেদিনের সেই আগুন ঝরা বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে’। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক কোনো ক্ষমতার মসনদে বসার অভিপ্রায় থেকে ছিল না, ছিল বাংলাদেশের মানুষের অধিকার রক্ষার ডাক, তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জীবন বাজি রাখার শপথ।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পর দীর্ঘদিন আমরা কালো ও অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি সময় পার করলেও ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে দ্রুত কাজ করতে থাকেন এবং তার আপসহীন নেতৃত্বের ফসল হিসেবে আমরা আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি। বঙ্গবন্ধুকন্যা তার পরবর্তী পদক্ষেপও ঠিক করে রেখেছেন। তিনি চান ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এবং আমরা জানি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য যা ভালো তাই চান, এবং সেই লক্ষ্যে তিনি বরাবরই অবিচল থাকেন।
তবে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার এই যাত্রাটা খুব সহজ ছিল না। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে তিনটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পর পর দুইবার অর্জন করতে হয়েছে আমাদের। এটিই জাতিসংঘের শর্ত যে, একটি রাষ্ট্র যদি অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসতে চায়, তবে তাদের তিন বছরের ব্যবধানে দুইবার তিনটি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। লক্ষ্যগুলো হচ্ছে, মাথাপিছু আয় ন্যূনতম ১২৩০ ডলার হতে হবে, মানবসম্পদ সূচক অন্ততপক্ষে ৬৬ পয়েন্ট বা তার বেশি হতে হবে, এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক ৩২ পয়েন্টের নিচে থাকতে হবে।
বাংলাদেশ প্রথমবার ২০১৮ সালে এবং দ্বিতীয়বার ২০২১ সালে তিনটি লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করেছে। ২০২১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো জাতিসংঘের যাচাইয়ে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় নির্ধারিত হয়েছে ১৮২৭ ডলার (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২৩০ ডলার), মানবসম্পদ সূচক দাঁড়িয়েছে ৭৫.৩ পয়েন্ট (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ন্যূনতম ৬৬ পয়েন্ট), এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচক দাঁড়িয়েছে ২৫.২ পয়েন্টে (লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ পয়েন্টের নিচে)।
সুতরাং পর পর দুইবার তিনটি লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করায় জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ ঘোষণার চূড়ান্ত সুপারিশ দেয়। সেপ্টেম্বর ২০২১ এ চূড়ান্তভাবে এ ঘোষণাটি দেওয়া হবে যা স্বাধীনতার ৫০তম বছরে আমাদের এক অনন্য অর্জন, এক অবিশ্বাস্য বিজয়। যা কিনা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উল্লিখিত লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়নের ফসল।
আমি মনে করি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এই অর্জন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এ নিয়ে তেমন কোনো লেখালেখি চোখে পড়ছে না সুশীল সমাজে। আমার কাছে মনে হয় জিয়াউর রহমান, সেনাবাহিনী ও খালেদা জিয়ার ২৮ বছরের দুঃশাসনে ফলশ্রুতিতে পরনিন্দা, পরচর্চা, সমালোচনা ও ছিদ্রান্বেষণের এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছি আমরা যে, এখন নিজের দেশের সাফল্যেও আমরা উদ্বেলিত হতে পারি না। আমরা অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে হয়তো পরিণত হয়েছি, কিন্তু আমাদের মরে যাওয়া আত্মার পুনরুত্থান কিভাবে ঘটবে তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই ভালো বলতে পারবেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, দুর্নীতি হয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে মন্দের প্রতি যে মোহ, ভালোর প্রতি ততোটাই অন্ধত্বের প্রভাব দেখতে পাই। তাই আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়ত শেষ হয়েছে, কিন্তু জাতি হিসেবে আত্মোন্নয়নের, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রামটা বোধহয় আরও বেশ কিছুদিন ধরে চালিয়ে যেতে হবে। সেই সংগ্রামেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের উজ্জীবিত করবে, সাহস জোগাবে ঠিক এইভাবে–
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
লেখক: সোশ্যাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ডক্টরাল রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো