বিশ্বসেরা রাজনৈতিক ভাষণ
৮ মার্চ ২০২১ ০৯:০৯
পৃথিবীর ইতিহাসে কালজয়ী বেশ কিছু ভাষণের কথা আমরা জানি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে সেগুলোর কোনোটিরই তুলনা চলে না। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল একইসঙ্গে ধ্রুপদী, কাব্যিক, উদ্দীপক এবং তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘকালব্যাপী প্রভাব সৃষ্টিকারী। ধ্রুপদী এ কারণে যে এই ভাষণে অনেক কিছু না বলেও তিনি বলেছেন। যেমন, স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক তিনি এই ভাষণে সরাসরি দেননি, কিন্তু যখন বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখন মূলত বলার আর কিছু বাকিও রাখেননি। এ ছাড়া যখন তিনি বলেন, ’প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’, এরপর আর যুদ্ধপ্রস্তুতির নির্দেশের কী-ই বা বাকি থাকে! আর তাইতো কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ‘৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ এই ভাষণকে কাব্যিক বলার কারণ, তাঁর সেদিনের ভাষণ যেকোনো আবৃত্তিশিল্পীর আবৃত্তিকেও হার মানায়। তাই তো নিউজউইক পত্রিকা লিখতে পারে, ‘৭ই মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা।’ আর বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ যে উদ্দীপক তা কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার আছে বলে মনে করি না। কারণ যারাই তাঁর এ ভাষণ শুনেছেন, তাদের মধ্যে যদি সামান্য দেশপ্রেম থাকে, তবে যতবার শুনবেন ততবারই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার কথা। দীর্ঘকালব্যাপী প্রভাব সৃষ্টিকারী বলা হলো এই জন্য যে ৭ই মার্চের ভাষণ উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের যেমন উদ্দীপিত করেছে, তেমনি নয় মাস স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উদ্দীপিত রেখেছে, এবং আজ এত বছর পরেও বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালিকে তা সমানভাবে উদ্দীপনা জুগিয়ে যাচ্ছে।
বিরুদ্ধবাদীদের অনেকেই বলে থাকেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেননি। আমার ধারণা, যারা এসব বলেন তারা শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার খাতিরেই বলেন, বিশ্বাস থেকে নয়। নয়তো তারা ভুলে যান সেদিনকার সার্বিক পরিস্থিতির কথা। একদিকে কঠিন মনোভাব প্রকাশের জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জনসভাকে কেন্দ্র করে ঢাকার রাজপথে কামান বসায়। প্রস্তুত রাখে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। অন্যদিকে রেসকোর্সে উপস্থিত দশ লাখ লোকই শুধু নয়, সারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে, কী ঘোষণা দেন তাদের মহান নেতা। তাদের আগামী দিনের জন্য কী নির্দেশনা দেন। এমন এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে ওঠেন এবং স্বাধীনতার প্রায় সব নির্দেশনাই দিয়ে দেন। তাইতো ভারতের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘উত্তাল জনস্রোতের মাঝে এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে। দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।’ এ ছাড়া ওই বিরুদ্ধ পরিবেশেও যখন মুক্তির সংগ্রামের কথা বলা হয়, স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা বলা হয়, তখন কারও বুঝতে বাকি থাকে না, এই সংগ্রামের পরিণতি মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ পর্যালোচনার আগে সেদিন কোন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তিনি এই ভাষণ দিয়েছিলেন তা কিছুটা পর্যালোচনার দাবি রাখে। ১৯৭০-এর ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে। সর্বমোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করার মাধ্যমে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাত্র ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের হাতে তখন পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাকিস্তানি সামরিক চক্র সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তাস্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১ মার্চ আকস্মিক এক বেতার ঘোষণায় ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সেদিন এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে বাংলাদেশ।
এই পরিস্থিতির মধ্যে বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। তার আগে ৪ মার্চ থেকে ৬ মার্চ সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানান তিনি। পুরো জাতি তার এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। আজ যে যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, অমুক নেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, অমুকে বাঁশি বাজিয়েছিলেন বলা হোক না কেন; সবাই জানে সেদিন বঙ্গবন্ধুই ছিলেন এদেশবাসীর একমাত্র নেতা। সেদিন তার নির্দেশে সরকারের সব সিদ্ধান্ত এবং আদেশ তারা অবলীলায় উপেক্ষা করত।
এবারে আসা যাক বঙ্গবন্ধু সেদিন কী বলেছিলেন সেই পর্যালোচনায়। মঞ্চে উঠে প্রথমে তিনি সংক্ষেপে আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ এখানে বাংলাদেশের মানুষের শোষণ-বঞ্চনা এবং রক্তদানের কথা উল্লেখ করে মূলত বিশ্ববাসীর কাছেও বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা উপস্থাপন করা হয়। এরপর বাঙালির অধিকারের কথা বলা হয়, বলা হয় তাদের মুক্তির কথা। কারণ দেশের মানুষ কী চায় তা বঙ্গবন্ধুর মতো আর কেউ জানতেন না, অনুধাবন করতেন না। আর এই মুক্তি মানেই তো স্বাধীনতা। এরপরই তিনি বলেন, ‘কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’
তিনি আসন্ন আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে অল্প কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে বাঙালি জাতির প্রতি পাকিস্তানিদের সমস্ত অনিয়ম-অত্যাচারের কাহিনি স্পষ্ট করে তোলেন। তিনি বলেন, ‘১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে ১০ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেনÑআমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমি বললাম ঠিক আছে, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসব। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব, এমনকি আমি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম। আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করব। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেওয়া হবে। যদি কেউ অ্যাসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।’
এই অংশটুকুর বর্ণনার মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করে দেন যে এরপরে একটি জাতির আন্দোলন করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এরপরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য। আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী-নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা বাঙ্গালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’
রেসকোর্সে উপস্থিত ১০ লক্ষাধিক নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসব? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।’
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখ অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছে, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।’
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ উচ্চ বা নিচু নিনাদে, কোনোটি বজ্রকণ্ঠে এমনভাবে ঘোষণা হতে থাকে যে কোনো আবৃত্তিশিল্পী কঠোর অনুশীলনেও এমন নিখুঁতভাবে বক্তব্যটি দিতে পারবেন না। এটি সম্ভব হয়েছে শুধু তাঁর স্বতঃপ্রবৃত্ততার কারণে, হৃদয়ের গভীর থেকে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের কারণে।
এরপর তিনি আন্দোলন প্রসঙ্গে অত্যন্ত কঠোরভাবে বলেন, ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।’
যেহেতু বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণমানুষের নেতা, তাই তার চিন্তা থেকে দেশের প্রতিটি মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা বাদ যায় না। তিনি ঘোষণা করেন, ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়াগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না।’ মূলত বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার মাধ্যমে ওই দিন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর শাসন কায়েম হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’
বঙ্গবন্ধু জানতেন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতেই হবে। তাই তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের আদেশ দেন সেদিন। এ ছাড়া পাকিস্তানিরা যে বাঙালির ওপর সামরিক আক্রমণ চালাবে, দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু তা খুব সহজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। এমনকি তিনি এটাও আঁচ করতে পারেন যে তাঁকে হয় হত্যা করা হবে, নয় বন্দি করা হবে। তাই তিনি বলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়; তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’ এ কথার মাধ্যমে তিনি মূলত গেরিলা যুদ্ধের নির্দেশনাই দিয়েছিলেন। তাঁর এই ঘোষণাই পুরো জাতিকে বলে দেয়, আগামীতে তাদের কী করণীয়। তারা বুঝে ফেলে মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন এবং সে পরিস্থিতিতে তাদের কী করতে হবে। এবং পরবর্তীতে সে অনুযায়ীই তারা চলতে থাকে। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ’তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’
এরপর তিনি সরাসরি আদেশ দেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না।’ এ সময় তিনি সবাইকে সাবধান করে দেন এই বলে, ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙ্গালী-ননবাঙ্গালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ এই ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনাই বলে দেয় কতটা দূরদর্শী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যেকোনো পরিস্থিতি তিনি আগাম আঁচ করতে পারতেন। বাঙালির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও তিনি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে কী করতে হবে সে সম্পর্কে তিনি ঘোষণা করেন, ’যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙ্গালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন।’ এই ’বুঝেশুনে কাজ করবেন’ শব্দগুলোর মাধ্যমে তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কী করতে হবে তা সবার উপরে ছেড়ে দিলেও এরপরের বাক্যেই এটাকে স্পষ্ট করে দেন, ’প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ মূলত এর পরে স্বাধীনতা যুদ্ধের নির্দেশের আর কিছু বাকি থাকে না।
সবশেষে তিনি এই বলে বক্তব্য শেষ করেন, ’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু কেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ১৮ই জানুয়ারি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং আঘাত হানা ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত থাকুক।’
ইতিহাস প্রমাণ করে ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে সঠিক কাজটিই করেছেন। এটি করলে তাকে দেশদ্রোহী বলে বিচারের মুখোমুখি করা পাকিস্তানিদের জন্য সহজ হতো। আর সেটি করলে বিশ্বজনমত সেদিন বাঙালির পক্ষে না গিয়ে বরং পাকিস্তানের পক্ষেই যেত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্বনেতৃবৃন্দ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যমও একটি যুগান্তকারী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বলেছেন, ’শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থ। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে।’
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন মানব জাতির পদপ্রদর্শক। তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয় সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে।’
পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, ’৭ই মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতা-পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা।’
যুগোস্লাভিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বলেছেন, ’৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনো রকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।’
দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল দলিল।’
গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরূক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’
এডওয়ার্ড হিথের এ বক্তব্য সত্য প্রমাণিত হয় যখন ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করে। বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করা হয়। তাই সত্যি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এখন আর আমাদের একক সম্পত্তি নয়, এটি এখন সারা বিশ্বের সম্পত্তি। সব দিক পর্যালোচনা করে এ কথা বলাও সম্ভবত বাহুল্য হবে না যে, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভাষণটি বিশ্বসেরা রাজনৈতিক ভাষণ।
লেখক : সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক
সারাবাংলা/এএম