ভবিষ্যতের টেলিভিশন ও রাই সম্মেলন
৬ এপ্রিল ২০১৮ ১৭:৩৬
চশমা আমি প্রায়ই হারাই। তবে এই ঘটনা দেশে কখনো ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। বিদেশ যাওয়া আসার সময় ট্যাক্সিতে বা প্লেনের মাঝে এই ঘটনা ঘটে। পকেট থেকে পড়ে যায় বা কোথায় যে রাখি মনে থাকে না। সবকিছু ঠিকঠাক জায়গায় আছে কিনা, সেটা দেখতে গিয়ে চশমার ব্যাপারে অসতর্ক হয়ে যাই। এ কারনে ট্যাক্সি বা প্লেন থেকে নামার পর চশমাটা আর খুঁজে পাইনা। খুব অসুবিধার মধ্যে পড়তাম আগে, এরপর আমার ব্যাকপ্যাকে আরেকটি চশমা রিজার্ভ রাখার ব্যবস্থা করেছি।
এবারও রোম থেকে ইস্তানবুল হয়ে ঢাকা আসার পথে এ ঘটনা ঘটেছে। রোমের হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট যাচ্ছিলাম হোটেলের ট্যাক্সিতে। কোনো টেনশন ছিল না। এয়ারলাইন্সের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে টিকিট বের করতে গিয়ে আর চশমাটা খুঁজে পাই না। নিশ্চয়ই ট্যাক্সিতে ফেলে এসেছি। কাউকে কিছু বুঝতে দেবার আগে ব্যাকপ্যাক থেকে রিজার্ভ চশমা বের করে চোখে দেই। সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান হয়।
গত ১৮ মার্চ ঢাকা থেকে রোম গিয়েছিলাম রাই এর (RAI) প্রধান কার্যালয়ে দুদিনব্যাপি এক কনফারেন্সে যোগ দিতে। ২০ ও ২১ মার্চ RAI (Radiotelevision Italia) ও ABU (Asia-Pacific Broadcasting Union) ছিলো এ কনফারেন্সের মূল উদ্যাক্তা। বিষয়বস্তু ছিল- Innovation Meets Culture, Digital Media and Cultural Heritage অর্থাৎ সংস্কৃতি, ডিজিটাল মিডিয়া এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উদ্ভাবন বিষয়ে।
সম্মেলনে ভবিষ্যতের টেলিভিশন প্রযুক্তি কিভাবে বিশ্বের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করা হয়। ইতালি পুলিশের একজন জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা সম্মেলনে আমাদের জানান তার পুলিশ বিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধীন নয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের অধীন। ইতালি পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পাশাপাশি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের অধীনে একটি আলাদা পুলিশ বাহিনী আছে। এই পুলিশ বিভাগ সমগ্র ইতালির ঐতিহাসিক স্থাপনা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে। তারা এখন শুধু ইতালি নয় ইরাকসহ কিছু দেশের পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করছে কিভাবে তাদের ঐতিহ্য ও স্থাপনাকে রক্ষা করতে হবে।
বিষয়টি আমার কাছে ছিলো নতুন এক অভিজ্ঞতা। রোমের রাস্তায় রাস্তায় রোমান সম্রাজ্যের ঐতিহ্য রক্ষায় অবস্থান করছে পুলিশবাহিনী। কোথাও কোথাও হাল্কা ট্যাংক নিয়েও অবস্থান করছে। ড্রোন দিয়ে খুঁজে দেখা হয় কোথাও কোনো নাশকতার পরিকল্পনা হচ্ছে কিনা। জিজ্ঞাসা করেছিলাম এ দায়িত্ব কি ট্রাডিশনাল পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে করানো সম্ভব নয়? উত্তর ছিলো ‘কখনো সম্ভব নয়। কারন দু বাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পূর্ন দুরকমের।’
পৃথিবীর সব দেশে বিভিন্ন পেশায় যারা দায়িত্ব যারা পালন করেন তারা সবাই পেশাদার। নিজ নিজ পেশার উপর তাদের প্রচুর প্রশিক্ষণ নিতে হয়, পড়াশুনা করতে হয়, পরীক্ষা দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম আছে বাংলাদেশে। এখানে টেলিভিশন কারা চালান তা আমরা কমবেশি জানি। এ বিষয়ে অনেক কিছু বলা যায়, কিন্তু এখন প্রসঙ্গ ভিন্ন।
রোমে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখেছি। সেগুলি রক্ষা ও সংরক্ষনের জন্য যা করা হচ্ছে, তার কিছু কিছু প্রক্রিয়া আমাদের দেখানো হয়েছে। খৃষ্টপূর্ব ২৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে রোমান সম্রাজ্যের আধিপত্য ছিলো। প্রথম রাজধানী রোম থেকে সর্বশেষ রাজধানী কলস্টাটিনোপল বা ইস্তানবুল পর্যন্ত যার নিদর্শন রয়েছে। এসব নিদর্শন দেখে একজন সচেতন মানুষ শুধু অবাকই হবেন না, কিভাবে তা সম্ভব হয়েছে তা ভাবতে বসে যাবেন।
ইতালির বাইরে রোমান সম্রাজ্যের নিদর্শনগুলোর অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু ইতালি তাদের রোমান ঐতিহ্য ও স্থাপনাকে কিভাবে সংরক্ষন করছে তা না দেখলে বোঝা যাবেনা।
যাই হোক মূল প্রসঙ্গে আসি। ওই সম্মেলনেই ভবিষ্যতের টেলিভিশন কেমন হবে এ নিয়ে সম্মেলনে বক্তব্য উপস্থাপন করেন এনএইচকে (জাপান টেলিভিশন করপোরেশন) গবেষনা ইনস্টিটিউটের একজন জেষ্ঠ্য প্রকৌশলী। এনএইচকে সেই টেলিভিশন আবিস্কারের পর থেকেই টিভি প্রযুক্তির উন্নয়নে প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে।
মনে আছে ১৯৮৮ সালে যখন পৃথিবীর অনেক দেশে টেলিভিশন চালু হয়নি, সে সময়ে এনএইচকের একজন প্রকৌশলী আমাদের সামনে হাই-ডেফিনিশন টেলিভিশনের প্রযুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন এআইবিডি, কুয়ালালামপুরের একটি কর্মশালায়। সেই সময় থেকেই এইচডি (HD) টিভির ধারনা পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে দেয় এনএইচকে।
টোকিওতে এনএইচকের কার্যালয়ে ১৯৯৩ সালে অতিথি প্রযোজক হিসেবে বেশকিছু দিন কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। এনএইচকে কমিউনিকেশন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (NHK-CTI) এ প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর এনএইচকের জন্য ইংরেজী ভাষায় অনুষ্ঠান প্রযোজনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এ সময়ে জাপানে এইচডি টেলিভিশন চালু হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্টেশন, পার্ক ইত্যাদি জায়গায় বিশাল আকারের এইচডি টিভি সেট বসানো হয়েছে। সে সময় এই সেট সাধারন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিলো। তখন লক্ষ্য ছিলো আগামী দশ বছরের মধ্যে তা দর্শকদের ঘরে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া।
এখন আর SD টিভি সেট উৎপাদন হয় না, ঘরে ঘরে HD টিভি। টেরিস্টিরিয়াল টেলিভিশন থেকে এসেছে স্যাটেলাইট টেলিভিশন। এখন অনেক কম খরচেই একটি টিভি চ্যানেলের মালিক বনে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। প্রশিক্ষণ ছাড়াই অদক্ষ জনবলে ভরে যাচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলো। অন্ধ অনুকরণ করছে এক চ্যানেল অন্য চ্যানেলকে। ব্যাবসায় মার খাচ্ছেন। বলা হচ্ছে যুগ পাল্টে যাচ্ছে। এখন সব ঝুঁকছে ইন্টারনেটভিত্তিক টিভির দিকে। আইপিটিভি, অনলাইন টিভি, মোবাইল ফোন ইত্যাদি ডিভাইসে। আমার মাঝেও এরকম একটা ধারণা তৈরী হয়েছিলো। কিন্তু রোম কনফারেন্স আমার সে ধারণা ভুল প্রমাণ করলো। ওইসব ডিভাইস টেলিভিশনের বিকল্প কখনো হতে পারবেনা, তবে টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে।
এইচডি টিভি যা এখন চালু আছে তা মূলত টুকে (2K) টেলিভিশন। এখন উন্নত বিশ্বে চালু হয়েছে 4K টেলিভিশন। যাকে আলট্রা এইচডি বলা হয়। যার রেজ্যুলুশন ৩,৮৪০x২,১৬০ পিক্সেল, যেখানে এইচডি টিভির আছে ১৯২০ x ১০৮০ পিক্সেল। এনএইচকে প্রকৌশলী আমাদের দেখালেন কিভাবে তারা এখন 8K টেলিভিশন চালু করেছেন। 8K সবচেয়ে বেশি আলট্রা এইচডি টেলিভিশন যার রেজ্যুলেশন ৭৬৮০×৪৩২০ পিক্সেল। রোমে রাই এর প্রধান কার্যালয়ে এনএইচকের সৌজন্যে এই টিভির সম্প্রচার দেখলাম। দেখলাম আর ভাবলাম কিভাবে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে!
আমার জিজ্ঞাসা ছিলো এরপর কি? এনএইচকে নিশ্চয়ই আগামী দশ বছরের মধ্যে আমাদের ক্রয়সীমার মধ্যে নিয়ে আসবে 8K টিভি, তারপর কি 16K? প্রকৌশলী ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন, তার আর প্রয়োজন নেই। কারন 2D (টু ডাইমেনশন) টিভি বা চলচ্চিত্রের জন্য 8K এর বেশী আর মানুষ ধারন করতে পারবে না। তাহলে? এনএইচকে সে কথা মাথায় রেখে আবিষ্কার করে ফেলেছে 3D (থ্রি ডাইমেনশন) টিভি। যা দেখার জন্য কোনো চশমা বা গ্লাসের প্রয়োজন নেই। অবাক কান্ড। এনএইচকের সৌজন্যে রাই কার্যালয়ে আমরা দেখলাম 3D টিভির অসাধারন সম্প্রচার।
প্রযুক্তিতো এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তির স্বাদ শুধু টিভি সেটেই পাওয়া যাবে। সব উন্নতপ্রযুক্তি এক সময় মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমার মধ্যে চলে আসে। কিন্তু কনটেন্টের আকাল সবকালেই ছিলো, সৃজনশীল মানুষদের তাই আলাদা মূল্যায়ন ছিলো। কিন্তু এখন? সৃজনশীল মানুষদের খুঁজে পাওয়া যায়না। সবকিছুর মধ্যে বানিজ্য ঢুকে পরেছে। সৃজনশীলতা না থাকলে বাণিজ্য যে সম্ভব নয়, তা কি আমরা বুঝতে পারছি? তাই সবার আগে সৃজনশীল মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। তা না হলে যত উন্নত প্রযুক্তিই আসুক না কেনো তার অপব্যবহার হবে। আমরা দর্শক হারাবো।
লেখক: টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব