সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষবাষ্প
৪ মে ২০২২ ১৮:৪৩
একজন যুবক তার সোশ্যাল মিডিয়ায় (ফেসবুক) একটা পোস্ট করলো, কোন একজন সেটিকে বিকৃত করে বা উপস্থাপন করে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে জানালো, তারা রাগে, বিক্ষোভে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষের বাড়ি ঘর আগুনে পুড়িয়ে দিলো, মালামাল লুট করে নিলো, তাদের জীবনে এক ধরণের ভীতিকর ও নিরাপত্তাহীনতার এক বিরাট নজির স্থাপন করা হলো।এখানেই ঘটনার শেষ নয়! পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামলাতে অতিরিক্ত ফোর্স বা সদস্যদের মোতায়েন করলো। নিরাপত্তা ও মামলার কারণে অভিযুক্তকে আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হলো। অভিযোগ হচ্ছে, তিনি কোন বিশেষ ধর্মের অনুভূতি নিয়ে ফেসবুকে কটুক্তিপূর্ণ কিছু পোস্ট করেছেন। তার প্রদত্ত এই কটুক্তি অন্য ধর্মের প্রতি অবমাননার! সরকার পক্ষ বা ভিন্ন গোষ্ঠী কর্তৃক ধারা অনুযায়ী মামলা করা হলো। এদিকে অভিযুক্তের পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অভিযুক্তের অভিযোগ প্রমাণে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে প্রকাশ পেলো, অভিযুক্ত কথিত সোশ্যাল মিডিয়ার একাউন্টধারী ব্যক্তিটি সেটি ব্যবহারে পারদর্শী নয়, এবং তার একাউন্টটি হ্যাক (অবৈধভাবে দখল নিয়ে)করে বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য জনৈক অন্য একজন ব্যক্তি এই হীন কাজটি করেছে।
এদিকে ভুক্তভোগীর পরিবার সুবিচার ও অভিযুক্তের জামিন পাওয়ার আশায় আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলেন। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এতোদিনে সবাই জেনে গেছে যে পুরো ঘটনাটি একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পূর্বপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত কাজের অংশ। কিন্তু তবুও অদৃশ্য কারণে অভিযুক্তের মুক্তি মিলছে না! এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটনাটির বহুল প্রচার হওয়া স্বত্ত্বেও ঘটনাটির সাথে প্রকৃত দোষীরা ধরা ছোয়ার বাইরে! অন্যদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রকৃত দোষীদের না পেয়ে অজ্ঞাত অসংখ্য মানুষের নামে একটি মামলা রজু করেছেন। কদিন পর ফেসবুকে দেওয়া ভুয়া স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে বিভৎসতার কাহিনীর সত্যিকার ঘটনা নানা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতে লাগলো। মানুষের বিবেক নেড়ে উঠলো। বিবেকবান মানুষেরা জানলো এটা কোন প্রকৃত ধার্মিকের কাজ নয়। এটা ধর্মান্ধদের ঘৃণ্য অপকর্মের নীল নকশা! জেগে উঠলো দল-মত নির্বিশেষ নানা শ্রেণী, ধর্ম ও বর্ণের প্রগতিশীল ও মানবিক মানুষ। অভিযুক্তের মুক্তির দাবীতে সরব হয়ে উঠলো সোশ্যাল মিডিয়া ও রাজপথ।
অবশেষে অভিযুক্তের পরিবারকে সহায়তার কিছু উদ্যোগ দেয়া হলো। কিন্তু ততদিনেও আইনী প্রক্রিয়ায় কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই!একদিন মানুষ ভুলে গেলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছোট্ট স্ট্যাটাসের কারণে দেশের একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে নেমে এসেছিলো অমানিষার কালো অন্ধকার!তারা কখনো কল্পনাও করেনি যে, পূর্ব পুরুষের পৈত্রিক ভিটায় আর নিজের দেশে থেকেও তাদের জীবনে এমন একটা বিপন্নতার মুখোমুখি হবে। অভিযুক্ত বিনা অপরাধে জেলের প্রকোষ্ঠে দিন কাটাচ্ছে। অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে তার পরিবার জীবনের চরম বাস্তবতার মুখোমুখি! স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে অযাচিত অস্বাভাবিক জটিলতা। যার খবর এক সময় কেউ রাখে না। কেউ কেউ আবার এ সকল অবস্থা থেকে পরিত্রাণের আশায় বাংলার মানুষের অনন্য ভরসাস্থল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুতি জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বা গণমাধ্যমে লেখেন বিভূতির স্তুতিমিশ্রিত খোলাচিঠি! কারণ জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এখন দৃশ্যমান-অদৃশ্যমানভাবে বঞ্চিত মানুষের আশ্রয়ের একমাত্র শেষ ঠিকানা!এ দেশে বর্তমানে একমাত্র তাঁর উদ্যোগ বা হস্তক্ষেপেই ঘটনার পট পরিবর্তন হয়, সুষ্ঠু বিচারের সুবাতাস বয়।
ঘটনাটি কোন বিশেষ একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে না হলেও, ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়াকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার প্রেক্ষাপটগুলো প্রায় একই রকম! সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটার পর সেগুলো নিয়ে শুরু হয় একধরণের প্রপাগান্ডা। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বদলে তৈরি হয় এক ধরনের অরাজকতা ও অস্থিতিশীল অবস্থা! কেউ ঘটনার বিভৎসতাকে বাড়িয়ে বা কমিয়ে প্রকাশেরও অপচেষ্টা করে, আবার কেউ প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে, ঘটনার নেপথ্যের কারণকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন। সব মিলিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার কারণে কিছুদিন পর পর ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। আর এদিকে ধর্মান্ধগোষ্ঠী কিছুদিন নিরব থেকে আরেকটি নতুন ঘটনার সূত্রপাত ঘটানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মান্ধগোষ্ঠীর দেয়া আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়িয়ে দেবার মাধ্যমে তারা তাদের ধর্মকে কতটা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন, সেটা আমার জানা নেই। এতে সর্বশক্তিমান বা পরম করুণাময় কতখানি প্রীত হলেন সেটাও জানার কোন সুযোগ নেই। আশা করি, এই বিষয়গুলো ধর্মান্ধদের প্রকৃত বিবেচনাবোধে নেই। থাকলে হয়তো বিবেকের তাড়নায় নিজেরাই দংশিত হতো! তবে এর মধ্য দিয়ে যে মনুষ্যত্বের পঁচন ও মানবতার অবক্ষয় সবচেয়ে বেশি ঘটছে, সেটি নিশ্চিত। আর এর মধ্য দিয়ে কোন প্রকারের কল্যাণ নিহিত নেই, সেটা সাধারণ মানুষ বুঝলেও, ধর্মান্ধরা বুঝেও মানতে চায় না বরং ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতাকে নানাভাবে উসকে দেবার জন্য উগ্রবাদী গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরণের অপতৎপরতায় লিপ্ত।
সাধারণ মানুষের জীবনের কষ্ট, দুঃখ, বঞ্চনা, নির্যাতন, সংঘাত, সহিংসতার ঘটনাগুলো মনে হয় যেকোন মানবিক মানুষকেই সত্যি খুব কাঁদায়। জানি না মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি ভালোবাসার এই দৈন্যতার অবসান কবে হবে? আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি; দেখিনি পরদেশী শাসকদের লেলিয়ে দেওয়া সৈন্যদের পৈশাচিকতা; লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া অমানুষিক নির্যাতনের দৃশ্য দেখিনি, দেখিনি এদেশের মা-বোনদের উপর তাদের পাশবিক ধর্ষণের ঘটনা; কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে সাম্প্রতিককালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলোকে দেখে শুনে মনে হয়; স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা স্বাধীনতার চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আমরা সামষ্টিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করতে পারিনি! মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য কিংবা স্বার্থসিদ্ধির বিকৃত করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণের গৃহিত উদ্যোগগুলো নানাভাবে ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হয়েছে।
ফলশ্রুতিতে মহান স্বাধীনতার মত একটি অর্থবহ ঐক্যবদ্ধ সামষ্টিক চেতনাও অনেকক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ! আমরা কি পেরেছি দল-মত নির্বিশেষে এই মহান স্বাধীনতার চেতনাকে সমাজের সকল স্তরে প্রসারিত করতে? এখানেও রয়েছে বিভেদ, ভিন্নমত ও দর্শনের আধিপত্য!
মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি যে মানবিকতা ও মূল্যবোধের পরিচয় দেওয়ার কথা! সেটা কে আমরা সমুন্নত রাখতে পারছিনা। ফলে সমাজ ব্যবস্থায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার বদলে প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষবাষ্প বিকশিত হচ্ছে, যা পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত। সম্প্রীতির শিক্ষা অবহেলিত থেকে যাচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। বিনিময়ে সামগ্রিকভাবে ও সামাজিকভাবে পারস্পারিক যে মানবিক বন্ধন থাকার কথা সেটিও অধরা থেকে যাচ্ছে। বৃহত্তর মানবিক কল্যাণ ও প্রগতিশীল সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থে সেটি পুনরুদ্ধারের বিকল্প নেই। আর এজন্য সামগ্রিকভাবে মুক্ত চিন্তা চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি ও ধর্মান্ধতাকে সামাজিকভাবে ঘৃণা করা উচিত। কারণ সাম্প্রদায়িক চেতনা মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও সম্প্রীতির চর্চাকে সংকুচিত করে তোলে।
লেখক: জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি