বিএনপি: মুখে শেখ ফরিদ বগলে ভোটের ইট
৪ জুলাই ২০২২ ১২:২৪
নির্বাচন প্রশ্নে ‘মুখে শেখ ফরিদ বলে বগলে ইট’ নিয়ে ঘুরছে বিএনপি। নিচ্ছে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা কর্মসুচি। মাঠে-ঘাটে বলছে, এ সরকার এবং এ কমিশনের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। সরকারের পতন ঘটিয়েই নিশ্চিত করবে সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু, এগুলো নিতান্তই কথার কথা। বলার জন্যই বলা। ভেতরের খবর অন্য রকম। অন্তরালে পুরোদমে চলছে বিএনপির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি। তাদের গত মাস কয়েকের প্রতিটি পদক্ষেপ এবং তৎপরতা নির্বাচনকে টার্গেট করেই।
ভোটে যাবে না আওয়াজের মাঝে জোট মেরামত ও আওতা বাড়ানো নিয়েও দৌড়ঝাঁপ করছে বিএনপি। জামায়াতযুক্ত ২০ দলীয় জোট বহাল রেখে তারা ছোট ছোট দলের সাথে বৈঠক করছে। ঢাকার বিভিন্ন চিপাচাপায় এসব দলের অফিসে চলে যাচ্ছেন মহাসচিবসহ দলটির নেতারা। জামায়াতের বিপরীত দর্শনের বাম ঘরানার গণসংহতি আন্দোলন ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে বিএনপির নেতাদের ছুটে যাওয়া সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। কিছুটা বিস্ময়েরও কারো কারো কাছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একে ইস্যুভিত্তিক বললেও মূখ্য উদ্দেশ্য নির্বাচন। এই ধাঁচের ডান গোপন রেখে বাম সংযুক্তির রিহার্সাল গত নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনকে ফ্রন্টে রেখে ২০১৮ সালেও করেছে বিএনপি। সামনের দিনগুলোতে জোনায়েদ সাকি, সাইফুল হক, রেজা কিবরিয়া, নুরুল হক নূরদের নিয়ে আবারো হওয়ার মতো বিস্তর আলামত স্পষ্ট।
বিএনপির এতো তৎপরতার ফল কী হবে?- তা এখনো ভবিষ্যতের ওপর নির্ভর। তবে, এসব তৎপরতা নির্বাচন করার জন্য, না ঠেকানোর জন্য- সেই প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জামায়াতকে সঙ্গী করে গড়ে তোলা আন্দোলনে সাফল্য মেলেনি। নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। রুখতে পারেনি ১৫৪ জনের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়া সরকারকেও। বাধ্য হয়ে গোলেমাল ভরা ২০১৮-সালের নির্বাচনে আসতে হয়েছে। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের নিয়ে ওই নির্বাচনে এসে বাড়তি লোকসান গুনতে হয়েছে বিএনপিকে। এবারের টার্গেট নির্বাচন ঠেকানো, না অংশ নেয়া?-এ প্রশ্নটি তাই ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপির মিত্র বা হিতাকাঙ্খীদের কাছেও। তবে, শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনেও বিএনপি আসবে বলে অনেকটা নিশ্চিত সরকার। ডান, বাম ও মধ্যপন্থীদের নিয়ে বিএনপির জোটগত নতুন আমেজ তৈরির উদ্দেশ্য বলে বিশ্বাস সরকারের।
বিএনপির ভেতরের প্রস্তুতিও তাই বলছে। দলটি চায় ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব দল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক ছিল সেগুলোর পাশাপাশি সমমনা অন্যান্য দল ও বামদলগুলোকে কাছে টেনে সরকারকে কাবু করতে। বিএনপি কৌশলে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্বের নাটকীয়তা করলেও ২০ দলীয় জোট অটুট রাখতে চায়। সেইসঙ্গে সঙ্গী করতে চায় বাম-আধা বামদেরও। এর পেছনে সিগনাল দিয়ে রেখেছেন লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই প্রক্রিয়ার কুশীলবদের ধারনা ২০০১ সালের আগে চারদলীয় জোট করে যেভাবে আন্দোলনে রাজপথ দখলে রেখে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিতেছে, সামনেও সে ধরনের কিছু ঘটানো। বাস্তবে তা ফলবে কিনা?-এ প্রশ্ন থাকলেও এগুচ্ছে নানামুখী সংকটে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। সংকট উত্তরণের চেষ্টা তারা করেনি-এমনও নয়। সেই চেষ্টার কিছু করেছে পর্দার বাইরে, কিছু পর্দার অন্তরালে। সদর-অন্দর, মুখ-অন্তর বিস্তর ব্যবধান বা গোলমাল থাকায় সাফল্য পায়নি।
দলের নেতৃত্ব সংকট ও সাংগঠনিক দুর্বলতা, জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রেখে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়া, জোটগত শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা, ক্ষমতাবান বৈশ্বিক শক্তির সমর্থন আদায় প্রশ্নেও মার খেয়েছে। এসব বিবেচনায় আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ই তাদের প্রধান দাবি। এই দাবি সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে যোগ দেয়নি এবং প্রধান কমিশনার ও কমিশনার পদে নাম প্রস্তাবে সার্চ কমিটির আহ্বানেও সাড়া দেয়নি। এই নির্বাচন কমিশনকেও মেনে নেয়নি। তাদের কোনো সংলাপেও যাচ্ছে না। সোজাসাপ্টা বলছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো নির্বাচনেই যাবে না। জনরোষের মুখে এ সরকার পালানোর পথ পাবে না বলেও হুঙ্কারও দিচ্ছে। মুখে এসব আওয়াজ দিলেও ভেতরে-ভেতরে নিচ্ছে নির্বাচনের প্রস্তুতি।
তাদের এই প্রস্তুতির একটি বিশেষ অংশ হচ্ছে বিদেশি সহায়তা আদায় করা। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বৈশ্বিক শক্তির প্রভাবের আবশ্যকতা বোধ করছে দলটি। বিগত নির্বাচনগুলোতে নানা জালিয়াতি-কারসাজির মধ্যেও বিদেশি প্রভাবশালী শক্তিগুলো আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল বলে মূল্যায়ণ বিএনপির। বিষয়টি মাথায় নিয়ে অনেকদিন ধরে ক্ষমতাবান বিদেশিদের গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও আইনের শাসনের বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের সহযোগিতা প্রার্থনা করে আসছে বিএনপির দেশি-বিদেশি লবি।
বিএনপির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ‘গুম’ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলেও অভিযোগ করছে সরকার। ইস্যুটিতে কিছুটা ‘তৃপ্তির ঢেকুর’ রয়েছে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে। এই তৃপ্তি ও জোসের মধ্যে সামনের নির্বাচনী মাঠে ভালো ফল ঘরে তোলার আশা তাদের। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। এখন থেকেই তাদের মাঠ গরম করা ও রাখার মূল উদ্দেশ্য নির্বাচন। আন্দোলনের মাঠ যার দখলে, ভোটের ফলও তার ঘরে- দীর্ঘদিনের প্রচলিত এই তত্ত্ব সামনে রেখে নির্বাচনী ফল-ফসল ঘরে তোলার ছকও আঁকছে বিএনপি। বাকিটা নির্ভর করছে তাদের কর্মপরিকল্পনা ও অপেক্ষার ওপর।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি