বিএনপিকে যেসব প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে
১৯ জুলাই ২০২২ ১৭:৪১
ওয়ান ইলেভেন, শক্তিদল, কিংস পার্টি, সুশীল রাজনীতি, নাগরিক ঐক্য হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ঘিরে রাজনীতি আবারও আওয়ামী লীগ-বিএনপিতেই থাকলো। অর্থাৎ ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ জ্ঞানী-গুনীদের হাতে স্বল্প সময় ঘুরে রাজনীতি যথারীতি আওয়ামী লীগ-বিএনপির কোর্টেই অবস্থান করছে। গণতন্ত্র, উন্নয়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এসব নিয়ে দুই দলের বিতর্ক নিয়ে জনগণের নির্লিপ্ততা আপাতভাবে সরকারি দলের পক্ষেই যাচ্ছে। অন্যদিকে বিরোধীপক্ষের দুর্বল রাজনীতি তৃতীয় মেয়াদের শেষেও সরকারি দলকে নিশ্চিন্তে রেখেছে।
এবার মুক্তবাজার বাস্তবতায় মোটাদাগে দেশের কথা তথা আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতির কথায় আসি। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক দলের জনপ্রিয়তা নিয়ে গলা যত উঁচুই করুন না কেন, দীর্ঘ ক্ষমতায় থাকার কারণে এন্টি গভর্মেন্ট জনমত অবশ্যই একটি ফ্যাক্ট। তবে সরকারবিরোধী এই জনমতকে পুঁজি করে বিএনপি আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে ক্ষমতার মসনদে পৌঁছাবে তেমন কোনো রাজনীতি, রাজনৈতিক ন্যারেশন বা কমিটমেন্ট এখনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা থেকে শুরু করে করোনা মোকাবিলা, মহামারির বৈশ্বিক স্থবিরতায় অর্থনীতি সচল রাখার মতো ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে শেখ হাসিনার সরকার বৈশ্বিক মাপকাঠিতেই সফলতা দেখিয়েছে। তবে মহামারি পরবর্তী রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের দরুণ বৈশ্বিক মন্দা, জ্বালানীসহ নিত্যপণ্য মুল্যের উর্ধ্বগতি এখন সরকারের পক্ষে জনমত পক্ষে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যেও আশার কথা পদ্মাসেতু চালু হয়ে যাওয়াসহ আগামী এক বছরে আরও কয়েকটি মেগা-প্রকল্পের সমাপ্তি মন্দা পরিস্থিতির মধ্যেও অর্থনীতিতে কিছুটা গতি সঞ্চার করবে সন্দেহ নেই। তবে যুদ্ধ শেষ হবার কোনো লক্ষণ না থাকা, উপরন্তু রাশিয়ার ওপর আমেরিকা-ইউরোপের সেংশনে জ্বালানীর মূল্য যেভাবে বাড়ছে, তাতে বিশেষজ্ঞদের মতে পুরো উন্নয়নশীলসহ বিশ্বের জন্যই সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্য মুল্যের উর্ধ্বগতি জনমতের সরকার বিরুপতার ফল বিএনপি কতটা কাজে লাগাতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়। যেখানে রাজনীতিতে ‘থার্ড ফোর্স’ আসার আশংকা-সম্ভাবনা (!) সুশীল- সামরিক দুই দিক থেকেই যেখানে নিঃশেষিত! বৈশ্বিক-জাতীয় নতুন এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির রাজনৈতিক ন্যারেশন একটু খোঁজার চেষ্টা করি। দলটি প্রধান বিরোধী পক্ষ হয়েও এখনও প্রো-একটিভ। অর্থাৎ সরকারের কার্যক্রম আর সরকারি দলের রাজনৈতিক কৌশলের পিছুপিছুই ছুটছে। এখন পর্যন্ত বিএনপির কার্যক্রম সরকারি দলকে মোকাবিলার চিন্তা করতে হয়নি বরং বিএনপিই নিত্যদিন প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মধ্যেই তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রেখেছে।
আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদের শেষ দিকে এসেও বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে মানুষ তথা জনগনের কাছে কতটা দায়বদ্ধ? এখন পর্যন্ত বিএনপি জনগনের সামনে দৃঢ়ভাবে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচী হাজির করতে পারেনি। অনেকে বলবেন, ‘কেন আছে না– এই সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচন নয়’। নির্দলীয়– নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ফিরে যাওয়ার দাবি। কেন্দ্রীয়ভাবে এমন একটি ঘোষণা বিএনপির আছে বটে। তবে কার্যক্ষেত্রে বিএনপির তৃণমূল থেকে খোদ কেন্দ্রীয় নেতারাও এই ঘোষণা মানছেন না। দল থেকে আপাত পদত্যাগ করে ইউনিয়ন, পৌরসভা থেকে সিটি নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন, নিচ্ছেন। তাহলে বিএনপি নেতারা কি নিজেরাই মনে করছেন ঘোষনা-কর্মসূচী (আদতে বিচ্ছিন্ন কিছু কর্মসুচী ছাড়া ধারাবাহিক কিছু লক্ষ্যযোগ্য নয়) বাস্তবসম্মত নয়। তাহলে তো ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বিএনপিকে ঘোষণা-কর্মসূচীর ক্ষেত্রে আরো প্রাথমিক স্তরে নেমে জনমত গড়ে তোলার মত নানা কর্মসূচীতে যেতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ দিকে এসেও জ্বালানি বা নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়েও বিএনপির ধারাবাহিক কোন কর্মসূচী জনগনের কাছে পৌঁছায়নি। এ ক্ষেত্রেও ‘ঈদের আগে-পরের’ মতো কিছু কর্মসূচী বিচ্ছিন্নভাবে অবশ্য দলটি পালন করেছে। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার দরুন সরকারি দলের বিপক্ষে যাওয়া জনমতের প্রতি এই হচ্ছে বিরোধীদের কমিটমেন্ট।
এবার আসি যে কোনো আন্দোলনের সফলতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের প্রসঙ্গে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির নেতাদের তেমন কোনো কথা নেই। অবশ্য বাংলাদেশের উভয় দলের নেতাদেরই সে সুযোগ সীমিত। সমস্যা হচ্ছে এ প্রসঙ্গে বিরোধী পক্ষের থিঙ্ক ট্যাংক, বুদ্ধিজীবী বা টকারদেরও কোনো কথা নেই। অথচ এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নানাপর্যায়ে বিভিন্নভাবে বহুদিন থেকেই চ্যালেঞ্জ জানানো হচ্ছে।
এ নিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায়ও সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন- ‘বিএনপির নেতৃত্ব কই? শেখ হাসিনার বিপরীতে কে হবে বিএনপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী?’ বিএনপির নেতৃত্বের দুজনই দণ্ডিত। তার মধ্যে বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্ব আবার বিদেশে সেচ্ছানির্বাসিত। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের যে দেশে ফিরতে বাধা নেই তাও স্পষ্ট করেন প্রধানমন্ত্রী। হ্যাঁ, দণ্ডপ্রাপ্ত যখন দেশে ফিরলে জেলে যেতে হবে। শ্লেষের সুরেই আওয়ামী লীগ সভাপতি জানান, রাজনীতি করলে তো জেলে যেতেই হয়।
এখানেই বিএনপি নেতৃত্বকে জনগনের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। আওয়ামী লীগের শাসন নিয়ে বিএনপির যে সমালোচনা, সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা নিয়ে তাদের যে দাবি- তা যদি তারা নিজেরা বিশ্বাস করে, তবে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সমস্যা কোথায়? রাজনীতিতে এটুকু ঝুঁকি না নেওয়া আসলে– নিজেদের ঘোষণা-কর্মসূচী নিয়ে দোদুল্যমানতা, জনগনের প্রতি আস্থা না রাখার পরিচায়ক। ক্ষমতার রাজনীতিতে ফিরতে হলে বিএনপিকে অবশ্যই নিজেদের ঘোষণা-কর্মসুচী দৃঢ়তার সাথে জনগনের সাথে উপস্থাপনই শুধু নয়, দেশে ফিরেই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে সরকারি দলের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
বিএনপিকে যেসব প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে মত-দ্বিমত রোকন-উজ-জামান