Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রতিবাদ করা কি অন্যায়?

সজীব ওয়াফি
৮ অক্টোবর ২০২২ ১৯:২৬

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোন অন্যায় কিংবা কোন অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে নাগরিকেরা প্রতিবাদ জানাবেন, বিক্ষোভ করবেন, এমনকি জনসমাবেশও করবেন। এগুলো স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিবাদটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও হতে পারে; আবার বাইরেও হতে পারে। নানা পক্ষের আলোচনা সমালোচনা আমলে নিয়ে কতৃপক্ষ সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছবেন এই তো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তিন বছর আগে ফেনী নদীর পানি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি হয়েছিলো। অসম এই চুক্তির বিরোধীতা করে ফেসবুকে দু’লাইন লিখেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। পরিণামে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে তাকে লাশ হতে হয়েছিলো। ন্যায্য বিচার পেতে এবং ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন কতৃক সাধারণ ছাত্র নির্যাতনের রাজনীতি বন্ধ করতে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে পুরো দেশ। আবরারের সেই মৃত্যু বার্ষিকীর স্মরণে ৭ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যে স্মরণসভা পালন করছিলো ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কমীরা। অযৌক্তিকভাবে সেই স্মরণসভায় ছাত্রলীগ হামলা করেছে। হামলা বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা তীর ছোড়াছুড়ি হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতৃত্বদের একটা বক্তব্য স্পষ্ট হয়েছে যে বহিরাগতরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছিলো, তারা কেবল প্রতিহত করেছে। তবে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদসভা বা স্মরণসভা করা অন্যায়!

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের সম্পত্তি, সর্বজন বিদীত জায়গা। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছে। বাৎসরিক সব খরচ মেটাতে তাকিয়ে থাকতে হয় শিক্ষা বাজেটের ওপর। একদিকে এখানে যেমন গবেষণা হয়, অন্যদিকে সংস্কৃতি রক্ষার ধারক-বাহকও। আবার প্রতিবাদ-প্রতিরোধেরও তীর্থস্থান। বেশি দূরে নয়, একটু ষাটের দশকে ঘুরে তাকালেই দেখা যাবে সমস্ত আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করলে ঢাকার সাথে সাথে সেখানকার শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হয়। মোটাদাগে বললে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পথে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্ব ঊনসত্তরের গনঅভ্যুত্থানের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে এগিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ সারাদেশে মানুষ জাতীয় মুক্তির অন্যতম উপাদান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভরশীল। ছাত্ররা যখন কোন বিষয়ে আন্দোলন করে তখন সাধারণ মানুষও সেখানে সশরীরে অংশগ্রহণ করেন, সংহতি জানান এবং সমর্থন করেন।

বিজ্ঞাপন

বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেননি। শিবির আখ্যায়িত করে সাধারণ শিক্ষার্থী আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন যে ভুল করেছিলো সেটা গণভবনে আবরারের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী দেওয়া সান্ত্বনা বাণীতেই পরিস্কার। তিন বছরের মাথায় স্মরণসভায় হামলা করে ছাত্রলীগ নিজেদের আবার তলানিতে ঠেকিয়েছে। বিনা উস্কানিতে ছাত্রলীগের হামলা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। লাঠিসোঁটা, লোহার পাইপ নিয়ে হামলে পরেছে, সভার চেয়ার ভাঙ্গচুর করেছে। অনেকেই রক্তাক্ত হয়েছেন; পাশে থাকা সামান্য রিকশাওয়ালাও রক্ষা পায়নি। আহত নেতৃত্ব ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও দ্বিতীয় দফা হামলার শিকার হন। অতঃপর আমরা দেখলাম পুলিশ আহত নেতৃত্বদেরই গ্রেফতার করলো। সমীকরণ দাঁড়ালো ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা মার খেয়ে আহত হয়ে চিকিৎসার ন্যায্যতাও পাবে না, পুলিশ আবার তাদের গ্রেফতার করে রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বিতীয় অন্যায় করলো। ছাত্রলীগ কতৃক তাৎক্ষণিক মামলা দায়ের করে সে মামলায় আদালতে সোপর্দ করা হলো। দিনদুপুরে পুরোপুরি অন্যায়ভাবে অন্যায্যতার গোলকধাঁধা। এই যদি রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি হয় তবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এ কোন ইনসাফের বাংলাদেশ কায়েম হয়েছে! মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের এ কেমন নমুনা!

যুক্তিতর্কের স্বার্থে ধরে নিলাম আবরার ফহাদের স্মরণসভার আয়োজন করে ছাত্র অধিকার পরিষদ অন্যায় করেছে। কারণ সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়েন না এমন অনেক শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি এরকম কোন আইন থাকে যে সাধারণ মানুষের প্রবেশ এখানে নিষিদ্ধ। তাহলে ঠিক আছে, যারা এ ধরনের দাবি করবে যে জনসাধারণ এখানে প্রবেশ করতে পারবে না, তবে তাদেরও জেনে রাখা দরকার যে জনগণও আগামীকাল থেকে তাদের ট্যাক্সের এক পয়সাও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ সকল নেতিবাচক চিন্তা চেতনার শিক্ষার্থীদের পিছনে দিবে না। এতোই যখন বড় কথা, তো ঐ সকল শিক্ষার্থীরা নিজেদের টাকায় পড়াশোনা করে আসুক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কিসের দরকার? সর্বোপরি স্মরণসভাকারী ছাত্ররা অযৌক্তিক অথবা রাষ্ট্র বিরোধী কিছু করে থাকলে সেটার জন্য দেশে আইন আছে, আদালত আছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী আছে। দেশে যদি নিরাপত্তা বাহিনী থাকবে, তবে হামলাকারীদের হামলা করার দায়িত্ব কে দিলো? মানুষ মেরে ধরে আইন হাতে তুলে নেওয়ার এখতিয়ার পেল কিভাবে? সুতরাং সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন যা করেছে সেটা অন্যায়।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ঘরানার ছাত্রদের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশসহ এমন কোন জায়গায় নেই যেখানে ছাত্রলীগ হামলা করে নাই। তবে কি এদেশে থেকে গণতন্ত্রের সামান্যতম ছিটেফোঁটাও উঠে গেল! নাগরিকদের প্রতিবাদ করা অন্যায়? নাকি সরকার এবং তার সংগঠনগুলো ভয় পেয়ে নিজেরাই নিজেদের রাস্তা বন্ধ করতে চাইছে! নানা নামে, নানা কূটকৌশলে এই ধরনের অন্যায় সংঘটিত হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত। ছাত্রলীগের ধারাবাহিক এই অন্যায় কার্যক্রম সরকারের সমস্ত অর্জনের ভরাডুবি ঘটাতে যথেষ্ট। অপ্রত্যাশিত ঘটনা এড়াতে সরকারি দল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টি আরোপ করলে ভাল হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিবাদের সমাবেশ মিছিল কখনোই অন্যায় নয়। বরং যারা এর বিপরীতে দাঁড়াবে জনগণের অভ্যুত্থানে তারা ভেসে যাবে আজ অথবা আগামীকাল। গণতন্ত্রের জয় হোক।

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

প্রতিবাদ করা কি অন্যায়? মত-দ্বিমত সজীব ওয়াফি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর