ভালোবাসায় স্মরণ করছি নারী প্রগতির পথিকৃতকে
৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১৫:৪৯
”অতএব জাগো, জাগো গো ভগিনিগণ”- ধর্মীয় আর সামাজিক কুসংস্কার ও কূপমণ্ডকতার বলি বাঙালি নারীর ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিশ শতকের গোড়ায় দাঁড়িয়ে এই উদাত্ত আহবান জানিয়ে যিনি আজীবন নারীমুক্তির সংগ্রামে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন তিনিই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। আজ ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবসে এই মহীয়সী নারীর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
বেগম রোকেয়া রংপুরের পায়রাবন্দের ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার সঠিক জন্মতারিখ সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে। রোকেয়া নিজের লেখা ‘অবরোধবাসিনী’তে উল্লেখ করেছেন যে বড় বোন করিমুন্নেসার দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল হালিম গজনভির বয়স যখন ছয়, তার বয়স তখন পাঁচ। জানা যায় আব্দুল হালিম গজনভির জন্মতারিখ ১৮৭৬ সালের ১১ নভেম্বর। সে হিসেবে বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৭৭ সালের শেষ দিকে অথবা ১৮৭৮ সালের প্রথম দিকে হওয়ার কথা (সূত্র: রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া – গোলাম মুরশিদ)। তবে অধিকাংশ গবেষকই রোকেয়ার জন্মতারিখ ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার পিতার নাম জহীরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলি সাবের, মাতার নাম রাহেতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরাণী।সাবের পরিবারের ছেলেদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থাকলেও মেয়েদের আরবি-ফারসি ছাড়া বাংলা বা ইংরেজি পড়ার কোন সুযোগ ছিল না। এই পরিবারের মৌখিক ভাষাও ছিল উর্দু। রোকেয়ার বড় দুই ভাই কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। রোকেয়ার বড় বোন মেধাবী করিমুন্নেসা দুই ভাইয়ের কাছ থেকে বাংলা শেখেন সম্পূর্ণ নিজের আগ্রহে। একদিকে বড় বোন করিমুন্নেসার বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা অন্য দিকে বড় দুই ভাইয়ের পাশ্চাত্য শিক্ষার উদার মানসিকতা শিশু রোকেয়ার মানসবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে ধারণা করা যায়।
বেগম রোকেয়ার শৈশব-কৈশোর কেটেছে আচারসর্বস্ব, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অনাচার ও জড়তাক্লিষ্ট মুসলিম নারী সমাজের অত্যাচার, অনাচার, অশিক্ষা আর উৎপীড়নের মধ্য দিয়ে। কঠোর পর্দাপ্রথার অন্তরালে শৈশবে রোকেয়াকে শুধু আরবি আর ফারসি ভাষা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু নিজ অন্তর্প্রেরণায় বড় দুই ভাইয়ের কাছ থেকে গোপনে ইংরেজি শিক্ষার পাঠ নেন এবং বড় বোন করিমুন্নেসার কাছ থেকে শিখে নেন বাংলা ভাষা। রোকেয়ার শৈশবেই করিমুন্নেসা বিধবা হয়ে শশুরবাড়ি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের জমিদার বাড়ি ছেড়ে পায়রাবন্দে ফিরে আসেন। করিমুন্নেসা তার দুই পুত্রের সঙ্গে ছোটবোন রোকেয়াকে মানুষ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ‘মতিচূরে’র উৎসর্গপত্রে করিমুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে রোকেয়া লিখেছেন-“আমার বিবাহের পর তুমিই আশঙ্কা করিয়াছিলে যে আমি বাঙ্গালা ভাষা একেবারে ভুলিয়া যাইব। চৌদ্দ বছর ভাগলপুরে থাকিয়া, বঙ্গভাষায় কথাবার্তা কহিবার একটি লোক না পাইয়াও যে বঙ্গভাষা ভুলি নাই, তাহা কেবল তোমারই আশীর্ব্বাদে।” পারিবারিক ভাষা উর্দু হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষার প্রতি রোকেয়ার ছিল অসীম ভালোবাসা। জানা যায় ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন, সে যুগের প্রেক্ষিতে যা ছিল দু:সাহসিক একটি কাজ।
১৮৯৫ মতান্তরে ১৮৯৬ সালে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় দ্বিগুণেরও বেশি বয়সী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। নারী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বেগম রোকেয়ার এমন অসম বিয়ে আপাতদৃষ্টিতে দুর্ভাগ্যজনক মনে হলেও বলা যায় এই বিয়ে তার জন্য শাপে বর হয়েছিল। বিয়ের পর তিনি পিতার পরিবারের অন্ধকার অবরোধের সঙ্কীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে মুক্ত উদার পরিবেশের সান্নিধ্য পেলেন। ভাগলপুরের উর্দুভাষী পরিবারে প্রগতিশীল, আধুনিক এবং নারী শিক্ষায় উৎসাহী স্বামীর সহচর্য রোকেয়ার জীবনকে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে আলোকিত করে তুললো।সাখাওয়াত হোসেন কৃষিবিদ্যা শেখার জন্য ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ধারণা করা যেতে পারে ইংল্যান্ডের নারীদের ভোটাধিকার, উচ্চশিক্ষার অধিকার, স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সম্পর্কিত আন্দোলন দ্বারা সাখাওয়াত হোসেন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং বিয়ের পর সেই অনুপ্রেরণা রোকেয়ার মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন, যেহেতু রোকেয়া নিজেও এসব বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। সাখাওয়াত হোসেন রোকেয়ার পড়ালেখার প্রতি অকুণ্ঠ আগ্রহ দেখে তাকে উৎসাহিত করেন এবং সব রকমের সহযোগিতা প্রদান করেন। শৈশবে বড় ভাইদের কাছ থেকে রপ্ত করা ইংরেজি ভাষাটা উচ্চ শিক্ষিত স্বামীর সাহচর্যে এসে আরো বেশি শাণিত হয়ে উঠে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও রোকেয়ার ইংরেজি জ্ঞান কতটা সমৃদ্ধ ছিল তার প্রমাণ রয়েছে ‘Sultana’s Dream’ নামের বই এবং তার লেখা চিঠিপত্রসমূহে। সাখাওয়াত হোসেন নিজে বাংলা না জানলেও রোকেয়াকে বাংলায় লিখতে এবং পত্রিকায় প্রকাশের জন্যও উৎসাহিত করেন।
সাহিত্যচর্চা, সংগঠন পরিচালনা এবং নারীশিক্ষা বিস্তার- এই ত্রিমাত্রিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বেগম রোকেয়া সমাজসংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামের একটি গদ্য রচনার মধ্য দিয়ে রোকেয়ার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটে। ১৯০৫ সালে ‘Sultana’s Dream’ যার বাংলা অনুবাদ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লেখার মধ্য দিয়ে ভারত উপমহাদেশে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। বলা যেতে পারে বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে ধ্রুপদী নারীবাদী কল্পকাহিনির একটি অনন্য দৃষ্টান্ত ‘সুলতানার স্বপ্ন’। রোকেয়া যে সময় এই বইটি লিখেছিলেন, সেই সময়ের ধর্মীয় এবং সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এটিকে সাহসী ও বিপ্লবী প্রয়াস হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। বইটিতে সুলতানার স্বপ্নজগতের কল্পকাহিনিতে এমন একটি নারীস্থানের কথা বলা হয়েছে যেখানে পুরুষদেরকে অন্ত:পুরে বন্দী করে রেখে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে নারীরা। সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা রান্না থেকে যুদ্ধ জয় সবই করেছে। বিশ শতকের শুরুতে রোকেয়া যখন এ কথা বলেছিলেন তখন তা অবাস্তব মনে হলেও একুশ শতকে এসে আমরা দেখছি সৌরশক্তির অপার সম্ভাবনার নানাবিধ প্রয়োগ। সময় ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রোকেয়া যে অনেক বেশি প্রাগ্রসরমান ছিলেন ‘সুলতানার স্বপ্নে’ আমরা তার প্রমাণ পাই। শুধু শারীরিক শক্তির কারণে পুরুষ নারীর উপর প্রভাব বিস্তার করবে এটা রোকেয়া মেনে নিতে পারেননি। সুলতানার প্রশ্নের উত্তরে ভগিনি সারা জানিয়েছে – “কেবল শারীরিক বল বেশী হইলেই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করি না।সিংহ কি বলে বিক্রমে মানবাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহে। তাই বলিয়া কি কেশরী মানবজাতির উপর প্রভুত্ব করিবে? “
বেগম রোকেয়ার লেখা মতিচূর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী প্রতিটি সাহিত্যকর্মের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কুফল, নারীশিক্ষার পক্ষে তার নিজস্ব মতামত। নারীর প্রতি সামাজিক অবমাননা, লিঙ্গসমতা এবং নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে অগ্রসর চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটেছে তার প্রতিটি লেখায়। বাল্যবিবাহ এবং বহু বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও তার লেখনি সোচ্চার ছিল। হাস্যরস আর ব্যঙ্গবিদ্রূপের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজে নারীপুরুষের অসম অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন। তীব্র ব্যঙ্গ আর ধারালো বিদ্রূপের মাধ্যমে বাঙালি চরিত্রকেও তিনি বিশ্লেষণ করেছেন-“যদি ভারতবর্ষকে ইংরাজি ধরনের অট্টালিকা মনে করেন, তবে বঙ্গদেশ তাহার বৈঠকখানা এবং বাঙ্গালী তাহার সাজসজ্জা ! যদি ভারতবর্ষকে একটা সরোবর মনে করেন, তবে বাঙ্গালী তাহাতে পদ্মিনী! যদি ভারতবর্ষকে একটা উপন্যাস মনে করেন,তবে বাঙ্গালী তাহার নায়িকা! ভারতের পুরুষ সমাজে বাঙালী পুরুষিকা! ” বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রোকেয়া সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা, কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থা, কুটির শিল্প, রেশম চাষ প্রভৃতি বিষয়েও সুচিন্তিত মত ব্যক্ত করেছেন তার লেখা অনেক প্রবন্ধে।
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিলে অধিকার’ বলে বেগম রোকেয়া বিধাতার পায়ে মাথা ঠুকে অভিযোগ বা অনুযোগ জানাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন পুরুষশাসিত সমাজে নারীর দুরবস্থা এবং দৈহিক ও মানসিক জড়ত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষা। এ দৃঢ় বিশ্বাস থেকে তিনি লিখেছেন -“কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জ্জন করুক।” যুগসন্ধিক্ষণের এক কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় উপমহাদেশের নারী-জীবনে মুক্তির আলো জ্বালানোর ব্রত গ্রহণ করেছিলেন তিনি। অকাল বৈধব্য, জন্মের চার এবং পাঁচ মাসের মধ্যে দুটি কন্যাসন্তানের মৃত্যু, স্বামীর প্রথম পক্ষের কন্যা এবং কন্যাজামাতা কর্তৃক বঞ্চনার শিকার হওয়া- ব্যক্তিগত জীবনের এতসব বিপর্যস্ততা তাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল নারীশিক্ষার প্রসার, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি এবং অবরোধ প্রথার অবসান। রোকেয়া নারীদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন মানুষ হিসেবে। সময় ও পারিপার্শ্বিকতার সীমবদ্ধতার মধ্যে অবস্থান করেও রোকেয়ার চিন্তাধারণা কতটা আধুনিক ছিল তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় নারীসমাজের শৃঙ্খলিত হওয়ার ইতিহাস সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা থেকে।তিনি লিখেছেন-“আদিম সমাজের ইতিহাস কেহই জানে না বটে ; তবু মনে হয় যে পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজে বন্ধন ছিল না,তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না।” তিনি মনে করেছেন সমাজ এবং পরিবারই নারীকে দাসীতে পরিণত করেছে এবং নারীও সেই দাসত্বকে মেনে নিয়েছে। তাই দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই নারীর মানসিক দাসত্বের মুক্তি ঘটেনি-নারী পুরুষের সহচরী, সহকর্মী এবং সহধর্মিণী না হয়ে হয়ে উঠেছে দাসী। আর নারীদের অতি প্রিয় অলঙ্কারগুলোকেও তিনি দাসত্বের নিদর্শন হিসেবে গণ্য করেছেন। সব রকমের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার আবশ্যকতার কথা নারীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন বারবার-“পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব।”
সমাজের অবহেলিত এবং ভাগ্যবিড়ম্বিত নারীসমাজের উন্নয়নের জন্য রোকেয়ার ভাবনা ছিল কৈশোর থেকেই। বিয়ের পর স্বামীর অনুপ্রেরণায় নারীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে। স্বামীর মৃত্যুর পর রোকেয়া নারীশিক্ষা বিস্তার এবং সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন পুরোপুরিভাবে। রোকেয়া মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন নারীর উন্নতি এবং মুক্তির অন্যতম শর্ত হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত নারীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯০৯ সালে ভাগলপুরের বাড়িতে স্বামীর দেয়া অর্থে পাঁচ জন ছাত্রী নিয়ে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কিন্তু আত্মীয়স্বজনের চরম অসহযোগিতার কারণে ভাগলপুরে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়লে রোকেয়া কোলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন। ১৯১১ সালের ১১ মে কোলকাতায় নতুন করে আবার একটি বিদ্যালয় চালু করেন যেটির নাম দেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়।’ রোকেয়ার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পরবর্তীতে বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। শুধু শিক্ষাবিস্তারে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ না রেখে বেগম রোকেয়া নারীদের সচেতন ও সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে নারীসমিতি গঠন করেন। জানা যায় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সকল স্তরের নারীরা এই সমিতির সদস্য ছিলেন। এ সমিতির ইতিহাসের সঙ্গে রোকেয়ার সংগ্রামী কর্মজীবনের কাহিনি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এ সমিতি থেকে অনেক অসহায় বিধবা মহিলা অর্থ সাহায্য পেয়েছে, দরিদ্র মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে, অনেক মেয়েকে শিক্ষাসহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে, সমাজ পরিত্যাক্ত অনাথ শিশিকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। বলা যেতে পারে একজন যোগ্য শিক্ষকের প্রজ্ঞা, সমাজসংস্কারকের অন্তর্দৃষ্টি এবং মানবতাবাদীর নির্মল চেতনায় সমৃদ্ধ ছিলেন বেগম রোকেয়া। নারীশিক্ষা বিস্তার এবং নারী উন্নয়নে বেগম রোকেয়ার ভূমিকা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাগরের চেয়ে কোন অংশে কম নয়-এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে।
এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে বেগম রোকেয়া নারীমুক্তির যে দীপশিখা জ্বালিয়ে ছিলেন, সেই আলোর পথে আজ একুশ শতকে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে কারখানা, কৃষিক্ষেত্র পর্যন্ত নারীর অবাধ বিচরণ। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য যে নারীশিক্ষার আজ অনেক প্রসার ঘটেছে।কিন্তু বেগম রোকেয়ার কাঙ্ক্ষিত প্রকৃত মুক্তি নারীরা আজও অর্জন করতে পারেনি, একুশ শতকের সমাজ আজও বেগম রোকেয়ার ঔদার্য আর মুক্তবুদ্ধিচর্চার চেতনাকে ধারণ করতে পারেনি পুরোপুরিভাবে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেই কেবল বেগম রোকেয়ার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বিবিসির জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ষষ্ঠ নম্বরে থাকা ক্ষণজন্মা নারী বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কোলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। নারী শিক্ষা এবং নারী উন্নয়নে বেগম রোকেয়ার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্মদিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে রোকেয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং নারী উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালনকারী বিশিষ্ট নারীদেরকে বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।
আজ রোকেয়া দিবসে গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় স্মরণ করছি নারী প্রগতির পথিকৃৎ মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে।
তথ্যসূত্র :
1। বেগম রোকেয়া রচনাবলী
2। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং ইন্টারনেট
লেখক: অধ্যক্ষ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা
সারাবাংলা/এজেডএস