পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতন থাকতে হবে সবসময়
৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১৬:২৭
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তার সবকিছুই পরিবেশ। আর প্রকৃতি হচ্ছে পরিবেশের অন্যতম অনুসঙ্গী। এই প্রকৃতি আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হয়তো অনেকেই করোনা অতিমারীর পর কিছুটা অনেকখানিই বুঝতে পেরেছি আমরা। আমাদের এই প্রিয় পরিবেশকে রক্ষার জন্য চেষ্টা চলছে বহু বছর ধরে। তবে এখন অনেকেই এড়িয়ে চলেন সেই সচেতন বার্তা।
সাধারণত পরিবেশ দূষণ চার প্রকার বায়ুদূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ এবং শব্দ দূষণ। আমাদের চারপাশের পরিবেশের কোন উপাদানের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলেই দূষণের সূত্রপাত হয়। বস্তুত মানব সৃষ্ট বিভিন্ন কারণকেই পরিবেশ দূষণের কারণ হিসেবে চিহিৃত করা হয়। যার অন্যতম উপাদান সমূহ হচ্ছে শিল্পায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, নির্বিচারে বৃক্ষণিধন, কলকারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার, ইটভাটা হতে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলা, মলমূত্র ত্যাগ, হাসপাতালের বর্জ্য ফেলা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া প্রভৃতি।
বাতাসে অক্সিজেন ব্যতীত অন্যান্য গ্যাস ও ধূলিকণার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে বায়ু দূষিত হয়। পৃথিবীর সব প্রাণি শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। অপর দিকে বৃক্ষরাজি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ ও অক্সিজেন ত্যাগ করে। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নির্বিচারে সবুজ বৃক্ষ নিধন করার কারণে বৃক্ষ হ্রাস পাচ্ছে। এজন্য বৃক্ষরোপণ করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো সাধারণত জলাশয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে শহর, হাট-বাজার, বাসাবাড়ির ময়লা-আর্বজনা, বিভিন্ন প্রাণীর মলমূত্র, খাল, বিল ও নদীতে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে। প্রতিটি শিল্পকারখানার সঙ্গে শোধনাগার বা অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন বাধ্যতামূলক। এতে পানি ও বায়ু দুটোই দূষণ রোধ হবে। বাস-ট্রাক, রেলগাড়ি, লঞ্চ-স্টিমারের হাইড্রোলিক হর্নের শব্দ, বিমানের বিকট শব্দ, শিল্পকারখানার শব্দ, ইট-পাথর ভাঙার শব্দ, মাইকের শব্দ, পটকার শব্দ,
হাটবাজার, যানজট, জনসভায় মানুষের কোলাহলের শব্দ, ঢাক-ঢোলের শব্দ, ঝড়-তুফান, সাইক্লোন, বজ্রপাত ও সমুদ্রের গর্জন শব্দ দূষণের উন্নতম কারণ। শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস, মাথাব্যথা, হৃদরোগ, স্নায়ুবিক বৈকল্য, মানসিক বিপর্যয়, অনিদ্রা, বিরক্তিভাব, মনোযোগ নষ্ট ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, কৃষি বিপ্লব সৃষ্টি করছে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া। কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাস বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা অতিমাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। এতে আর্কটিক ও এন্টার্কটিকার বরফ গলে জনপদ, দেশ, অঞ্চল ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে, উপরন্তু খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঝড়, ঘূর্ণিবার্তা ভয়াবহ রূপে বেড়ে যাচ্ছে। পৃথিবী থেকে ৭৬ রকমের প্রাণী ও কয়েক হাজার গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৩২ রকমের স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৬ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত ও বিলুপ্তির পথে। সমতলভূমি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে, বায়ুতে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণে তাপ বৃদ্ধির ফলে শিগগিরই মেরু অঞ্চল ও পর্বতশ্রেণীর বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা ১ থেকে ২ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ দ্বীপ সমুদ্রের লোনা পানির নিচে ডুবে যাবে এবং কোটি কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে ও প্রকট খাদ্য সংকট দেখা দেবে।
আমাদের বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশ হয় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ বিসুখের কারণে। বায়ুদূষণে চোখ, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হয়, ক্যান্সার, হৃদরোগ, মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা তৈরি হয়। পানি দূষণের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে চর্মরোগ, টাইফয়েড জন্ডিস বা হেপাইটটিসের মতো রোগ ছড়াতে পারে। দূষণের ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যহত এবং স্নায়ুর ক্ষতি হয়, গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত বা মৃত শিশু প্রসবের সম্ভাবনা বেড়ে যায়, মাছের মাধ্যমে মানব শরীরে সীসা, প্লাস্টিক কণা ঢুকে যাচ্ছে, শব্দ দূষণে হাইপারটেনশন বৃদ্ধি, এমনকি বধির হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কিন্তু শুধু সমস্যা চিহিৃত করা এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানলেই হবে না, তা সমাধানে কার্যকরভাবে কাজ করতে হবে। দূষণ প্রতিকার শুধু সরকারের একার কাজ নয়, এর জন্য সরকারি, বেসরকারি সব সংগঠন, ব্যক্তি পর্যায়ে কাজ করতে হবে। মুজিববর্ষে ১ কোটি গাছের চারা রোপণ কর্মসূচি আমাদের উজ্জীবিত করেছে, কিন্তু এতেই শেষ নয়। আজ বনভূমি ১৭% এ এসে দাঁড়িয়েছে যদিও অনেকের মতে তা ৮ থেকে ১০ শতাংশ। এ অবস্থা থেকে ফিরে আসতে হবে, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ও সহযোগী ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস