শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশের প্রধান হুমকি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস
১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১১:১৫
জাতীয় সংসদের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠ সরগরম। একটি গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিতে এটি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এমন পরিস্থিতির মধ্যে যদি কোন শক্তি জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করে, সেটি শুধু অস্বাভাবিকই নয়, নিন্দনীয়, ঘৃণ্য এবং ধিক্কারজনকও বটে! নির্মম ও দু:খজনক হলেও সত্য যে এমন ঘটনা বাংলাদেশে অপরিচিত নয়। আর যারা রাজনীতির নামে এইসব জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড ঘটিয়ে থাকে তারাও এদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই পরিচিত। দিনে দিনে এই অপশক্তির সংখ্যা বাড়ছে না কমছে তা পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয়! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সমর্থক ও বেনিফিশিয়ারিগণ প্রায়শই এই ঘৃণিত কাজটি করে থাকে। গত ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ মিরপুর সেনানিবাসের ডিফেন্স সার্ভিস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজে (ডিএসসিএসসি) ২০২২ এর প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে গ্রাজুয়েশন সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবের সাথে সাথে অপরাধের ধরণ পরিবর্তিত হওয়ার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রথাগত ও অপ্রথাগত হুমকি মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রথাগত নিরাপত্তা হুমকির পাশাপাশি অপ্রথাগত নিরাপত্তা হুমকিসমূহ প্রতিহত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।’ কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘এখন নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক বদলে গেছে। ডিজিটাল ডিভাইস যেমন আমাদের অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। তেমনি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ কিংবা অন্যান্য অপরাধের ধারাটাও পাল্টে গেছে।’ বলা বাহুল্য, অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি বা হুমকির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ। নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকে নিরাপত্তা পরিবেশ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও, বড় সশস্ত্র সংঘাত এবং আন্ত:রাষ্ট্র যুদ্ধের ঝুঁকি এখন হ্রাস পাচ্ছে, বিশ্ব ক্রমবর্ধমানভাবে বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে যা অপ্রথাগত বা অপ্রচলিত। অপ্রচলিত বা অপ্রথাগত এইসব নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরমপন্থা, মানব ও মাদক পাচার, আন্তর্জাতিক অপরাধ, সাইবার নিরাপত্তা, মানুষের অনিয়মিত চলাচল প্রভৃতি অন্যতম। এছাড়া অপ্রথাগত নিরাপত্তার মধ্যে আরও অনেক কিছু। সব ধরনের অপ্রথাগত নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলায় বর্তমান সরকার প্রতিবেশী দেশের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে। কারণ প্রতিবেশী দেশের সাথে আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া এই নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলা করা কোনও একটি রাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ প্রভৃতি সহিংস চরমপন্থার রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং এসবের ভিত্তিতে রাজনৈতিক কর্ম-পন্থা নির্ধারণ করছে কোন কোন রাজনৈতিক দল? এই প্রশ্নের ইতিহাস-ভিত্তিক সঠিক উত্তর হচ্ছে জামায়াত-বিএনপি রাজনৈতিক গোষ্ঠী।
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল তার শাসনকে বেসামরিক করতে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের মে মাসে ‘হ্যা’ ‘না’ ভোট বা রেফারেন্ডাম/গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। রেফারেন্ডামে ভোটার উপস্থিতি ছিল ২ শতাংশের নীচে, কিন্তু ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয়েছিল শতকরা ৮৮ শতাংশ। ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি না থাকার কারণে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং এবং পোলিং অফিসারেরা জিয়ার পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেখানো এই প্রদত্ত ভোটের মধ্যে জিয়ার পক্ষে দেখানো হয়েছিল ৯৯.৮ শতাংশ ‘হ্যাঁ’। যা ছিল সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব ও অবাস্তব। বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট ভঙ্গ করে ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান অংশগ্রহণ করেছিলেন; পরবর্তীকালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে ১৯৯৪ সালের কলঙ্কিত মাগুরা-২ উপনির্বাচন অনুষ্ঠান করেছিলেন; বেগম জিয়া ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির ভোটারবির্হন নির্বাচন করেছিলেন; ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে সীমাহীন কারচুপি এবং সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যপক নিপীড়ন নির্যাতনের মাধ্যমে বিএনপি কর্তৃক জয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যা করেছে। অগ্নিসংযোগ করে জনগণের জানমাল ধ্বংস করেছে। ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব নির্বোধ কাজ জামায়াত-বিএনপি জোট করেছে। বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরের পর এমন নিষ্ঠুর কর্মকান্ড দেখেনি। বহির্বিশ্বের মানুষও কোনো রাজনৈতিক দলের এমন কর্মকান্ডের কথা শোনেনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপি-জামায়াত চক্র সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা শতাধিক গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তাদের পেট্রোল বোমা, হস্তনির্মিত বোমা এবং অন্যান্য ধরণের সহিংসতায় ২০ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহ প্রায় ২০০ জন নিহত হয়। তারা রাস্তার পাশের হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলেছে। তারা ছোট ছোট দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করেছে। বিএনপি-জামায়াতের গুন্ডারা মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জা ভাংচুর করে এবং পবিত্র কোরআনের শত শত কপি পুড়িয়ে দিয়েছিল। নির্বাচনের দিন তারা প্রিজাইডিং অফিসারসহ ২৬ জনকে হত্যা করেছিল এবং সারাদেশে ৫৮২টি স্কুলে আগুন দিয়েছিল। সকল বাধা অতিক্রম করে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে সহায়তা করেছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংলাপে বসার চেষ্টা করেছিল। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনা সংবিধানের অধীনে যে কোনো ক্ষেত্রে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন। নির্বাচন তদারকির জন্য সেসময়ের আওয়ামী লীগ সরকার সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য প্রস্তুত ছিল। সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বাংলাদেশের সংবিধানে অনির্বাচিত সরকারের কোনো বিধান নেই। সেসময় জনসাধারণের মনে একটা বিষয়ই ছিল আর তা হলো সংবিধানের অধীনে নির্বাচন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করায় জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্যতাই বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে দূরে রাখার প্রধান কারণ ছিল।
এমনকি ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে আবারও একই ধরনের নির্বোধ সহিংসতা করেছিল বিএনপি-জামায়াত। পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা করেছে। বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক পরিচালিত সহিংসতা তথা পেট্রোল বোমা ও অন্যান্য হামলায় ৫৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন ৫৫০ জনেরও বেশি। এসময় তারা ৪০০টিরও বেশি যানবাহন এবং ২৮টি প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়। ২৮টি নাশকতামূলক কাজের ঘটনা ঘটেছে রেলওয়েতে এবং ৬টি নৌপথে। ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপি-জামায়াতের হামলার শিকার ব্যক্তিবর্গ, নিহতদের স্বজন, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, সাংবাদিক এবং অন্যান্যদের উপস্থিতিতে একটি প্রদর্শণীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, ‘নিরীহ মানুষ হত্যা করে লাভ কি? দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে বিএনপি কী অর্জন করতে চায়? জনগণের জীবিকাকে পঙ্গু করে তারা কার কাছে প্রতিশোধ নিতে চায়?’ উল্লেখ্য, বিএনপির উত্থানের ইতিহাসের সঙ্গে দলটির অমানবিক কর্মকান্ডের যোগসূত্র রয়েছে। তাদের নেতা জিয়াউর রহমান ইউনিফর্মে রাজনীতি শুরু করেন। জিয়া কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছিলেন যিনি তার জীবন রক্ষা করেছিলেন। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর শত শত অফিসার ও সিপাহী, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করেন। বিএনপি নেত্রী তার প্রথম মেয়াদে সার দাবিতে ১৮ জন কৃষককে হত্যা করেছিলেন। তার ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াতের গুন্ডারা আওয়ামী লীগের ২৬০০০ কর্মী ও নেতাকে হত্যা করেছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯বার চেষ্টা করা হয়েছিল। মহান স্রষ্টার অশেষ কৃপায় তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন।
জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতার সোনালী সূর্য বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল। যুদ্ধের পর শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ হবে শান্তিপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক, এটাই ছিল এদেশের মানুষের একান্ত চাওয়া। কিন্তু সে চাওয়া প্রতি মূহুর্তেই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণত ধরে নেয়া হয় যে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা বুদ্ধিজীবীসহ নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করেছিল। কারণ ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের মূলহোতা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই যখন আত্মসমর্পণ করেছে তখন স্বাভাবিকভাবেই আশা করা গিয়েছিল যে ‘তাহলে শেষ পর্যন্ত শান্তি ও অসাম্প্রদায়িকতার সুবাতাস’ স্বাধীন বাংলাদেশে বইতে থাকবে! কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে বাংলার মানুষের সেই আশা বাস্তবায়িত হতে পরেনি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পনের পরেও স্বাধীন বাংলাদেশের কোন কোন জায়গায় এমনকি খোদ রাজধানী ঢাকায় ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানের এদেশীয় দোসরেরা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষের বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য বাঙালিদের হত্যা করেছে। পাকিস্তানী সেনাবহিনী সারেন্ডার করলেও তাদের এদেশীয় সমর্থকেরা তাদের জঙ্গিবাদী, সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড অব্যাহতভাবে চালিয়ে গিয়েছে এবং এখনও যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী আইনসম্মতভাবে বাংলাদেশে রাজনীতি করার অযোগ্য ও নিষিদ্ধ। কিন্তু তারা রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের রাজনীতি জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা নির্ভর। জামায়াতে ইসলামী নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। এমন প্রমাণ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পেয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট জঙ্গি সম্পৃক্ততার জন্য জামায়াত ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে। একই অভিযোগে গত ৯ নভেম্বর (২০২২ সালের)সিলেট থেকে শফিকুরের ছেলে রাফাত সাদিক সাইফুল্লাহকে বকে সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সাইফুল্লাহ জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার সিলেট অঞ্চলের সমন্বয়ক। এর আগে ১ নভেম্বর (২০২২ সালের)ঢাকার যাত্রবাড়ী থেকে এই জঙ্গি সংগঠনের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর সাইফুল্লাহর বিষয়ে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই শফিকুর রহমান ও তার ছেলে সাইফুল্লাহর সঙ্গে শারক্কীয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। ২০২১ সালের জুনে প্রথমবার সাইফুল্লাহর নেতৃত্বে সিলেট থেকে ১১ জন দুর্গম পাহাড়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ হিজরত করেছিলেন। কিন্তু সেসময় কেএনএফ ও শারক্কীয়ার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। চট্টগ্রাম থেকে তাদের দুটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকা ও সিলেট নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাদের ফিরিয়ে এনেছিলেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। যারা এসময় হিজরতের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন তারা আগে ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
শফিকুরের ছেলে সাইফুল্লাহ জঙ্গি সংগঠন শারক্কীয়ার আগে আনসার আল ইসলামে যোগ দিয়েছিলেন। আনসার আল ইসলামে থাকাকালে তার মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলের অনেকে ওই সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন। পরে শারক্কীয়ার দাওয়াত পেয়ে তিনি তাতে যুক্ত হন। সিলেটে শফিকুরের বাসায় সাইফুল্লাহ সহযোগীদের নিয়ে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। শফিকুর বিষয়টি শুধু জানতেন, তা নয়, ক্ষেত্রবিশেষে তিনি এবিষয়ে তার পুত্র সাইফুল্লাহকে সহযোগিতা করতেন। আবার হিজরতে যাওয়ার ব্যয়ভার শফিকুর নিজে বহন করেছেন।
জামায়াত ইসলামীর আমির বর্তমান শফিকুর রহমান তার পুত্রকে নিজ দলে এবং জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হতে সহায়তা দিলেও উপমহাদেশে জামায়াত ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী কিন্তু তার কোন সন্তানকেই তার প্রতিষ্ঠিত দল জামায়াত ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করেন নাই। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে দুই দিনের ঢাকা সফর কালে মাওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর পুত্র সৈয়দ ফারুক মওদুদী বলেছিলেন, “আমার পিতা জামায়াত-ই-ইসলামী-র প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু তার নয় সন্তানের কেউই এই দলটির সমর্থক নয়।” পিতা মওদুদী তার পুত্রদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। জামায়াতের রাজনীতির সাথে পুত্রদের কাউকেই জড়িত করেন নি বা জড়িত হতে দেন নি। শুধু তাই নয় দলটির কোন বইপত্রও পিতা তার পুত্রদের পড়তে দেননি। মাওলানা মওদুদীর পুত্র সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী একজন সাবেক পাইলট এবং বর্তমানে পাকিস্তানের একজন কলামিস্ট। ফারুক মওদুদী বলেছেন, ‘জামায়াত-ই- ইসলামী বাংলাদেশের জন্মে বাধা দিয়েছে। অতএব তাদের এদেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই।’ “ধর্ম ও রাজনীতি : দক্ষিণ এশিয়া” শীর্ষক দু’দিনের এক আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্মেলনের শেষ দিনের সমাপনী অধিবেশনে তিনি মঞ্চে বসেই কথা বলেন এবং বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি ঢাকা ক্লাবে সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য রাখেন, ঢাকায় ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শন করেন। ফারুক মওদুদীর শিক্ষা, পেশা, সৌজন্যমূলক আচরণ এবং ঢাকা সফরকালে যেসব তথ্য তিনি উপস্থাপন করেছেন, বক্তব্য প্রদান করেছেন এবং যেসব স্থান তিনি পরিদর্শন করেছিলেন তা থেকে যে বার্তাটি আমরা পাই তাহলো তিনি নিজে আধুনিক ‘ভদ্র’ ও ‘সৌজন্যমূলক আচরণের’ একজন আলোকিত উদার মানুষ এবং তার বক্তব্য দ্বারা তিনি অন্ধকার থেকে আলোতে এবং অসভ্যতা থেকে ‘সভ্য’ ও ‘ভদ্র’ হবার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও তিনি জামায়াত ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদীর পুত্র। অথচ এর উল্টোটি আমরা দেখছি বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক জঙ্গি রাজনৈতিক দল জামায়াত ইসলামীর বর্তমান আমির শফিকুর রহমানের ক্ষেত্রে। যুগপৎ আন্দোলনের নামে তারা এখন বিরোধী দল বিএনপি-কে সমর্থন করছে!
লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা; সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
অরুণ কুমার গোস্বামী মত-দ্বিমত শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশের প্রধান হুমকি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস