মেসিই মহানায়ক, পেলেন অমরত্বের ছোঁয়া
১৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১৫:৪৮
‘ঈশ্বর হয়তো আমার হাতেই বিশ্বকাপটা দেখতে চেয়েছিলেন। মনেও হচ্ছিল কাপটা আমার হাতে উঠবে।অবিশ্বাস্য লাগছে। যা হয়েছে সেটা বিশ্বাস করতে পারছি না।বিশ্বকাপ জেতার থেকে আনন্দের মুহুর্ত আর নেই। যেকোনো ফুটবলারের একমাত্র স্বপ্ন থাকে দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা। যা কিছু আজ অর্জন করেছি তার জন্য আমি ভাগ্যবান।একমাত্র বিশ্বকাপটা আমার ঘরে ছিল না,সেটাও এসে গেলো।’ ম্যাচ শেষে গনমাধ্যকে কথা গুলো বলেছেন ফুটবলের বিস্ময় জাদুকর লিওনেল মেসি।
বিশ্বকাপ ট্রফিটা মেসির জন্য কত আরাধ্য ছিল, সেটা ট্রফিতে তাঁর চুমু খাওয়ার দৃশ্য দেখে ফুটবল বিশ্ব বুঝতে পেরেছে। মেসির যেন তর সইছিল না। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের শেষে ট্রফি তুলে দেয়া হবে। কিন্তু তিনি যখন গোল্ডেন বলের পুরস্কার নিতে আসেন তখন পাশে বিশ্বকাপ ট্রফিটা দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ট্রফিকে একে দিলেন ভালোবাসার চুমু। তারপর গোল্ডেন বল হাতে গেলেন ফটোসেশানে।
কথায় আছে, নিয়তির লিখন না যায় খন্ডন। নিয়তি হয়তো এমনই চিত্রনাট্য লিখছিলেন, যে ফুটবলের মহানায়কের হাতে যেনতেন ভাবে কাপটা যেতে পারে না। নাটকের পর নাটক, শ্বাসরুদ্ধকর রোমাঞ্চ চুড়ান্ত ফলাফলে লিওনেল মেসির হাতে কাপ। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা ফাইনাল খেলা উপহার দিলো কাতার বিশ্বকাপ। ফাইনাল ছিলো রোমাঞ্চকর উত্তেজনায় ভরা। গোটা ম্যাচ জুড়ে খেলার রং বদল হয়েছে বারবার। প্রথমার্ধে ২-০ আর্জেন্টিনা এগিয়ে, দ্বিতীয়ার্ধে ২-২। অতিরিক্ত সময়ে ৩-৩ ম্যাচ টাই। অবশেষে টাইব্রেকারে ৪-২ বাজিমাত করে আর্জেন্টিনা। বীরদের সাথেই তো ভাগ্য দেবতা থাকেন। এটাই ছিলো লিওনেল মেসির শেষ বিশ্বকাপ, এজন্যই হয়তো ভাগ্য দেবতা তাঁকে খালি হাতে ফেরায় নি। দীর্ঘ ৩৬ বছরের অপূর্ণতা, মেসির হাতেই পূর্ণতা পেল আর্জেন্টিনা।
লিওনেল মেসি এমন একজন ফুটবলার যাকে ইতিহাস আগেই অমরত্ব দিয়েছে। তিনি তাঁর বাঁ পায়ের জাদুতে বারবার ফুটবল বিশ্বকে মুগ্ধ করেছেন। এবারের বিশ্বকাপেও তিনি ফুটবল প্রেমীদের দারুণ কিছু মুহুর্ত উপহার দিয়েছেন। কখনো আকর্ষণীয় পেনাল্টি শট, কখনো মাটি কামড়ানো শটে প্রতিপক্ষে বোকা বানিয়েছেন আবার কখনো সতীর্থদের জন্য তৈরি করেছেন গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। ২০২২ বিশ্বকাপে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ ৫ বার (সব মিলিয়ে ১০ বার, যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে একজন খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ)। ২০২২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মোট গোল ১৫টি। মেসি করেছেন ৭টি। সতীর্থের দিয়ে করিয়েছেন ৩টি। ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গোল করে বিশ্বের প্রথম ফুটবলার হিসেবে প্রতিযোগিতার সব পর্বের গোল করার রেকর্ড করলেন। গ্রুপ পর্বে সৌদি-আরব ও মেক্সিকো, প্রি-কোয়ার্টারে অস্ট্রেলিয়া, কোয়ার্টারে নেদারল্যান্ডস, সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া, ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গোল করেছেন। এছাড়া পাঁচটি বিশ্বকাপে গোলে সহায়তা করা একমাত্র খেলোয়াড় এখন মেসি।
মেসিকে সবাই বাঁ পায়ের জাদুকর বলে থাকেন। তবে তিনি ডান পায়ে এবারের বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি পেয়েছেন। তিনি ক্যারিয়ারে ৮০৪ টি গোল করেছেন। ফাইনালের দ্বিতীয় গোলটি তার ডান পায়ের শততম গোল। ফাইনালে জোড়া গোল করায় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মোট গোল ২৬টি। কোপা আমেরিকায় ১৩টি ও বিশ্বকাপে ১৩টি। এতে করে ল্যাতিন আমেরিকা অঞ্চলে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তিনিই সর্বোচ্চ গোলদাতা। বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইকিহাসে কেউ এখন পর্যন্ত ২ বার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হননি, এবারের বিশ্বকাপে সেই বিরল অর্জনটিও তিনি করলেন।
ফুটবল মেসিকে দু-হাত ভরে দিয়েছে। বিশ্বকাপটাই শুধু মেসির কাছে অধরা ছিলো। ক্লাব ফুটবলের ক্যারিয়ারে ভুরিভুরি অর্জন রয়েছে। কোপা আমেরিকায়ও দেশকে বিজয়ী করেছে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মেসি ১৭৩ টি ম্যাচ খেলেছেন, গোল করেছেন ৯৮টি। বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছেন ৫ বার (২০০৬, ২০১০, ২০১৪, ২০১৮, ২০২২) একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে পাঁচটি বিশ্বকাপে গোল অ্যাসিস্ট করার অন্যন্য কীর্তি। দেশের হয়ে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন (২০২১), কনমেবল-উয়েফা কাপ অব চ্যাম্পিয়ন (২০২২), সামার অলিম্পিক (২০০৮ স্বর্ণপদক), যুব বিশ্বকাপ (২০০৫) চ্যাম্পিয়ন। মেসির ব্যক্তিগত অর্জন ব্যালন ডি’অর রেকর্ড ৭ বার (২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৫, ২০১৯, ২০২০)। ২০০৯ ও ২০১৯ সালে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল (সেরা খেলোয়াড়) নির্বাচিত হন। ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু (ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল লীগে) ৬ বার (২০০৯, ২০১১, ২০১২, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮) ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ গোল্ডেন বল ২ বার (২০০৯, ২০১১), ২০২০ সালে লরিয়াস ওয়ার্ল্ড স্পোর্টসম্যান অফ দ্যা ইয়ার।
ল্যাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা বাংলাদেশ থেকে ১৭ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। দুই দেশের যোগাযোগে সরাসরি নেই কোন ফ্লাইট। নেই কোন দূতাবাসও। দুই দেশের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কৃতিতেও নেই কোনো মিল। কিন্তু একমাত্র ফুটবল দুই দেশের জনগনের মধ্যে এক গভীর মেলবন্ধন তৈরি করেছে। এজন্য বন্ধুত্ব আরো জোরালো করতে আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো কাফিয়েরো ঘোষণা দিয়েছেন, খুব দ্রুতই বাংলাদেশে কুটনৈতিক মিশন স্থাপন করবে। যা ১৯৭৮ সাল থেকে বন্ধ আছে। নিঃসন্দেহে এই কুটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে ফুটবলই অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ মানুষ সুদীর্ঘকাল হতেই ফুটবলের প্রতি অনুরাগী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম দিকে ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলে ও জিকোর খেলা দেখে মানুষ ভক্ত হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনার নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতলে বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়। তারপর তিন যুগ পেরিয়ে গেলেও সমর্থনে একটুও ভাটা পড়েনি আর্জেন্টিনার। তারা ম্যারাডোনার জায়গায় মেসিকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
সর্বকালের সেরা নিয়ে এখনও বিতর্ক থাকলেও পেলে, ম্যারাডোনার নামের সাথে লিওনেল মেসির নাম আর কেউ বাদ দিতে পারবে না। বর্তমান সময়ে মেসি, রোনালদো, নেইমার বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল খেলোয়াড়। তারা কোটি কোটি মানুষকে আনন্দ দিয়েছে, ভালোবাসাও পেয়েছে। রোনালদো ও নেইমার বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। কিন্তু মেসি সেটা করে দেখালেন। তিনি নিজেকে সর্বকালের সেরাদের কাতারের সর্বোচ্চ উঁচুতে নিয়ে গেলেন।
একটা বিশ্বকাপ ট্রফি লিওনেল মেসির প্রাপ্য ছিল। ফুটবল বিশ্বের অনেক খেলোয়াড়, দর্শক ভিন্ন দল সমর্থন করলেও সবাই একটি জায়গায় একমত ট্রফিটা অন্তত মেসির হাতে যাক। মেসির আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করার পর ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের অন্যতম ব্রাজিলের কিংবদন্তি ‘কালোমানিক’ খ্যাত পেলে বলেছেন, আজ ফুটবল তার গল্প বলাটা চালিয়ে যাবে, সব সময়ের মতো রোমাঞ্চকর ভাবে। মেসি এবার প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছে। তার ক্যারিয়ার যেভাবে এগোচ্ছিল, তাতে এটার যোগ্যই ছিল সে। যোগ্য হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছে মেসির আর্জেন্টিনা। এটা শুধু পেলের একার কথা নয়। এটা ফুটবলের সাবেক-বর্তমান খেলোয়াড়, ফুটবলপ্রেমী কোটি কোটি দর্শকেরই মনের কথা। আজ একটি দিনে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা ভেদাভেদ ভুলে সবাই মেসির ক্ষেত্রে একই মোহনায় মিলিত হযেছিল। গোটা বিশ্বের ফুটবল ভক্তরাও চেয়েছে ফুটবল জাদুকর মেসির হাতে কাপটা উঠুক।
লিওনেল মেসির ক্যারিয়ারে অসামান্য সব অর্জন রয়েছে। যা আর কোনো ফুটবলারের নেই। ফুটবল ইতিহাসে তিনি এমনিতেই অমরত্ব লাভ করেছেন। একটি ট্রফি দিয়ে হয়তো তার মতো কিংবদন্তিকে মাপার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও একটা শূন্যতা নিয়ে তাকে সারাটি জীবন চলতে হতো। সর্বকালের সেরা ফুটবলার নিয়ে নিন্দুকেরা প্রশ্ন করার সুযোগ পেতো। কিন্তু আজ তার সব প্রশ্নের জবাব তিনি বিশ্বমঞ্চের মাঠেই দিয়েছেন।
২০১৪ সালেও একবার মেসির বিশ্বকাপ জেতার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ভাগ্যদেবী মেসির জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন। জার্মানির কাছে হেরে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিতে হযেছিল। পরের বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিদায় নিতে হয়। বিধাতা কি রসিক, এ যেন মধুর প্রতিশোধ। এবার সেই ফ্রান্সকে হারিয়েই চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপে মেসির বিদায়ী ম্যাচে চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে হারিয়েই চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে। অভিনন্দন লিওনেল মেসি। অভিনন্দন আর্জেন্টিনা।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি