মে দিবস, শ্রমজীবীর যে লড়াই আজও প্রাসঙ্গিক
১ মে ২০১৮ ১৭:১২
মেহনতি মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যে তারিখটি জড়িয়ে রয়েছে, সেটি পহেলা মে। মহান মে দিবস নামে দাপ্তরিকভাবে পরিচিত দিনটি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, মজদুরের জন্য যেখানে প্রতিটি দিনই সংগ্রামের- সেখানে এই বিশেষ দিনটি কেন অনন্য।
এর উত্তরও রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আজ থেকে ১৩২ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে ১৮৮৬ সালে হে মার্কেটের সামনে শ্রমিক আন্দোলনের সূত্র ধরে বিশ্বব্যাপী এই দিনে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে। শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আদায়ে এই দিন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল শতবছর আগের ওই আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য। আট ঘন্টা শ্রম দিয়ে দিনের বাকি সময় ঘুম-শারিরীক বিশ্রামসহ পারিবারিক-ব্যক্তিগত কাজের সময় চেয়ে শ্রমিকরা সেদিন আন্দোলনে নেমেছিলেন। শ্রমিকরা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচতে চেয়েছিলেন। কেননা কল-কারখানা তখন গিলে খাচ্ছিল শ্রমিকের গোটা জীবন। অসহনীয় পরিবেশে প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো। সপ্তাহজুড়ে কাজ করে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে যাচ্ছিল। শ্রমজীবি শিশুরা হয়ে পড়েছিল কঙ্কালসার। তখন দাবি উঠেছিল, কল-কারখানায় শ্রমিকের গোটা জীবন কিনে নেয়া যাবে না। সুস্থ মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে গেলে দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করা উচিত নয়।
দৈনিক কর্মঘন্টা আট ঘন্টা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়েই মে দিবসের এই লড়াইয়ের সূত্রপাত। ৮ শ্রমঘন্টার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের সময় ওই বছরের ১লা মে শ্রমিকরা ধর্মঘট আহবান করে। প্রায় তিন লাখ মেহনতি মানুষ হে মার্কেটের সামনে সেদিন ওই সমাবেশে অংশ নেয়।
শিল্পীর তুলিতে হে মার্কেটের সামনের শ্রমিক বিক্ষোভের ছবি
আন্দোলনরত ক্ষুদ্ধ শ্রমিকদের ঘিরে ছিল পুলিশ। একপর্যায়ে তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে প্রায় ১০ জন শ্রমিক নিহত হন, আহত ও গ্রেফতার হন আরো অনেক শ্রমিক। পরবর্তীতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে গ্রেফতারকরা শ্রমিকদের মধ্য থেকে ছয়জনকে আন্দোলনে অংশ নেয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
এরপর থেকে দিনটি বিভিন্ন আঙ্গিকে পালন হয়ে আসছিল। ১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে শ্রমিকদের প্রথম আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন শ্রমিক নেতা রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালে সংগঠনটির দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এরপরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসে দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহবান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালনের দাবী জানানো হয় এবং অনেক দেশেই এটা পর্যায়ক্রমে কার্যকরী হয়। এখন বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পহেলা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়।
শতবর্ষ আগের সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তখনকার শ্রমিকরা শ্রমের নায্য অধিকার আদায়ে সক্ষম হয়েছিলেন। ইউরোপ, আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের অধিকার। কিন্তু অনুন্নত দেশগুলোতে এটা করা সম্ভব হয়নি। অনুন্নত দেশগুলোর কলকারখানা মালিকরা কাগজে-কলমে আট ঘণ্টা কাজের দাবি মানলেও বাস্তবে তা বিরাজ করে না। শ্রমিকরা আন্দালন করে এই দাবির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করলেও আমরা প্রতিদিন যেন আরও পেছনে হাঁটছি।
আজো জীবনকে সচল রাখতে যে জীবিকার প্রয়োজন সেই জীবিকাই খেয়ে ফেলে জীবনের পুরোটা। শুধু শ্রমিকরাই নন যারা তথাকথিত উচ্চ বেতনের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রেও শ্রম আইনের এই এখন আর এই নিয়ম মানতে পারেন না। সে হিসাবে মানুষকে স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে চিন্তা করা হয় না এখন। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতি সাধারণ শ্রমিক তো বটেই, উঁচু বেতনের কর্পোরেট শ্রমিকের জীবন থেকেও স্বাভাবিক বিশ্রাম বিনোদন কেড়ে নিয়েছে। সে হিসাবে মে দিবসের তাৎপর্য আজ আর অনেকের জীবনেই সত্য বলে প্রতীয়মান হয় না। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনে উত্তোরণের সুযোগ রয়েছে অনেক। তাই শিকাগোর সেই আন্দোলনের সফলতার শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও মে দিবস আজো প্রাসঙ্গিক।
লেখক : সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই