আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে, উন্নতি হচ্ছে কতটুকু?
৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:২৩
উন্নয়ন মানে রাস্তাঘাট, পদ্মা ব্রিজ, মেট্রোরেল, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ইত্যাদি। উন্নতি মানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মিক উন্নয়ন। প্রথমটা হচ্ছে, সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো করে। পুরা পৃথিবীরই তাক লেগে যাচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে। এটা সরকারের সফলতা, দক্ষতা, দেশপ্রেম। অন্য কোন সরকার থাকলে এতোটা হতো না এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
একটা উদাহরন দেই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনে হলো, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় সীমান্তের ঐ পাশে ভারতে ভালো মানের চা উৎপাদন হলে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওয়ে কেন হবে না। জলবায়ু ও মাটিতো একই বা কাছাকাছি হবার কথা। তার ভাবনা অনুযায়ী তিনি কাজও শুরু করেন। ফলশ্রুতি আজ ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ছাড়াও দিনাজপুর, নিলফামারীতে ব্যাপকভাবে চা চাষ হচ্ছে। তিনশ’র মতো ছোট বড় চা বাগান এখন ঐ অঞ্চলে।
উন্নয়ন হলেও আমাদের জাতিগত উন্নতি হয়নি। অবনতি হয়েছে। এই অবনতিও তাক লাগানোর মতো। আমরা এখন দারুনভাবে সৌন্দর্যবিমুখ জাতি। যে কোন সুন্দরকে নষ্ট করাতেই যেন আমাদের আনন্দ। প্রত্যেকটা জায়গার সৌন্দর্য আমরা নষ্ট করি। আগেও করতাম। তবে এখন শাখা প্রশাখা মেলেছে অনেক। অন্ধত্ব এখন বহুমূখী। এই যে কিছু দিন আগে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলো। একজন পদ্মা সেতুর নাট বল্টু খুলে ফেললো। হতে পারে রাজনৈতিক কারণে। হতে পারে ভাইরাল হবার নেশায়। মেট্রোরেল উদ্বোধন হলো। উদ্বোধনের দিন যোগাযোগ মন্ত্রীর ছবি দেখলাম মেট্রোরেলে। উনার পাশেই বড় করে লেখা, “শরীফ + সোনিয়া”। ধারণা করি লেখক শরীফ বা সোনিয়া কেউই খুব শিক্ষিত নন। পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খোলা শিক্ষিত ছেলেটা আর কম শিক্ষিত শরীফের ভিতর পার্থক্য কতটুকু। কোন পার্থক্য নেই। শিক্ষিত অশিক্ষিত সবারই ভেতরেই এখন গাঢ় অন্ধকার।
ঢাকা-চট্রগ্রাম যেতে দুটা ব্রীজ পার হতে হয়। পুরান ব্রীজগুলোর পাশে নতুন ব্রীজ হয়েছে। আমার এক বন্ধু বলছিলেন, পুরান দুইটা সেতু না ভেঙ্গে সেখানে খাবারের দোকান দেওয়া যেতে পারে। মানুষজন বিকালে এসে আড্ডা দিবে, খাবে, নদীর সৌন্দর্য দেখবে। খুবই ভাল ভাবনা। কিন্তু সমস্যা হলো এমন উদ্যেগ নিলে ব্যাবসায়ী ও ভ্রমনকারীরা মিলে বছর খানেকের মধ্যে প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট ও অন্যান্য ময়লা ফেলে শীতলক্ষ্যা, মেঘনা দুই নদীকেই মেরে ফেলত। জাতিগতভাবে আমাদের যদি উন্নতি হতো, তবে এ অবস্থা হতো না।
মানুষ ক্রমাগতভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। এইটা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। আগে মানুষ চেষ্টা করতো, সুকুমারবৃত্তির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার। ছোটবেলা থেকেই গান, নাচসহ বিভিন্ন সৃষ্টিশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করতো। গ্রামে, শহরে বিভিন্ন এলাকার কিশোর-তরুণরা বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। অনুষ্ঠানের খরচ যোগাড় করতে আয়োজকদের জান বের হয়ে যেত। কত দরিদ্র ছিলাম তখন। এখন আর্থিক দারিদ্রতা নাই কিন্তু আত্মিক দারিদ্রতার কারণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে।
আমাদের নতুন নতুন গান-নাচ শিক্ষার স্কুল হবার কথা ছিল। নতুনতো হয়ইনি উল্টো পুরোনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা গেছে। এখন নিজেকে প্রকাশ বা ভাইরাল করতে মানুষ যা-তা করে বেড়াচ্ছে। সবই শর্টকাট। ইউটিউব বা ফেইসবুকে একটা গান আপলোড হলে লাখ লাখ ভিউজ হয়। কিন্তু গানের শিল্পী কই? এ সংখ্যা বাড়ার বদলে কমছে। শর্টকাটে ভাইরাল হবার জন্য মানুষ যেমন অরুচিকর ও অশ্লীল কনটেন্ট তৈরি করছে তেমনি করছে উদ্ভট কর্মকান্ড। উদাহরণ হিসাবে সম্প্রতি হট টক নুহাশ হুমায়ুনের ঘটনাটা বলা যায়। হুমায়ুন আহমেদের পুত্র নুহাশের সাথে কোনো একটা ডেটিং এপে এক তরুণীর পরিচয়। নুহাশ তাকে কফি খাবার দাওয়াত দেন। ঐ তরুণী এই দাওয়াতের স্ক্রীনশট প্রকাশ করে ফেইসবুক গরম করেছেন। সাধারণ কফি খাবার দাওয়াত। নুহাশ যেহেতু সেলিব্রেটি তাই তার সাথে জড়িয়ে কোনো একটা ঘটনা তৈরি করতে পারলেই রাতারাতি পরিচিতি পাওয়া যাবে। তরুণীটি এই ঘটনা ঘটিয়েছে এই পরিচিতি বা ভাইরাল হওয়ার জন্য। তিনি সফলও হয়েছেন। তাকেও এখন অনেকে চেনে! যদিও এই ভাইরালের আয়ু থাকবে এক বা দেড় সপ্তাহ। কারণ এমন ঘটনা আর ঘটানো যাবে না।
উপমহাদেশের মানুষ ধার্মিক। সেটা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ যে ধর্মাবলম্বীই হন না কেন! বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যষিত অঞ্চল। আগে জামায়ত-ই-ইসলামি কৌশলে ধর্মীয় মৌলবাদ ছড়াত। একাত্তরের ইতিহাসে আমরা পাই সেই সময়ে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হতো। আজও হিন্দুদের কৌশলে গরুর মাংস খাইয়ে দেওয়া হয়। ধর্মব্যাবসায়ী কারও বিরুদ্ধে বললে, অন্য ধর্মাবলম্বিদের সাথে করা অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই সহজে যে কারও নামের পাশে, ‘নাস্তিক’, ‘কাফের’ ইত্যাদি তকমা লেগে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষও এসব বিশ্বাস করছে। সারাদিন কানের পাশে এ ধরণের বক্তব্য শুনলে সাধারণ মানুষ তো বিশ্বাস করবেই।
আর এখন শুধু জামায়ত-ই-ইসলামি না, বিশাল একটা গোষ্ঠী ধর্মকে বিকৃত করে বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়াচ্ছেন। বিজ্ঞান থেকে শিল্প সংস্কৃতি, খেলাধুলা থেকে রাজনীতি তারা সব কিছুতেই বিশেষজ্ঞ। এবং বিশেষভাবে অজ্ঞ ধর্মীয় ব্যাপারে। তারা ভাইরাল হবার জন্য, বিখ্যাত হবার জন্য নিজের প্রয়োজন মতো ধর্মকে ব্যবহার করেন, বিকৃত করেন। নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়ান। একজন আরেকজনকে নির্বিকারভাবে ‘নাস্তিক’, ‘কাফের’ এসব ফতোয়া দেন। এদেরই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কি! জাতির আত্মিক ও আচরণগত এসব সমস্যার সমাধান না হলে সামনে সমূহ বিপদ! এজন্যই বলা, আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু উন্নতি হচ্ছে কতটুকু!
লেখক: লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু উন্নতি হচ্ছে কতটুকু? জহিরুল হক বাপি মত-দ্বিমত